বই আলোচনা

খালেদ হামিদী’র আকব্জিআঙুল নদীকূল নিয়ে লিখেছেন-সৈয়দ কামরুল হাসান

নরসুন্দা ডটকম   এপ্রিল ৯, ২০১৮
আকব্জিআঙুল নদীকূল

বছর দুয়েকের কিছু বেশীই হবে। আমার খুব সুহৃদ,পরিশ্রমী প্রাবন্ধিক এক বন্ধু এক সন্ধ্যাবেলায় বইটি আমার হাতে দিয়ে কিছু লেখার অনুরোধ করেছিলেন । তিনি তাঁর সম্পাদিত একটি প্রবন্ধ পত্রিকায় তা ছাপবেন বলে আমাকে জানিয়ে রাখলেন। অনিয়মিত হলেও তাঁর সম্পাদিত পত্রিকাটি গুরুত্বপূর্ণ ছিল্ । লেখা জমা দিয়ে বেশ অনেকদিন হয়ে গেল । সম্পাদকের সাথেও কথা হলো টেলিফোনে ২/১ বার। পরে পত্রিকাটি আর চোখে পড়লো না । একদিন জানতে পেলাম সম্পাদক সপরিবারে বিদেশে থিতু হয়েছেন- এতদিনে তাঁর অভিবাসন প্রক্রিয়া সমাপ্ত হয়েছে । যাহোক,অনুজপ্রতীম বন্ধুর শুভকামনা করে তাঁর অনুমতি না নিয়েই লেখাটি অন্তর্জালে ছড়িয়ে দিলাম ।

আকব্জিআঙুল  নদীকূল । রচয়িতা: খালেদ হামিদী । প্রকৃতি থেকে প্রকাশিত মাএ ৯টি গল্পের সমাবেশে ৭০ পৃষ্ঠার একটি স্বল্পায়তনের সংকলন। গল্পকার হিসেবে খালেদ হামিদীর নাম কারুর আলোচনায় এসেছে বলে মনে পড়ছে না । এই পরিণত বয়সে প্রাত্যাহিক ব্যস্ততায় সময় বাঁচিয়ে যখন কিনা নিজ পড়াশোনা কেবলমাএ বাছাই-করা লেখকদের রচনায় সীমিত করে এনেছি; অর্থ্যাৎ দেশে ও বিদেশে যাদের রচনা একেবারেই না পড়লেই নয় তাদের চৌহদ্দিতে-তখন এক সন্ধ্যাবেলা অন্তরঙ্গ বন্ধু দরোজায় কড়া নেড়ে বইটি হাতে গছিয়ে দিয়েছিলেন: “পড়েই দেখুন না একবার” ! বইয়ের ফ্ল্যাপে আমাদের পরিচিত বিশিষ্ট এক কথাসাহিত্যিক লিখেছেন গল্পগুলির প্রশংসা করে লিখেছেন :“এসব গল্প আমাদের কথাসাহিত্যে একেবারেই অন্য পৃথিবীর আগন্তক । “আকব্জিআঙুল নদীকূল” গল্পের সমতু্ল্য গল্প তো দ্বিতীয়টি লেখা হয়নি এ ভূখন্ডে। একজন ভাবুক,দূরদর্শী শিল্পীই হতে পারেন এমন পরিব্রাজক।”  কী আছে ক্ষুদ্রায়তনের এই গল্পগ্রন্থে ? দেখা যাচ্ছে, শেষ ২টি গল্প বাদ দিলে,গ্রন্থের অবশিষ্ট ৭টি গল্পে লেখক কাহিনীর সংস্থাপন ঘটিয়েছেন সৌদি আরবের পটভূমিকায়।

