গল্প

জবানা ও নেতার গল্প – ফয়সাল আহমেদ

নরসুন্দা ডটকম   সেপ্টেম্বর ২৪, ২০১৬

মুন্সি বাড়ির পুকুর পাড়ের ঠিক দক্ষিণ দিকে অনেকগুলো চেয়ার, বেতের তৈরি মোড়া ও লম্বা কাঠের টুল পাতা হয়েছে। পুকুরের এদিকটায় গাছের সংখ্যা বেশি থাকায় বেশখানিকটা জায়গাজুরে ছায়া পড়েছে। সে কারণে এখানেই বসার আয়োজন করা হয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার, পর্দানী বাড়ির বড়পর্দানী, পূর্বপাড়া যুব কল্যাণ সমিতির সভাপতি, মুন্সি বাড়ির ছোটমিয়া, ভূইয়া বাড়ির বড় ভূইয়াসহ সবাই এসেছেন। বলতে গেলে এলাকার গণ্যমান্য কেউ বাদ যায়নি, যিনি এখানে আসেননি। জয়বাংলা বাজারের দোকানীরাও এসেছেন দলবেঁধে। ঘটনা যেহেতু ওখানেই ঘটেছে তাই বিষয়টি নিয়ে তাদের আগ্রহও অধিক। ঘটনার সাথে জড়িত দুই পক্ষও হাজির। তারপরও আলোচনা শুরু করা যাচ্ছেনা। যার জন্য সবার এই অপেক্ষা তিনি আব্দুল হালিম, তবে এলাকায় ছেলে-বুড়ো সবার কাছে জবানা মামু নামেই পরিচিত। ঘটনাচক্রে আজকের সালিশের একমাত্র সাক্ষী তিনি। বিচারের রায় কি হবে তা এই মুহূর্তে বলতে না পারলেও, এটি যে হবে জবানার কথার উপর ভিত্তি করে তা একরকম নিশ্চিত করেই বলে দেয়া যায়।

সত্য বলা মানুষ হিশেবে জবানার আলাদা একটা সুনাম আছে। যদিও সে একটু ভিন্ন প্রকৃতির খেয়লি মানুষ বলেই সবাই মনে করে। যুবক ছেলেদের সাথে আড্ডা দিয়ে রাত কাটিয়ে দেওয়া, যাত্রা দলের সাথে দিনের পর দিন পার করা, মাইলের পর মাইল হেঁটে সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখা, নিজে অভাবি হলেও এলাকার কেউ সমস্যায় পড়লে তার পাশে দাঁড়ানো এসবই জবানার বৈশিষ্ট্য। ছেলেপুলেদের হৈ হৈ উল্লাসের মধ্য দিয়ে জবানা উপস্থিত। সবাই একটু নড়েচড়ে বসলেন। শুরু করলেন বড় ভূইয়া, কারণ তাকেই সবাই সভাপতি নির্বাচিত করেছেন। প্রথমপক্ষ অভিযোগকারী তার অভিযোগ উত্থাপন করার সুযোগ পেয়ে বললেন- আমার কওনের কিছু নাই, জবানা মামুই আমার একমাত্র সাক্ষী তাইনেই সব কইবেন। দ্বিতীয়পক্ষ যার বিরুদ্ধে অভিযোগ সেও বললো- সভাপতি সাব আমারও কিছু বলার নাই, যা বলার জবানা মামুই বলবেন। স্বাভাবিকভাবেই এবার জবানার পালা। তবে সরাসরি জবানাকে বলার সুযোগ না দিয়ে মুন্সি বাড়ির ছোট মিয়া বললেন মামু আজকের এই দরবারের রায় আপনার উপর নির্ভর করছে, সুতরাং সত্য কথাই প্রত্যাশা করি আপনার নিকট। বিষয়টি মাথায় নিয়ে কথা বলবেন।

