মানুষ- সমাজ

মো. নূরুল ইসলাম খান পাঠান বীর প্রতীক

নরসুন্দা ডটকম   ডিসেম্বর ১৫, ২০১৬

একাত্তরের ২৬ মার্চ ঢাকায় পাক হানাদার বাহিনীর নৃশংসতম গণহত্যার পর মেজর শফিউল্লাহ জয়দেবপুর থেকে প্রথমে ময়মনসিংহে এবং ৩০ মার্চ তাঁর হেড কোয়ার্টার কিশোরগঞ্জে স্থানান্তর করেন। ১ এপ্রিল ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যদের নিয়ে কিশোরগঞ্জ আজিম উদ্দিন হাইস্কুলে অবস্থান করেন। পরদিন খবর আসে মেজর খালেদ মোশাররফ ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন। তিনি শফিউল্লাহ সাথে কথা বলতে চান। কথা বলার পর পরিকল্পনা নেয়া হয় যুক্তভাবে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-সিলেট অঞ্চল মুক্ত করার। পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য হেড কোয়ার্টার কিশোরগঞ্জ থেকে সিলেটের তেলিয়াপাড়া টি গার্ডেনে ৩ এপ্রিল স্থানান্তর করা হয়। এ সময় কিশোরগঞ্জ থেকে সাহসী কয়েকজন যুবক সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নিতে শফিউল্লাহ সাথে তেলিয়াপাড়ায় চলে যান। এদের মধ্যে অন্যতম হলেন মো. নূরুল ইসলাম খান পাঠান বীর প্রতীক।

তৎকালীন গুরুদয়াল সরকারি কলেজের একাদশ বর্ষের ছাত্র সাহসী নূরুল ইসলাম খান পাঠান বাবা-মা সবাইকে রেখে এভাবেই মুক্তিযুদ্ধে চলে যান। তারপর তেলিয়াপাড়া হয়ে ভারতে। আগরতলার সিমলায় প্রশিক্ষণ। এরপর আসামের ওম্পি নগরে তিন মাস প্রশিক্ষণ শেষে আগস্ট-সেপ্টেম্বর তেলিয়াপাড়ায় মেজর শফিউল্লাহর ৩ নম্বর সেক্টরের অধীনে প্লাটুন কমান্ডার হিসেবে নূরুল ইসলাম খান পাঠান সাথীদের নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে ঝাঁপিয়ে পড়েন।

তেলিয়াপাড়া এলাকায় পাক-হানাদার ও তাদের দোসর রাজাকার-আলবদরদের শক্ত ঘাঁটি ছিল। তাঁর অধীনে ৭০ জনের ছোট দলটি প্রতিদিন ছোট-বড় নানা অপারেশন করে পাক-হানাদারদের বিপর্যস্ত করে তোলে।

একসময় আখাউড়ার চানপুর গ্রামে মুক্তিযোদ্ধারা গড়ে তুলে তাদের শক্ত ঘাঁটি। মাটির বাংকার তৈরি করে শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করে। এ বিষয়টি নজরে আসে পাক হানাদার ও রাজাকারদের। তারা সিদ্ধান্ত নেয় যে কোনোভাবে এবং সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের এই অবস্থান সমূলে ধ্বংস করে নিশ্চিহ্ন করতে হবে।

ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে দেড় শতাধিক পাক সেনা ও রাজাকার গোলাবারুদ ও শক্তিশালী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ভোররাতে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি চানপুর গ্রামে সাঁড়াশি আক্রমণ চালায়। চতুর্মুখী আক্রমণের মুখে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে ঘাঁটিতে অবস্থানকারী মুক্তিযোদ্ধারা। সাঁড়াশি আক্রমণের মুখে অনেকেই পিছু হটে প্রাণ বাঁচায়। কিন্তু নূরুল ইসলাম খান পাঠান ও তাঁর সহযোদ্ধারা জীবনের মায়া ত্যাগ করে প্রাণপণে ঝাঁপিয়ে পড়ে পাক হানাদারদেও ওপর। প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করতে অসংখ্য গ্রেনেড চার্জ কওে তারা পাক হানাদারদের জানান দিতে থাকেন, যুদ্ধ করার মতো পর্যাপ্ত শক্তি, সাহস ও অস্ত্র তাদের রয়েছে। পাক হানাদার বাহিনী তিন দিক থেকে চানপুর গ্রামটি ঘিরে ফেলে। অনেকটাই অসহায় হয়ে পড়ে মুক্তিযোদ্ধা এবং বাংকারে অবস্থান নেয়া সৈন্যরা। রাতে অবস্থা বেগতিক দেখে অনেকেই ক্যাম্প ছেড়ে চলে যায়। কয়েকজন সেনাসদস্য ও ভারতীয় বাহিনীর সদস্যরাও সরে পড়ে। খবর পেয়ে মেজর মতিন (বর্তমানে মেজর জেনারেল আবদুল মতিন) ডিসেম্বরের ৩ তারিখ রাতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করে রাতের অন্ধকারে চানপুর ক্যাম্পে পাঠান।