বাংলাদেশ থেকে বেকার জীবনের অভিশাপ ঘোচাতে স্বপ্নের মুসলিম দেশ সৌদি আরবে পাড়ি দেওয়া শ্রমজীবিদের সংকট ও স্বপ্নভংগ গল্প ক’টির মূল উপাদান। গল্পগুলিতে স্থান-করে-নেওয়া চরিএগুলি সাধারণভাবে প্রবাসজীবনের অনিশ্চয়তা,আশ্রয়হীনতা ও মানবিক সংকটের শিকার।এই পরিস্থিতিকে স্পষ্ট ও বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে গল্পে চরিএগুলির সামাজিক,পারিবারিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট যেমন রয়েছে,তেমনি রয়েছে সৌদি আরবের রাষ্ট্রব্যবস্থা ও আইনী কাঠামোর নানান ফাঁকফোকর,সামাজিক,নৈতিক ও পারিবারিক মূল্যবোধের বিচিএ অবক্ষয়। ‘সম্পর্ক’ ও ‘লা হাওলা ওয়ালা কুয়াতা’ গল্পে অনিশ্চয়তায় ভরা(প্রধানত: জীবিকাকেন্দ্রিক) প্রবাসজীবনের সাধারণ চিএ,‘কুয়োপাড়ে উষ্মায়’ গেইজম(যা আরববিশ্বে অস্বীকৃত,কিন্তু বহুচর্চিত),আরবে মার্কিনী উপস্থিতি ও আরবীয়দের তোষামুদে দেউলিয়াপনা,‘শিরশ্ছেদে’ সৌদি শাসনব্যবস্থা ও আইনের নিষ্ঠুরতা পরিস্ফুটনের প্রয়াস রয়েছে। গ্রন্থের শেষ ২টি গল্প সম্পূর্ণ বাংলাদেশী প্রেক্ষাপটে রচিত। শেষ গল্পটির মূল প্রেরণা একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ।
২.
লেখক হিসেবে খালেদ হামিদীর বৈশিষ্ট্যের কথা বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হয় গল্পের পটভূমি নির্বাচনে তাঁর সচেতন প্রয়াসের কথা। নিশ্চিত যে,নিজ জীবিকাসূএে সৌদি আরবে অবস্থান এ-ক্ষেএে তাঁকে বাড়তি সুবিধা দিয়েছে। ফলে গল্পের পটভূমি,এমনকি বিষয়বস্তু নির্বাচনেও প্রচলিত গল্পকারদের থেকে নিজকে তিনি অনেকখানি পৃথক রাখতে পেরেছেন। এ-ক্ষেএে আমাদের গল্প সাহিত্যের সীমানা যে প্রসারিত হয়েছে সে-কথা আমি বলছি না ( সাহিত্যের সীমানা প্রসারণে নিশ্চয়ই আরো নানাবিধ বৈশিষ্ট্য বিবেচ্য)। তবে ভিন্ন প্রেক্ষাপটে স্বজাতির কিছু মানুষকে পাএ পাএী হিসাবে হাজির করে সাহিত্য রচনার সাহস ও কৃতিত্ব তাঁর প্রাপ্য। আরও একটি বিশেষ দিক রয়েছে তার লেখায় – তাঁর প্রখর সমাজবাস্তবতাবোধ। উষর মরুপ্রান্তরে বাংলাদেশের শ্রমজীবিদের নিয়ে গিয়ে তিনি তাদের প্রাত্যাহিক দিনযাপনের নির্মম ও অমানুষিক বাস্তবতাকে উন্মোচনের প্রয়াস পেয়েছেন । তাঁর গল্পের পাএপাএীরা এ-দেশীয় নির্মমতা থেকে উঠে গিয়ে যেন আরো বৃহৎ,আরো অনিশ্চিত গহ্বরে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। এক হিসেবে মানুষগুলির জীবন ছারখার হয়ে গেছে,ফেরার পথ তাদের রুদ্ধ;যে ২/১ জন পেরেছে ফিরে আসতে।