কি আর কইয়াম মিয়াছাব, এই জবানা এককথার মানুষ। এই জবানা কোনো সময় মিছা কথা কয়না। এই জবানা জীবনে কারো ক্ষতি করে নাই, জবানারে চিনে না এমন লোক এই অঞ্চলে নাই। এইডা ঠিক আমার কিছু দোষ আছে। তাই বইল্যা কোনোদিন কারো কাছে মাথানত করি নাই।
জবানা, নিজের বয়ান রেখে আসল কথা বল, এগুলো আমরা সবাই জানি। সভাপতির এমন কথায় কিছুটা চুপশে যায় জবানা। একটু পর আবার শুরু করে।
এই জবানা এককথার মানুষ। তহন আসরের ওয়াক্ত, আমি ঘরে, আপনেরার বউ আমারে কইলো- হুনেন ঘরে বাজার-সদাই কিছু নাই, রান্ধা কিন্তু অইতো না। আমি কইলাম বউ একখান পান বানাইয়া দেও, তোমার হাতের পান খাইয়া তারপর বাজার আনতে যাই। বউ আমারে পান বানাইয়া দিল। পান মুখে দিলাম, বুঝলাম চুন দেয় নাই, আমি কইলাম, বউ চুনতো দেও নাই, বউ টুলি থেইক্যা চুন আঙ্গুলে নিয়া আমার ডাইন হাতের তর্জনিতে বড়াইয়া দিল। মজা কইরা পান চিবাইতে লাগলাম। বউ আবার কইলো-বাজার লাগবো। আমি কইলাম ব্যাগডা দেও। বউ ব্যাগডা আগাইয়া দিল। আমি হাতে নিলাম আর রনা অইলাম বাজারের দিগে।
তারপর?
হেরপর আর কি, পথের মইধ্যে পুবপাড়া যুবকল্যাণ সমিতির সেক্টেটারির লগে দেহা, হে জিগাইলো মামু কই যাও?
আমি কইলাম, আর কইয়ো না, তোমার মামি কইলো ঘরে বাজার-সদাই নাই, আইজই লাগবো নাইলে রাইতে রান্ধা অইতো না, খাওন কিন্তু বন্ধ থাকবো। কি আর করা, বাজার আনতে যাইতাছি। এই কথা হুনার পর হে আমারে রাইতের বেলা সমিতির অফিসে যাওনের দাওয়াত দিল, আমি কইলাম, যাইয়ামনে। সমিতি অফিসে যাইতে আমার কোন আপত্তি নাই, তবে এইবার কিন্তু যাত্রার দল আনতেই অইবো।
জবানা এবার আসল কথা বলো?
কথা শেষ কইরা আমি বাজারে ডুহি। ডুকতেই দেহি আমরার ইউনিয়নের চেয়ারম্যানছাব খারাইয়া আছে, আমি তারে সালাম দিলাম, সালাম নিয়া আমারে চা খাওনের কথা কইলো। চেয়ারম্যানছাব বিরাট সম্মানী লোক, তারে তো আর না হরতারি না। ছমিরদ্দির দোহানে বইয়া এককাপ চা খাইলাম। চা খাইতে খাইতে নানান কথা জিগাইলো। এই বার পুবপাড়ায় যাত্রাদল আইবো কিনা? আমি কইলাম আইতো পারে, আমারে সেক্টেটারি রাইতের বেলা যাইতে কইসে, দেহি কি কয়। এই কথা বইল্যা চেয়ারম্যানছাবের কাছথেইক্যা বিদায় লইয়া রতনের দোহানের দিগে রনা দেই। গিয়া দেহি বিরাট ভিড় লাইগ্যা রইছে। অনেক মানুষ সদাই লইতাছে। আমি চিন্তা কললাম ভিড়টা কমুক, তারপর সদাই লই। খারইয়া আছিতো আছিই, ভিড়তো আর কমে না। পরে আমি কইলাম রতন, বাবা আমারে সদাইগুলা দেয়া দে, সন্ধ্যা অইয়া যাইতাছে। খাড়াও মামু দিতাছি। এই কথা বইল্যা এর আরো কতক্ষণ পর হে আইলো সদাই দিতে। ততক্ষণে দোহানের ভীড় কইম্যাগেছে। আমি ব্যাগডা আগাইয়া দিলাম, রতন ব্যাগ থেইক্যা বোতলডা লইয়া সইষ্যার তেল মাইপ্যা বরতাছে। আত্কা আমার চোখ পড়লো ক্যাশের দিগে, ঠিক ঐহানে দাঁড়াইয়া আছে, সুর্যালী। হে একটু নুইয়া কি যেন তুললো, এরই মধ্যে তেল মাপা থুইয়্যা রতন চিৎকার দিয়া উঠলো। এই সুর্যালী, তুই আমার ক্যাশে হাত দিছস কেরে? সুর্যালী কইলো আমি হাত দিছি না। আধাতেলভত্তি বোতলডা তইয়া রতন আগায়া গেল হের দিগে, এরপর দুইজনের চিল্লাচিল্লির মধ্যে একসময় রতন সুর্যালীর মাথাত সেরের পাথর দেআ বারি মারে। ততক্ষণে বাজারের মাইনষে চাইরদিক ভইরা যায়। দুইতিনজনে ধইরা রক্তাক্ত অবস্থায় সুর্যালীরে ওমর ডাক্তারের বাড়িত লইয়া যায়। এই হলো ঘটনা।
সুরুজ আলী কি রতনের দোকান থেকে টাকা নিয়েছে?
ভূইয়াছাব, কথা অইলো গিয়া সুর্যালী ক্যাশে ধরছে, এই কথা ঠিক, টেহা লইছে এই কথাও ঠিক তয় কথা অইলো সুর্যালী টেহা চুরি করে নাই। হে লইছে হের নিজের টেহা। ক্যাশের সাথে রাহা পানি খাওনের গেলেস লওনের সময় হের পকেট থেইক্যা টেহা পইরা যায় রতনের ক্যাশ বাক্সের উপরে। হেই টেহা তুইলা লইছে সরুজ আলী। এহন আপনেরাই এর রায় দেন।
তুমি কি দেখেছো?
না দেহি নাই, সুর্যালী কইছে। হে মিছা কথা কইতে পারে না, আমি হেরে ছিনি।
তাহলে কি রতন মিথ্যা বলছে?
আমি হেই কথাও কই না। তয় হে তো নিজেও দেহে নাই, সুর্যালী টেহা নিছে কি না। হে অতো অনুমান কইরাই কইতাছে।
জবানার বক্তব্যের পর উপস্থিত গণ্যমান্যবৃন্দ একে একে তাদের মত প্রকাশ করলেন। এরপর বিচারের রায় যখন ঘোষণা হবে ঠিক সেই মুহূর্তে একরকম দৌড়ে এসে উপস্থিত হন পূর্বপাড়া যুব কল্যাণ সমিতির সম্পাদক।
কাকা, দুঃসংবাদ আছে কাকা। বড় ভূইয়াকে উদ্দেশ্য করে।
দুঃসংবাদ! কি দুঃসংবাদ?
কাকা বঙ্গবন্ধু নাই।
নাই মানে! কও কি? নেতা নাই মানে? কি শুনাইলা আমারে, ইয়া মাবুদ তুমি কি শুনাইলা আমারে।
হ কাকা , সেনাবাহিনীর কিছু লোক মিলে তাঁকে হত্যা করেছে।
সংবাদটি শুনে যে যার দিকে তাকিয়ে ছিল সেভাবেই তাকিয়ে আছে, কেউ কোন শব্দ করছে না। যে বসে ছিল সে বসে আছে, যে দাঁড়িয়ে ছিল সে দাঁড়িয়ে আছে, পুকুর পাড়ের বাঁকা হয়ে উপরে ওঠা নারিকেল গাছটিতে যুবক ছেলেদের কয়েকজন যে যেভাবে বসে ছিল, তারাও সেভাবে বসে আছে। একজনও নড়ছে না, নাকি নড়তে পারছে না। সমস্ত শক্তি আজ হারিয়ে ফেলেছে তারা। হাত নড়ছে না, পা নড়ছে না, ঠোঁট নড়ছে না মনে হয় যেন জিহ্বাটাও আটকে আছে মুখের ভেতরে। মাথার উপর দিয়ে দল বেঁধে উড়ে যাওয়া চন্দনা পাখিগুলোও যেন তাদের যাত্রা থামিয়ে দিয়েছে। বিপুল উদ্দীপনা নিয়ে যে মাছরাঙ্গা পাখিটা এসেছিল শিকার ধরতে সেও পুকুরের পানিতে মুখ ঢুকিয়ে আছে, মাথা তুলছে না। কয়েক মূহূর্ত ধরে সবাই যেন স্তব্ধ হয়ে আছে।

