মানুষ- সমাজ

এ ওয়াই এম মাহফুজুর রহমান, বীর বিক্রম

নরসুন্দা ডটকম   ডিসেম্বর ১২, ২০১৬

এ.ওয়াই এম মাহফুজুর রহমান কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলার আচমিতা ইউনিয়নের গনেরগাঁও সরকার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। বাবার নাম মাওলানা সাইদুর রহমান, মা রেহান আরা খাতুন।
তিনি কিশোরগঞ্জ গুরুদয়াল কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজে স্নাতক শ্রেণীতে অধ্যয়নরত অবস্থায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কমিশন পদে যোগদান করেন। জনাব মাহফুজুর রহমান ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অষ্টম ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। এর অবস্থান ছিল চট্টগ্রামের ষোলশহরে। তখন তাঁর পদবি ছিল লেফটেন্যান্ট। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি জীবন বাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়েন সশস্ত্র যুদ্ধে।

হেঁয়াখো খাগড়াছড়ি জেলার মাটিরাঙা উপজেলার অন্তর্গত। রামগড় থেকে ১৬ কিলোমিটার এবং চট্টগ্রাম জেলার ফটিকছড়ি উপজেলা সদর থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে। করেরহাট-রামগড় সড়ক হেঁয়াখোতে এসে উত্তর দিকে বাঁক দিয়ে আবার পূর্ব দিকে গেছে। পাহাড়ি এলাকা।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ভৌগোলিক ও সামরিক দিক থেকে হেঁয়াখো ছিল গুরুত্বপূর্ণ। কাছেই ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত। সেখানে ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সুরক্ষিত একটি ঘাঁটি। মোতায়ন ছিল বিপুলসংখ্যক সেনা ও তাদের সহযোগী।

২৭ জুলাই এ ওয়াই এম মাহফুজুর রহমানের নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা হেঁয়াখোর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ওই ঘাঁটিতে আক্রমণ করে। পাকিস্তানি সেনারা কল্পনাও করেনি মুক্তিযোদ্ধারা সেখানে আক্রমণ করবে। কারণ, হেঁয়াখো বেশ দুর্গম ও মিজো-অধ্যুষিত এলাকা। মিজোরা তাদের সহযোগী।

মুক্তিযোদ্ধা ছিল মাত্র এক প্লাটুন। অন্যদিকে ওই ঘাঁটিতে পাকিস্তানি সেনা সহযোগী (প্রশিক্ষিত মিজো) মিলে ছিল তিন গুণেরও বেশি। প্রায় ১২ মাইল দূর থেকে এসে মুক্তিযোদ্ধারা সেখানে অতর্কিত আক্রমণ চালান। আক্রমণ করামাত্র পাকিস্তানি সেনারাও তৎপর হয়ে ওঠে। তখন সেখানে ২০ মিনিট তুমুল যুদ্ধ হয়। আক্রমণে চারজন পাকিস্তানি সেনা নিহত ও কয়েকজন আহত হয়। সেখানে ছিল সেনাবাহিনীর কয়েকটি গাড়ি। মুক্তিযোদ্ধাদের ছোড়া মর্টারের গোলার আঘাতে বেশির ভাগ গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং একটি সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে যায়।

সেদিনের যুদ্ধে জনাব মাহফুজুর রহমান দলনেতা হিসেবে যথেষ্ট সাহস ও দক্ষতা প্রদর্শন করেন। ওই যুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি সেনা ও মিজোরা মুক্তিযোদ্ধাদের ছোট দলটিকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করে। তখন তিনি সাহসিকতার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করেন। তাঁর তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত ও বুদ্ধিমত্তায় সহযোদ্ধারা চরম বিপর্যয় থেকে রক্ষা পান। পাকিস্তানি ও মিজোদের মতলব বুঝতে পেরে এবং পরিস্থিতির গুরুত্ব উপলব্ধি করে জনাব মাহফুজুর রহমান সঙ্গে সঙ্গে সহযোদ্ধাদের নিয়ে দ্রুত পেছনে হটে যান। এর ফলে কোনো ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদে নিজেদের শিবিরে ফিরে যেতে সক্ষম হন।

প্রতিরোধ যুদ্ধকালে তিনি চট্টগ্রাম ও খাগড়াছড়ি জেলার বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। এর মধ্যে কৃষি ভবনে হামলা, মহালছড়ির যুদ্ধ উল্লেখযোগ্য। প্রতিরোধ যুদ্ধে তাঁর ভূমিকা ছিল অনন্য।