যেমন ‘শিরশ্ছেদ’ গল্পে: “ টিনশেডের সেমি-পাকা নন-এসি কয়েদখানায় তিন মাস রাখার পর পুলিশ তাকে এক রাতে ঢাকাগামী ফ্লাইটে তুলে দেয় সরকারী খরচেই! অতীতের সদা হাস্যোজ্বল,ফর্সা রহমান দেশে ফেরে জীবন্ত ঘোর কালো কঙ্কাল হয়ে ।” এই সমাজবাস্তবতা বোধ তাঁর লেখায় আরো পোক্ত হয় চরিএানুগ অনুষঙ্গ বাছাই ও তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণের মুন্সীয়ানায় । শেষ পর্যন্ত মানুষগুলির জন্য আস্থার কোন জায়গাই আর অবশিষ্ট থাকেনা;থাকেনা দাঁড়ানোর জন্য খানিকটা মাটি। “আকব্জিআঙুল নদীকূল” গল্পের পাক বাহিনী কর্তৃক ধর্ষিতা প্রবাসে স্বামীগৃহে গণিকাবৃত্তিতে নিয়োজিত দিলশাদের জীবনের শেষ গতি কি হবে ,সেই প্রশ্নের জওয়াব না পাঠকের,না লেখকের কারুরই জানা নাই ।
গল্পের বুননে খালেদ হামিদী বাঁধা ছক অনুসরণ করেছেন। তাঁর প্রতিটি গল্পই গল্পের বাঁধা ছক অনুসরণ করে । অর্থ্যাৎ এক একটি ঘটনা ও ঘটনাকে ঘিরে আবর্তিত হয় কয়েকজন পাএপাএী – প্রতিটি ঘটনার থাকে একটি যাএা বিন্দু,অত:পর ঘটনাপ্রবাহের বিস্তার,কার্যকারণ/পারম্পর্য,শীর্ষবিন্দু বা ক্লাইমেক্স ,সবশেষে পরিণতি। গল্প বয়ানের এই বাঁধা ছক পাঠককে আটকে রাখে। স্বাভাবিক নিয়মে কাহিনী/ঘটনা ক্রমে জমাট বাঁধে আর তীব্র গতিতে পাঠককে নিয়ে পরিণতির দিকে ধাবিত হয় । অন্যূন দুই দশক আগে,আমাদের একজন বরেণ্য কথাসাহিত্যিক “বাংলা ছোট গল্প কি মরে যাচ্ছে?”-শীর্ষক নিবন্ধ লিখে তাঁর আশংকার কথা জানিয়েছিলেন । তাঁর আশংকা যে এই বইয়ের বেলায় প্রযোজ্য নয় অন্ত:ত এটুকু বলা যায় ।
৩.
এই প্রশ্ন উঠতেই পারে যে একটি ঘটনাকে কেন্দ্র ধরে নিয়ে পাঠককে জমাট গল্প বলার দায় গল্পকারের আছে কিনা, থাকলে কতটুকু? এই প্রবণতা খালেদ হামিদীর সক্ষমতার সূচক হলেও এতেই যেন নিহিত তাঁর দুর্বলতাও।একটি ঘটনাকে নির্ধারিত পরিণতি দেওয়ার তাড়নায় তিনি কাহিনীকে নিজের খুশীমত কাটছাঁট করেন,চরিএগুলোর মুখে সংলাপ বসান এবং শেষাবধি তাদেরকে এমনভাবে নিজের ইচ্ছাপূরণের ক্রীড়নকে পরিণত করেন যে এগুলি আর অসহায় মানব মানবীর আখ্যান থাকে না; কতকটা খালেদ হামিদীর ইচ্ছাপূরণের গল্প হয়ে দাঁড়ায়। যে সমাজ,সংস্কৃতি,শিক্ষা ও রাজনৈতিক পটভূমি থেকে উঠে গিয়ে তাঁর পাএপাএীরা সম্পূর্ণ নতুন (এমনকি একেবারে বিপরীত) সংস্কৃতি ও ব্যবস্থার মুখোমুখি হয় তাতে তাদের মনোজগতের কোথায় কোথায় চিড় ধরেছে,তাতে কিভাবে পরিবর্তন আসছে ,কিভাবেই বা আত্মীকরণ ঘটছে তার-এই মনোবিশ্লেষণ পাএপাএীদের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে পাবার যে প্রত্যাশা পাঠকের মনে জাগে শেষ পর্যন্ত তা আর মেটেনা ।

