দেশ-বিদেশ

অ্যান্টার্কটিকায় সমুদ্রের তলদেশে বরফ গলছে পাঁচগুণ বেশি, মহাবিপর্যয়ের শঙ্কা

নরসুন্দা ডটকম   এপ্রিল ৯, ২০১৮
অ্যান্টার্কটিকার সমুদ্রের তলদেশে বরফ গলছে

পৃথিবীর দক্ষিণ মেরু অঞ্চল অ্যান্টার্কটিকায় সমুদ্রের তলদেশে বরফ গলার হার প্রতি ২০ বছরে দ্বিগুণ হচ্ছে; যা পূর্ব ধারণার চেয়ে অনেক বেশি। মেরু অঞ্চল নিয়ে গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পোলার অবজারভেশন অ্যান্ড মডেলিং-এর নতুন এক গবেষণা প্রতিবেদনকে উদ্ধৃত করে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান এই খবর দিয়েছে। একই প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে মার্কিন সংবাদমাধ্যম ইউএস ডেইলি নিউজ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস জানিয়েছে, অ্যান্টার্কটিকার বরফ গলার এই হার স্বাভাবিকের চেয়ে ৫ গুণ। এতে ঢাকার মতো শহরগুলোর ঝুঁকি আরও দ্রুতগামী হবে। ত্বরান্তিত হবে বন্যায় জলবায়ু উদ্বাস্তুকরণের ঝুঁকি। নিজস্ব বিশ্লেষকদের উদ্ধৃত করে দ্য ইন্ডিপেনডেন্ট বলছে, হিমবাহের দ্রুত গতির এই গলনে শতাব্দীর শেষ নাগাদ সরাসরি জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার হওয়া মানুষের সংখ্যা দাঁড়াবে একশ কোটিরও বেশি।

বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে মেরু প্রান্তের বরফগুলো দ্রুত গলছে বলে বার বারই সতর্ক করে আসছেন বিজ্ঞানীরা। মার্কিন বার্তা সংস্থা এপি জানিয়েছে, ১৯৭৬ সালের পরবর্তী কোনও বছরই শীতলতম উপাধি পায়নি। তাপমাত্রা পর্যবেক্ষণ কর্মসূচি বার্কেলি আর্থ-এর বিশেষজ্ঞ জেকে হাউসফাদার এপিকে বলেন, ‘গত ৫০ বছরে বিশ্ব ধীরে ধীরে উষ্ণ হচ্ছে। ১৮৫০ এর দশক এর পর থেকে রাখা রেকর্ড অনুযায়ী, গত ১৮ বছরের মধ্যে ১৭টি বছরই উষ্ণতম আখ্যা পেয়েছে।’ সমুদ্রপৃষ্ঠের উপরিভাগের পানির উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে এমনটা হচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে তা সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির দিক দিয়ে গ্রিনল্যান্ডের মাত্রাকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

চলতি সপ্তাহে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের খবরে অ্যান্টার্কটিকায় বরফ গলা নিয়ে নতুন একটি গবেষণা প্রতিবেদনের ফলাফল হাজির করা হয়। ইউকে সেন্টার ফর পোলার অবজারভেশন অ্যান্ড মডেলিং ওই গবেষণা কর্ম সম্পন্ন করেছে। নেচার জিওসায়েন্সে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, পানির উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে ২০১০-২০১৬ সাল পর্যন্ত দক্ষিণ মেরুর কাছাকাছি সাগরের তলদেশে থাকা বরফগুলো ১,৪৬৩ বর্গ কিলোমিটার সংকুচিত হয়েছে; যার আয়তনের দিক দিয়ে গ্রেটার লন্ডনের সমান। ইউকে সেন্টার ফর পোলার অবজারভেশন অ্যান্ড মডেলিং মনে করছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অ্যান্টার্কটিকার উপর আগের চেয়ে বেশি প্রভাব পড়ছে। সেকারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি নিয়ে বৈশ্বিক পর্যায়ে যে আভাস রয়েছে তা পাল্টে আগের চেয়ে আরও বাড়ানোর প্রয়োজন হতে পারে।