পরদিন সকাল থেকে জীবন বাজি রেখে মুক্তিযোদ্ধারা আবারো রক্ষণাত্মক (ডিফেন্স) অবস্থান থেকে পাকসেনাদের আক্রমণের জবাব দিতে থাকেন। পাকসেনারা অতি আত্মবিশ্বাসী হয়ে আক্রমণ কিছুটা কমিয়ে আনার সাথে সাথে মুক্তিযোদ্ধারা বাংকার থেকে বের হয়ে গ্রেনেড হামলা ও রাইফেলের গুলি বৃষ্টির মতো ছুড়তে ছুড়তে এগিয়ে যেতে থাকে। নূরুল ইসলাম খান পাঠানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের অগ্রবর্তী দলটি গ্রেনেড চার্জ করে এগিয়ে যেতে থাকে। পাকসেনাদের সাথে সামনাসামনি যুদ্ধে অবতীর্ণ হয় মুক্তিযোদ্ধাদের দলটি। এক পর্যায়ে সাঁড়াশি গ্রেনেড হামলায় কয়েকজন পাক সেনা মারা যায়। এ পর্যায়ে পক হানাদার বাহিনী পিছু হটে বাংকারে আশ্রয় নেয়।

এ অবস্থায় নুরুল ইসলাম খান পাঠান গ্রেনেড নিয়ে একাকী এগিয়ে যান পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে। গ্রেনেড চার্জ করতে করতে তিনি চলে যান পাক সেনাদের সীমানার কাছে। তারপর তিনি পাক সেনাদের বাংকারে দুটি গ্রেনেড চার্জ করেন। এতে ১০-১২ জন পাক সেনার মৃত্যু হয়। তাঁর এই সাহসী ভূমিকা দেখে চানপুর গ্রামের সহযোদ্ধারা চারদিক থেকে পাকসেনা ও রাজাকারদের ঘিরে ফেলে। কিছু পাকসেনা পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। ৫০-৬০ জন পাকসেনা ও রাজাকার মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে বন্দি হয়। ৪ ডিসেম্বর সারা এলাকা শত্র“মুক্ত হয়।

মুক্তিযুদ্ধে এই বীরত্ব ও সাহসিকতার জন্য দেশ স্বাধীন হলে বাংলাদেশে সরকার মো. নূরুল ইসলাম খান পাঠানকে স্বীকৃতি হিসেবে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করেন।

নূরুল ইসলাম খান পাঠান বজ্রকণ্ঠের অধিকারী। স্বাধীনতার পর তিনি ভালো সরকারি চাকরি পেলেও যোগদান করেননি। দেশেকে ভালোবেসে দেশসেবায় কাজ করবেন বলে ভেবেছিলেন। তিনি স্বাধীনতার পর জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদে একাধিকবার জেলা কমান্ডার ও ডেপুটি কমান্ডার হিসেবে কাজ করেছেন। গত প্রায় দেড় দশক ধরে তিনি বার্ধক্যজনিত রোগে আক্রান্ত। তার সুচিকিৎসার প্রয়োজন। বর্তমানে কিশোরগঞ্জ শহরের উকিলপাড়ায় অধ্যাপক আলী হোসেনের (বোনের বাড়িতে) আশ্রিত থেকে চিকিৎসা করাচ্ছেন। তাঁর চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করার ক্ষমতা তাদের নেই। প্রয়াত জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান ছাড়াও বর্তমানন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদসহ শীর্ষ নেতারা তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে চেনেন। কিন্তু এই দুঃসময়ে কেউ তেমনভাবে তাঁর খোঁজখবর করেন না।

তাঁর চাচা আবু তাহের খান পাঠান কিশোরগঞ্জে ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন। ষাট দশকে কিশোরগঞ্জের প্রধান নেতা হিসেবে তাঁর জ্বালাময়ী বক্তব্য ও কর্মকাণ্ড পরিবারটির রাজনৈতিক ঐতিহ্যের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান হিসেবে নূরুল ইসলাম খান পাঠান বীর প্রতীক দেশের জন্য কিছু করতে চেয়েছিলেন। দুর্ভাগ্য তিনি তা পারেননি।

নূরুল ইসলাম খান পাঠান জানান, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ভালো চালাচ্ছেন। তবে দুঃখ, রাজাকারদের বিচার এখনো বাংলার মাটিতে সম্পন্ন হয়নি। তিনি বলেন, জীবদ্দশায় রাজাকারদের বিচারের রায় কার্যকর দেখতে চাই। কিছু পাবার জন্য যুদ্ধ করিনি। তবে আবার এমন বাংলাদেশ দেখতে হবে তাও প্রত্যাশা করিনি। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার দেখতে পেরে শান্তি পেয়েছি। চার নেতা হত্যা ও রাজাকারদের বিচার দেখে মরতে চাই।

নূরুল ইসলাম খান পাঠানের মা রাবেয়া আক্তার খাতুন বাবা আব্দুস সাত্তার খান পাঠান। তাঁর বাড়ি কিশোরগঞ্জ শহরের খরমপট্টি এলাকায়। তিনি এক ছেলে ও এক মেয়ের জনক। ছেলে-মেয়ে দুজনেই স্তনাক শ্রেণীর শিক্ষার্থী।

 

0022

লেখক: সাইফুল হক মোল্লা দুলু, সাংবাদিক।

About the author

নরসুন্দা ডটকম

Leave a Comment