বাংলাদেশ মুসলিমপ্রধান (উদারপন্থী) এবং যেহেতু এই ভূখন্ডে প্রচারিত ইসলামের উৎসভূমি বহুলাংশে সৌদি আরব,সুতরাং আরবীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সম্পর্কে একটা মিথ আমাদের জনগোষ্ঠীর মানসপটে তো এমনিতেই আছে । ।এখন প্রত্যক্ষ সংস্পর্শলাভের সুযোগে,বাস্তব পরিস্থিতিতে কিভাবে তার সংগে সংঘর্ষ ও সংশ্লেষ ঘটছে সেই বিবরণী পাএপাএীদের জীবনবৃত্তান্তে পাওয়া যায় না । বস্তুত:পক্ষে একজন লেখকের পক্ষে এই প্রক্রিয়াকে সাহিত্যের মধ্যে ধারণ করা (এমনকি তাকে পুনর্গঠন করা) সত্যিই চ্যালেঞ্জ বটে । একমাএ তখুনি বোধ হয় সাহিত্যের সীমা প্রসারিত হওয়ার কথাটি আমলে আনা যায় !

৪.
সৌদি মিথের সংগে অনিবার্য সংঘাতে না জড়িয়ে,প্রকারান্তরে,কাহিনী ও চরিএগুলোকে নিজের মনোমত ছাঁচে রূপ দিতে গিয়ে লেখক বেছে বেছে তাঁদের মুখে সংলাপ,মন্তব্য ও সমালোচনা জুড়ে দিয়েছেন । গোটা বই জুড়ে তাই পাঠক পাচ্ছেন সৌদি আইনের কূপমন্ডুকতা ও নিষ্ঠুরতা নিয়ে,আরবীয়দের ব্যবহারিক জীবনের অসংযম,মার্কিনী আগ্রাসন ও সর্বোপরি মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের জনশক্তির বাজার বিষয়ে লেখকের বাছা বাছা পাঠসুখকর স্তবক। যে মিথের অনেকটাই ধর্মীয় ,সেই প্রশ্নে বইটি প্রায় নিশ্চুপ ; সামান্য ২/১টি প্রশ্ন আছে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালন বিষয়ে। বিশ্লেষণ তথা মনোবিশ্লেষণ একেবারেই নেই সে-কথা বলা যাবে না। তবে তা যতটা না নৈর্ব্যক্তিক,তারও চেয়ে বেশি ব্যক্তিগত;উপরন্ত তার ধাঁচ ও মোক্ষ অনেকটা কাব্যিক। পাঠকের মনে হতে পারে,গল্পের পাএ পাএীরা নয়,এই কথাগুলি লেখক নিজে যেন বলবার চেষ্টা করেছেন। বলা হয়ে গেলে (উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়ে গেলে),তাঁর আর কিছুই করার নাই এবং তাঁর আজ্ঞাবহ বিধায়,তাঁর পাএ পাএীদেরও আর কিছু করার নাই। হয়তো বা এ-কারণে(না ও হতে পারে) কোন কোন গল্প ২-৩ পৃষ্ঠায় শেষ হয়ে গেছে;অর্থ্যাৎ সেইগুলি পড়িমরি করে ছুটে গেছে নির্ধারিত গন্তব্যের দিকে । ফলত: পাঠকের কাছে অনেকটাই অগম্য থেকে গেছে সৌদি সমাজজীবনের অজানা আখ্যান।