উত্তর অ্যান্টার্কটিকার

উত্তর অ্যান্টার্কটিকার সমুদ্রের তলদেশে বরফ গলছে পাঁচগুণেরও বেশি

পূর্ব অ্যান্টার্কটিকা, যেখানে ভূপষ্ঠে বরফের পরিমাণ বাড়ছে বলে অনেক বিজ্ঞানী দাবি করে থাকেন; সেখানেও পানির তলদেশে থাকা বরফকে বিবেচনায় নিলে হিমবাহ অপসৃতের হার বেশি। গবেষক শেপার্ড মনে করেন, ‘এতে লোকজনের উদ্বিগ্ন হওয়া প্রয়োজন।’ তিনি বলেন, ‘এখন আমরা বিস্তীর্ণ বরফ খণ্ডের সমগ্র প্রান্তের মানচিত্র তৈরি করেছি। সে অনুযায়ী বলা যায়, অ্যান্টার্কটিকার অবস্থার আংশিক অগ্রগতি হওয়ার কোনও সুযোগ নেই। আমরা আরও কিছু জায়গায় হিমবাহ বেশি গতিতে অপসৃত হতে দেখেছি এবং অন্যত্র তা কম হতে দেখেছি। কমা-বাড়ার তুলনা করে নীট প্রভাব হিসেব করতে গেলে বলা যায় সর্বোপরি বিস্তীর্ণ বরফ খণ্ডের ক্ষয় হচ্ছে। লোকজন বলতে পারবে না কোনও কিছু বাদ দেওয়া হয়েছে। আমরা এবার সব জায়গা খেয়াল করেছি।’

গার্ডিয়ানের প্রাতবেদনে বলা হয়, এর মধ্য দিয়ে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি নিয়ে দেওয়া আভাসগুলো পরিবর্তন করতে হবে। ১০ বছর আগে এক্ষেত্রে মুখ্য চালক ছিল গ্রীনল্যান্ড। খুব সম্প্রতি অ্যান্টার্কটিকার বরফ গলা নিয়ে আগের হিসেব পরিবর্তন করে তা বাড়িয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় গঠিত আন্তঃ রাষ্ট্রীয় প্যানেল। ২১০০ সাল পর্যন্ত সময়কে বিবেচনায় নিয়ে তাদের সবশেষ মূল্যায়নে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাবৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে। আইপিসিসির পঞ্চম ওই মূল্যায়ন অনুযায়ী ২১০০ সাল নাগাদ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ৫ থেকে ১০ ভাগ বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়।

সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে গেলে সম্ভাব্য পরিণতি কী হতে পারে তা নিয়ে পূর্ববর্তী গবেষণাগুলোতে আগেই সতর্ক করা হয়েছিল। ২০১৬ সালের এক গবেষণায় আশঙ্কা প্রকাশ করে বলা হয়, ২১০০ সাল নাগাদ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ৬ ফুট বেড়ে যেতে পারে, এর কারণে যুক্তরাষ্ট্রের ১ কোটি ৩০ লাখ মানুষ বন্যার কবলে পড়তে পারেন। ফ্লোরিডার ৬০ লাখ এবং লুইজিয়ানা অঙ্গরাজ্য ও ক্যালিফোনিয়া অঙ্গরাজ্যের ১০ লাখ করে বাসিন্দা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির প্রভাব নিয়ে ২০১৭ সালে করা এক গবেষণায় দেখা গেছে হাজারো ঐতিহাসিক এলাকা তলিয়ে যেতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে, সমাধি ক্ষেত্র, মহাকাশ যান উৎক্ষেপণ কেন্দ্র এবং প্রাচীন বসতিগুলো। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে গাছপালা এবং প্রাণীর আবাসস্থলগুলো ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।

হিমবাহের দ্রুত গতির গলনে সমুদ্রপৃষ্ঠের ধারণাতীত উচ্চতা বৃদ্ধির আশঙ্কায় হুমকি বেড়েছে উপকূলীয় শহর এবং দ্বীপ রাষ্ট্রগুলোর। গবেষণা দলের প্রধান হানেস কনরাড বলেন, বিজ্ঞানীরা যদি সাগরকে শীতলও রাখতে পারেন তারপরও হিমবাহকে স্থিতিশীল করা সম্ভব হবে না। বেশকিছু দ্বীপ হারিয়ে যাবে পৃথিবী থেকে। বড় বড় শহরগুলোর ঝুঁকি বৃদ্ধির কথা জানিয়েছেন কনরাড। ‘পশ্চিম অ্যান্টার্কটিকার কারণে বিশ্বের সমুদ্রগুলোর পানির উচ্চতা আরও সাড়ে চার মিটার বেড়ে যেতে পারে। তাহলে ভেবে দেখুনতো, লন্ডনের মতো সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এ উচ্চতায় থাকা শহরগুলোর পরিণতি কী হবে।’ বলেন কনরাড। ইউএস ডেইলি নিউজ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস কনরাডের বক্তব্যের সূত্রে বলছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে নিউ অরলিন্স, জাকার্তা, ঢাকা, ব্যাংকক এবং হো চি মিন সিটির মতো বড় উপকূলীয় শহরগুলোও পানিতে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

About the author

নরসুন্দা ডটকম