আল্লারে এইডা কি অইলোরে, আমার নেতারে মাইরা ফালাইছেরে, অহন আমরার কি অইবোরে। জবানার আত্মচিৎকারে স্তব্ধ হয়ে যাওয়া সবাই যেন সম্বিত ফিরে পায়। তারপর পূর্বপাড়া যুব কল্যাণ সমিতির সম্পাদক ঘটনার বর্ণনা করতে থাকেন। আমি সকাল বেলায় রওনা দিয়ে দুপুর নাগাত শহরে পৌঁছাই। দেখি চারদিকের সব দোকানপাট বন্ধ, দু’একটা যাও খোলা আছে, তাও বন্ধের পথে। সাইকেল থেকে নেমে একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, ভাই ঘটনা কি? সে বললো, জানেন না ওরা নেতাকে মেরে ফেলেছে। পরক্ষণেই দেখলাম আমার সামনে দিয়ে হনহনিয়ে একটি মিছিল চলে গেল। ছাত্র ইউনিয়নের মিছিল। স্লোগান দিচ্ছে ‘ মুজিব হত্যার পরিণাম- ‘বাংলা হবে ভিয়েতনাম’, ‘মুজিব হত্যার বদলা নেব- বাংলাদেশের মাটিতে’, ‘এক মুজিবের রক্ত থেকে- লক্ষ মুজিব জন্ম নিবে’, ‘ডালিমের ঘোষণা- মানি না মানবো না’,। মিছিলটা শেষ হতেই হঠাৎ পুলিশের আক্রমণ। যে যার মত পালিয়ে গেল। আমিও একরকম সাইকেলসহ পালিয়ে এলাম।