ইসলামের উৎসস্থল পুণ্যভূমি আরব সম্পর্কে আমাদের মনোজগতে পুরুষানুক্রমে প্রাপ্ত যে-ছবি তাকে চ্যালেঞ্জ করতে গিয়ে ভিন্ন কৌশল হিসেবে প্রায় সব ক’টি গল্পে যৌনতা আমদানী করে লেখক হয়তোবা “লিঙ্গ ও উদরসর্বস্ব” বর্তমান সৌদি আরবকে চিএিত করার প্রয়াস পেয়েছেন। হয়তোবা সরাসরি না বলে,ঘটনার সন্নিবেশে পুণ্যভূমি সংক্রান্ত আমাদের অভ্যস্ত মনোজগতে একটা ধাক্কা দিতে চেয়েছেন তিনি । গ্রন্থে উন্মোচিত সৌদি চরিএগুলি আর মানুষ হিসাবে দাঁড়ায় না । কেন না গল্পে ব্যবহৃত সৌদি চরিএগুলি (বিশেষত:নারী চরিএগুলি) কে তিনি কেবলমাএ যৌনতার উপাদান হিসাবে কাজে লাগিয়েছেন। দেখা যায়,গল্পগ্রন্থে চিএিত প্রায় সব সৌদি নাগরিকই – পুরুষরা গেইজমে আসক্ত ও বহুগামী,অন্যদিকে “মা ও ঝি”-রা চাকরের সঙ্গ(ম)সুখে নিরত। এমনকি বইয়ের সবচেয়ে যৌন-উদ্দীপক গল্প “ফি নারে জাহান্নামা”য় যে ২ অ-সৌদিয় টিন এজার(এমি ও ডনা) কে দেখানো হয়েছে তারা যেন সরাসরি পর্ণোগ্রাফি থেকে উঠে এসেছে । তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নিই যে,“পর্দার আড়ালে খেমটা নাচা” বর্তমান সৌদি আরবকে বেআবরু করতে গিয়ে কৌশল হিসেবে লেখক যৌনতা আমদানী করেছেন,তবুও কাটপীসের ঢংয়ে জুড়ে দেওয়া যৌন সংগম দৃশ্য,তার স্থিতিকাল,পাএপাএীদের যৌনাঙ্গের অনুপুংখ বর্ণনা,এমনকি তাদের রং কি,সাইজ কত ইত্যাকার বিবরণী কতটা গল্পের গুণ ও গুরুত্ব বৃদ্ধি করেছে আল্লাহ মালুম! এই পরিস্থিতি বর্তমান সৌদি সমাজব্যবস্থায় বাস্তব হলেও “লাজুক” বাংগালী পাঠকের কাছে এর এমনধারা বিবরণী বাড়াবাড়ি মনে হতে পারে । মনে রাখতে চাই ,বাংলা গল্পকে খোলামেলা যৌনতায় পৌঁছুতে অনেক দিন অপেক্ষা করতে হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ পারেননি । মানিক বন্দোপাধ্যায়ের মত কিংবদন্তী লেখক,যাঁর প্রধান উপন্যাসগুলি মূলত: তৎকালীন সমাজ বিধি-বহির্ভূত সম্পর্ক নিয়ে আবর্তিত,সেখানেও কুবের ও কপিলা(পদ্মানদীর মাঝি),শশী ও কুসুম(পুতুল নাচের ইতিকথা),সদানন্দ-মাধবীলতা(অহিংসা),রাজকুমার ও তার চার বান্ধবী(চতুষ্কোন)-র মধ্যে শারীরিক সংযোগ দেখানো সম্ভব হয়নি। সেইসব মানব মানবীর মনস্তাপ ও দেহজ উত্তাপ একালের পাঠককে আজো ছুঁয়ে যায়;কিন্তু তাই বলে মানিক সাহিত্যের অত্যাশ্চর্য শিল্পগুন আজো কি ম্লান হয়েছে এতটুকু! আরও একটা কথা:বলিহারী আমাদের হীনবল দরিদ্র শ্রমজীবিরাও কী করে সেখানে গিয়ে মাএ কয়েক মাসে/২-১ বছরে নিজ জড়তা,আড়ষ্টতা ও সংস্কার ঝেড়ে ফেলে দিয়ে অমন অবলীলায় (দিলদার/ফি নারে জাহান্নামা) উপগত হতে পারে সে ও একটা চমকপ্রদ প্রশ্ন বটে। কবুল করছি,৯টির মধ্যে বইয়ের একটি মাএ গল্প রগরগে যৌনক্রিয়া থেকে রেহাই পেয়েছে !