এরপর ভারতে যান। সেখানে সংগঠিত হওয়ার পর তিনি ১ নম্বর সেক্টরে প্রথমে শ্রীনগর এবং পরে মনুঘাট সাব-সেক্টরের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য এ ওয়াই এম মাহফুজুর রহমানকে বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ সনদ নম্বর ১৩।

এ ওয়াই এম মাহফুজুর রহমান স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতেই কর্মরত ছিলেন। ১৯৮১ সালে জিয়া হত্যা (জিয়াউর রহমান বীর উত্তম, তখন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি) ঘটনায় কথিত অভিযোগে তিনি অভিযুক্ত ও মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হন। তখন তাঁর পদবি ছিল লেফটেন্যোন্ট কর্নেল এবং রাষ্ট্রপতির একান্ত সচিব হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

১৯৮০ সালের ২৫ মে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাওয়ার পর পরিবারের সাথে তার কোনো কথা হয়নি। স্ত্রী ছিলেন বিক্রমপুরে। ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসের মর্মান্তিক ঘটনার পর তার সাথে পরিবারের সদস্যদের কোনো যোগাযোগ সম্ভব হয়নি। চট্টগ্রাম কারাগারে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার পর ১৯৮১ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর লে. কর্নেল মাহফুজুর রহমানের মরদেহ চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আনা হয়। পরে বনানী কবরস্থানে দাফন করা হয়।

বিচারের আগে তিনি চট্রগ্রাম জেলে ছিলেন। তখন তাঁর মা রায়হানা আরা খাতুন, স্ত্রী আনোয়ারা মাহফুজ একাধিকবার জেল গেটে সাক্ষাৎ করেন। লে. কর্নেল মাহফুজ সে সময় তাঁর মার পেটে ধরে বলেছিলেন, ‘মা তোমার পেট থেকে জন্ম নিয়েছি, তুমি জেনে রাখো আমি হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে কিছু জানি না। প্রহসনমূলক এক বিচারে লে. কর্নেল এ ওয়াই এম মাহফুজুর রহমানকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। মাহফুজের মা অনেক কষ্ট নিয়ে কিছুদিন বেঁচে থাকার পর মারা যান। তাঁর স্ত্রী আনোয়ারা মাহফুজ চেষ্টা করেও তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তার ও বেগম খালেদা জিয়ার সাথে দেখা করতে ব্যর্থ হন। তিনি বলেন, আমরা বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে বিচারের প্রতিবাদ করেছি। মানববন্ধন, অনশন করেছি। কেউ কর্ণপাত করেনি। পরে অনেকের লেখায় পড়েছি বিচার সঠিক হয়নি।

আনোয়ারা মাহফুজ আরো বলেন, ব্যক্তিগত জীবনে মাহফুজ ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী, সৎ, দক্ষ ও আদর্শবান সেনা কর্মকর্তা। ছিলেন আদর্শ স্বামী ও বাবা। জীবনে মিথ্যাকে পরিহার করে চলতেন। সবসময় মানুষের ভালো দিকটা দেখতেন। চাকরির জন্য অনেক লোক আসতো, কখনো কারো সাথে খারাপ ব্যবহার করতেন না।

তার দৃঢ় বিশ্বাস মাহফুজকে প্রহসনমূলক বিচারে সাজা দেওয়া হয়েছে। এ মানুষটি পৃথিবীতে না থাকার বেদনা গোটা পরিবারকে বিধ্বস্ত করে দিলেও কখনো পরিবারের সদস্যরা কাউকে বুঝতে দেয়নি। মাহফুজ ও আনোয়ারার তিন ছেলে রিদওয়ান রহমান, হরফানুল রহমান, ইমরানুল রহমান সশস্ত্র বাহিনীর তিন বিভাগে কমিশন অফিসার হিসেবে কর্মরত। স্বামী হারা আনোয়ারা মাহফুজ আক্ষেপ করে বলেন, সব আছে, তারপরও কি যেন নেই! এক অদ্ভূত শূণ্যতা মনের মাঝে হাহাকার করে।

 

0022

লেখক: সাইফুল হক মোল্লা দুলু, সাংবাদিক।

About the author

নরসুন্দা ডটকম

Leave a Comment