মানুষ- সমাজ

চিরঞ্জীব সঞ্জীব- হাদিউল আলম দীপ্র

নরসুন্দা ডটকম   নভেম্বর ১৯, ২০১৬

১৯৬৪ সালের ২৫ শে ডিসেম্বর বাবা স্বর্গীয় ননী গোপাল চৌধুরী ও মাতা স্বর্গীয় প্রভাশিনী চৌধুরীর কোল আলোকিত করে জন্ম নেয় কাজল। সেই কাজল নামের ক্ষণজন্মা ব্যক্তিটি হচ্ছেন সঞ্জীব চৌধুরী।

নব্বই দশকের অন্যতম জনপ্রিয় সঙ্গীতশিল্পী, সাংবাদিক, প্রকৃতিপ্রদত্ত কাব্য প্রতিভার অধিকারী কবি এবং লেখক।

জমিদার বংশে জন্ম নেয়া সঞ্জীব চৌধুরীর ছাত্রজীবন ছিল বর্ণিল। ভালো ছাত্রের সংজ্ঞা তাঁকে দিয়ে দেয়া যেত। পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণীতে বৃত্তিসহ, পরবর্তীতে মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় তিনি মেধা তালিকায় স্থান দখল করেন। তাঁর রঙ্গিন ছাত্রজীবনের সমাপ্তি ঘটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে “গণযোগাযোগ এবং সাংবাদিকতা” বিষয়ে স্নাতক-স্নাতকোত্তর করার মধ্য দিয়ে।

তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র থাকাকালে দেশে ছিল বিশৃঙ্খল অবস্থা, চলছিল এরশাদের দানবীয় স্বৈরশাসন। বিভিন্ন কারণে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে থাকতো বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস। তখন বন্ধুদের সাথে নিয়মিত আড্ডার আসরে বসতেন সঞ্জীব। বহুমাত্রিক আলোচনায় উঠে আসত বহু কিছু। খ্যাতি তখনো তাকে স্পর্শ করেনি। কিন্তু তবুও সবার মাঝে তিনি ছিলেন আলাদা।

000

তাঁর বোহেমিয়ান লাইফ স্টাইল, প্রথা বিরোধী প্রাগ্রসর চিন্তা ভাবনা, সদা হাস্যোজ্জ্বল সপ্রতিভ চালচলন তাঁকে করে তুলেছিল অনন্য, অণুকরণীয়।

শ্রেণীহীন সমাজের স্বপ্ন দেখতেন তিনি। তাই ভাগ্যের লিখনের মতই তিনি জড়িয়ে পড়েন বামপন্থী আন্দোলনে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত অবস্থায় জড়িয়ে পড়েন ছাত্র আন্দোলনের সাথে এবং পরবর্তীতে হয়ে ওঠেন দলের একজন সংগঠক এবং নিবেদিতপ্রাণ কর্মী।

তিনি বিশ্বাস করতেন মানুষের জন্য রাজনীতিতে। ১৯৯০ সালের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের সময় তিনি স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে কেবল কলম চালিয়েই ক্ষান্ত হননি। রাস্তায় নেমে পড়েছেন লোকজনকে উজ্জীবিত করতে। নিজে গলায় হারমনিয়াম ঝুলিয়ে মুক্ত মঞ্চে গেয়েছেন স্বৈরাচার বিরোধী গান।

সকলের সামনে উপস্থাপন করতেন স্বরোচিত কবিতা। ঐ সময়ে তার লেখা “আমি ঘুরিয়া ঘুরিয়া সন্ধানও করিয়া স্বপ্নেরই পাখি ধরতে চাই আমার স্বপ্নেরই কথা বলতে চাই …” কবিতাটি বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে। পরবর্তীতে ঐ কবিতাটি দলছুট ব্যান্ডে তাঁর কন্ঠেই গাওয়া হয়।