কোনরকম ঘোষণা ছাড়াই সভা শেষ হয়ে গেল। কারো মনেই রইলো না যে এখানে তারা সবাই কেন সমবেত হয়েছিল। এখন তাদের মনে শুধু একটি বিষয়ই ঘুরপাক খাচ্ছে, নেতাকে কেন হত্যা করা হলো? বিষয়টি ভাবতে ভাবতে সবাই সভাস্থল ত্যাগ করলো। সবাই চলে গেলেও থেকে গেল শুধু একজন, জবানা। সে স্বেচ্ছায় থেকেছে বিষয়টি এমন নয়। এই মুহূর্তে সে সমস্ত শক্তি হারিয়ে নেতিয়ে পড়েছে মাটিতে, মনে পড়ছে তার অনেক কিছুই।

বেশকিছুদিন আগে একবার নেতাকে দেখার তার ভীষণ ইচ্ছা হলো, কিন্তু কিভাবে দেখবে তাঁকে, চাইলেইতো আর দেখা যাবে না, যেতে হবে অনেক দূরে, সুদূর ঢাকায়। গ্রামের এর কাছে, ওর কাছে যায়, সবাই বলে, সে অনেক কঠিন কর্ম, চাইলেই সম্ভব? সর্বশেষ মাফুজের সাথে সাক্ষাত। মাফুজ মেধাবী ছাত্র, গ্রামের মুখ উজ্জ্বল করা যুবক। সবাই তাকে খুব সমাদর করে। পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগে। এই মাফুজই তাকে পথ বাৎলে দেয় কিভাবে নেতার সাক্ষাত পাবে। পরদিন ভোরে রওনা হয় ঢাকার পথে, উদ্দেশ্য একটাই নেতাকে দেখা। হেঁটে, কখনও গরুর গাড়িতে, আবার ট্রেনে চড়ে দুইদিনে ঢাকায় পৌঁছায় সে, কিন্তু এখন নেতাকে কোথায় পাওয়া যাবে? মনে পরে মাফুজের কথা। সে বলেছিল বত্রিশ নম্বর বাড়িতে গেলে নেতাকে পাওয়া যাবে। এবার আবারও লোকজনকে জিজ্ঞেস করে করে পৌঁছে যায় বত্রিশ নম্বর বাড়ির সামনে। তখন সন্ধ্যা নেমে আসে। এদিন আর নেতাকে দেখার সুযোগ হয়না। কাছেই লেকের পাড়ে গাছের নিচে বসে রাত কাটিয়ে দেয় সে। দূরে কোথাও যায় নাই যদি এই ফাঁকে নেতা অন্যত্র চলে যায়, তাহলেতো আর দেখা হবে না প্রিয় নেতাকে। পরদিন শহরের মানুষ জেগে ওঠার আগে, জেগে উঠে জবানা। কি উত্তেজনা, সারারাত তো আর দুচোখের পাতা এক হয়নি তার। হাত দিয়ে চোখ দুটি কচলাতে কচলাতে বত্রিশ নম্বর বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায় সে। কিছুক্ষণ পর দুইজন নিরাপত্তাকর্মী খুলে দেয় বাড়িটির সদর দরজা। জবানার চোখ পড়ে সাদা পাঞ্জাবি আর কালো কোট পরিহিত গাড়িতে বসা সুঠামদেহি একজনের দিকে। ধীরেধীরে গাড়িটি সম্মুখপানে এগিয়ে আসে, আবেগে তার হাত দুটো অজান্তেই উপরে উঠে যায় এবং নড়তে থাকে। প্রতি উত্তরে গাড়ির ভেতরে থাকা মানুষটি, তাঁর মুখে থাকা কালো রংয়ের পাইপটি বাম হাতে নিয়ে হাঁসিমাখা মুখে ডান হাত নাড়িয়ে শুভেচ্ছা জানায়। স্বপ্নের নেতাকে এত কাছে দেখতে পেয়ে চোখের জল আর ধরে রাখতে পারেনি সে। অবিরত জল গড়িয়ে পড়ছে তার গাল বেয়ে। চলতে থাকা গাড়িটি আস্তে আস্তে তার গতিবেগ বাড়িয়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলে।

নোট: গল্পটি ১৬ আগস্ট ২০১৬ খ্রি. তারিখে বিডিনিউজ২৪ডটকমে প্রকাশিত হয়।

 

About the author

নরসুন্দা ডটকম