এবার লিপিকুশলতা সম্পর্কে ২/১টি কথা। কথাসাহিত্য যে অনেকাংশে উপযুক্ত শব্দ প্রয়োগ ও ভাষারীতি সহযোগে ক্রমবিকাশমান এক শিল্প তার সজ্জা ও পরিপাট্যের দিকে মনোযোগী হওয়ার দায় কি একজন কথাশিল্পী এড়াতে পারেন ? এই গ্রন্থের ভাষা,বাক্যরীতি ও বিবরণভংগী কোন কোন পাঠকের কাছে আড়ষ্ট মনে হতে পারে,কেউ কেউ এতে খুঁজে পেতে পারেন অযাচিত কাব্যিকতা কিংবা প্রতীকীকরনের কষ্টকর প্রয়াস আবার কারুর কাছে মনে হতে পারে অতিসংক্ষিপ্তকরণের দোষে দুষ্ট।এতে বইটি পাঠে আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে পারেন পাঠক। অভিজ্ঞ,পাঁড় কোনও পাঠক এমনও ভাবতে পারেন : ঠিক একই বিষয ও আখ্যান অমর লিপিকুশলী মাহমুদুল হকের হাতে পড়লে কেমন হতো ?
৫.
আলোচনার এক জায়গায় যে লিখেছিলাম গ্রন্থের মানুষগুলি কোথাও(দুনিয়ার কোথাও!) দাঁড়াবার মাটি পায় না-এ-কথা ঠিক নয় । গ্রন্থের শেষ গল্প “অনার্যর দৌড়”-এ এসে মেলে বুঝি মাটি,আপন ঠিকানা। অসাধারণ কাহিনীনির্ভর এই গল্পে এক কিশোর স্কুলবালক “অনার্য” মুক্তিযুদ্ধে শহীদ তার ফুফুর রক্তমাখা পোশাককে পতাকা বানিয়ে বেরিয়ে পড়ে বিজয় দিবসের ভোরে । সেই সাথে ঝরে পড়ে তার আজন্মলালিত ভয় ও কুণ্ঠা । “নিজেকে সে এই প্রথমবার ভিন্নরূপে ফিরে পায় । দৌড়ে আপন মহল্লায় ফিরে এসে একইভাবে ছুটে যায় অন্যদিকে। ফুফুর শার্ট বাতাসে পতপত ওড়ে”(শেষ পৃষ্ঠা)।
এইখানে এসে লেখক নিজেকেও যেন ফিরে পান। স্বীকার করতেই হবে দেশপ্রেম খালেদ হামিদীর সবচেয়ে বড় সম্পদ। প্রতিটি গল্পই তিনি দেশপ্রেমের অমল ধবল মায়ায় মুড়িয়ে দিয়েছেন। আর রয়েছে তাঁর অসাধারণ সমাজমনস্কতা ও বাস্তবতাবোধ; জানা আছে উপযুক্ত ঘটনা বাছাই ও তাকে গল্পে রূপ দেবার কৌশল। একজন লেখকের এইতো সম্পদ।
বাংলা গদ্যের ভূবনে খালেদ হামিদীকে স্বাগতম।

সৈয়দ কামরুল হাসান

সৈয়দ কামরুল হাসানলেখক, গল্পকার।

About the author

নরসুন্দা ডটকম