১৯৯৬ সালে বাপ্পা মজুমদারকে সঙ্গে নিয়ে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন গানের দল ব্যান্ড “দলছুট” । তাদের প্রথম এ্যালবাম “আহ”বেরোবার সাথে সাথেই সেটি বেশ সাড়া ফেলে। দলছুট পরিণত হয় সময়ের অন্যতম জনপ্রিয় ব্যান্ডের মাঝে একটি।

সঞ্জীবের গাওয়া গানগুলোর মাঝে রয়েছে –স্বপ্নবাজী, আমি তোমাকেই বলে দেব, চাঁদের জন্য গান, গাড়ি চলেনা ,বায়স্কোপ, সমুদ্র, এই নষ্ট শহরে ইত্যাদি।

লেখাপড়া শেষে তিনি মূলত সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নেন। আজকের কাগজ , ভোরের কাগজ , যায় যায় দিন ইত্যাদি দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকায় তিনি কাজ করে। এছাড়া বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তিনি কবিতা-গল্প লিখতেন।

তাঁর “রাশপ্রিন্ট” নামক গল্পগ্রন্থটি আশির দশকের সেরা গল্পগ্রন্থ নির্বাচিত হয়।

বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এই ব্যাক্তি লিখেছেন নাটকের স্ক্রিপ্ট,“সুখের লাগিয়া” নামক একটি নাটকে তিনি অভিনয়ও করেছিলেন। মানুষের জন্য ভালবাসা আর জীবনমুখী চেতনায় উদবুদ্ধতা প্রকাশ পেত তার লেখনিতে।

হয়ত এই চেতনাই ওকে উদ্বুদ্ধ করেছিল মৃত্যুর পর ওর মরদেহ মানব কল্যাণে কাজে লাগাতে। তাই সকল সংস্কারের উর্দ্ধে ওঠে তিনি তাঁর মরদেহ দান করে যেতে পেরেছিল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের অ্যানাটমী বিভাগে- চিকিৎসকদের গবেষণার জন্য।

সত্যি, মৃত্যুতেও সঞ্জীব চিরঞ্জীব হয়ে রইলেন।

ব্রেইন হেমারাইজে আক্রান্ত হয়ে ২০০৭ ইং এর ১৯ শে নভেম্বর,মাত্র ৪৪ বছর বয়সে ঢাকার আ্যাপোলো হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন সঞ্জীব চৌধুরী।

সেই সঞ্জীব চৌধুরী, যিনি তার স্বপ্নেরই কথা বলে গেছেন আজীবন। তাঁর গানের কথায় তিনি যেনো ঠিক কষ্ট চেপেই চলে গেলেন।

সঞ্জীব ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। সঞ্জীবের মতো স্বপ্নবাজী করা অসংখ্য তরুণের পদচারণা এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে সাংস্কৃতিক ইউনিয়নের উদ্যোগে সঞ্জীব চৌধুরীর একটি মুখায়ব আঁকা হয়েছে। যে সঞ্জীব এই ঢাকা টিএসসিতে জনতার সামনে নিজের স্বপ্নের কথা বলতে পেরেছিলেন, প্রেম আর দ্রোহ দুই আপাতবিরোধী স্বত্তাকে এক করে দিয়ে হাজার তরুণের বুকে উত্থাল-পাতাল ঝড় তুলে দিয়েছিলেন সে সঞ্জীব চৌধুরীকে আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই নবীন ছাত্রটি চেনে না। শুধু মুখায়ব নয়, টিএসসিতে আসা প্রতিটি উচ্ছ্বল তরুণের বুকের মধ্যে রেখে দিতে একজন সঞ্জীব চৌধুরীকে।

সঞ্জীবদের ভুলে গেলে ক্ষতিটা সঞ্জীবদের না, আমাদের।

লেখক: সম্পাদক, বিষমিষ্টি

About the author

নরসুন্দা ডটকম

Leave a Comment