কবিতা গল্প

শ্যামা চক্রবর্তীর ছোট গল্প

Md. Sohel Ahmed Khan   মে ৪, ২০১৮

অন্ধকার শেষে আলোর গল্প

-শ্যামা চক্রবর্তী

 

হুমায়ুন গাড়ি পরিষ্কার করছিল, ডিটারজেন্টের পানি গাড়ির আয়নাতে মগ দিয়ে ছুড়ে দেওয়ার সময় পানির ছিটকা গিয়ে পড়ে অভয় এর গায়ের মধ্যে,অভয় গরম হয়ে হুমায়ুন এর কাছে এসে বলে চোখ দুইটি হাতে নিয়ে কাজ করছো, হুমায়ুন স্বভাবে উচিত কথা বলার মানুষ, ছোট সাহেব আসলে আপনি আসছেন খেয়াল করি নি,, খেয়াল করনি মানে কি? তুমি আমার প্রিয় টি-শার্ট নষ্ট করে দিয়েছো, ছোট লোক কোথাকার! তুমি আমার কাছে ক্ষমা চাও, ছোট সাহেব আপনি এখনো অনেক ছোট আমার ছেলের বয়সী, পড়ালেখা শিখছেন বড়দের সাথে এভাবে খারাপ ব্যবহার করা ঠিক না! তুমি আমাকে ভালো খারাপ শিখাছো! দাঁড়াও আব্বা কে ডাকি,, আব্বা আব্বা তুমি কোথাই তাড়াতাড়ি এদিকে আসো,, কি হয়েছে ব্রেকফাস্ট করতে দিচ্ছিস না খোকা? আলালের দুলাল ছিল অভয়, আব্বা দেখ তোমার ড্রাইভার আমার কি অবস্থা করছে! আমার টি -শার্ট খারাপ করে দিয়েছে। হুমায়ুন এটা কি করেছো? বড় সাহেব আমি খেয়াল করিনি ছোট সাহেব এদিকে আসছিল! আব্বা মিথ্যা বলছে ইচ্ছে করে দিয়েছে, বড় সাহেব ছোট মুখে একটি কথা বলতে পারি আপনার ছেলে আমাকে আমার ছোট ভুলের জন্য ছোট লোক ডেকেছে, অভয় তার পিট বাঁচানোর জন্য বানিয়ে বলল আব্বা ও আমাকে কি ডেকেছে জানো, কি ডেকেছে খোকা “কুকুরের বাচ্চা”,আর ওর ছেলের সাথে আমার পড়ালেখার তুলনা করেছে ! সিদ্দিক সাহেব দের গেইটের দাঁড়িয়ে সব দেখছিল স্কুলের ব্যাগ কাঁদে নিয়ে জয়! সে ছিল হুমায়ুনের ছেলে, হুমায়ুন বাসা থেকে আসার সময় মানিব্যাগটা ভুলে ফেলে এসেছিল, জয় স্কুলে যাওয়ার পথে সিদ্দিক সাহেবের বাড়ি পড়ে তাই ভেবেছিল মানিব্যাগ টা দিয়ে যাবে! কিন্তু দাঁড়িয়ে দেখছে নিজের আব্বার ছোট হওয়ার দৃশ্য,, চোখ দিয়ে পানি টুপটুপ করে পড়ছিল! কি খোকা তোকে কুকুরের বাচ্চা ডেকেছে, সিদ্দিক সাহেব কোন কথা শুনলো না হুমায়ুনের শার্টের কলার টা টেনে ধরে বড় সাহেব আমি এসব বলি নি ও মিথ্যা বলছে,, আমার আদরের খোকা কে এত বড় কথা বলছিস দুই টাকার গাড়ির ড্রাইভার হয়ে।তারপর হুমায়ুন কে থাপ্পড় দিতে থাকে সিদ্দিক সাহেব! অপদার্থ ড্রাইভার কোথাকার আরো আমার ছেলের সাথে তোর ছেলের পার্থক্য করিস তোর ছেলে পড়ালেখা শিখে চোর হবে নাহলে তোর মতো ড্রাইভার হবে, আমার ছেলে বড় হয়ে ব্যবসায়ী হবে ব্যবসায়ী বুঝছিস! আজকে থেকে আমার বাড়ির দিকে চোখ তুলে দেখবি না! যা দূর হয়ে যা আমার সামনে থেকে…. জয়ে চোখ মুছে তাড়াতাড়ি সেখান থেকে স্কুলে না গিয়ে বাসাই চলে যাই! হুমায়ুন জানতো না তার ছেলে এখানে ছিল, আজ এত তাড়াতাড়ি স্কুল থেকে এসে গেলি তোর কি হয়েছে মুখ এত কালো কেনো, জয় বিচলিত হয়ে মনে মনে ভাবলো আম্মু কে আব্বার ঘটনা টা বলা যাবে না আম্মু কষ্ট পাবে, না আম্মু তেমন কিছু না খুব মাথা ব্যাথা করছে ক্লাস টিচার থেকে ছুটি নিয়ে তাই চলে আসলাম! কড়া রোদেগরমে এরকম হয়েছে রে বাবা, একটু শুয়ে থাকলে ভালো লাগবে। আচ্ছা তোর আব্বা সাথে দেখা হয়েছে! হয়নি, আব্বু এর আগে গাড়ি নিয়ে বের হয়ে গেছে,জয় আনমনে হয়ে হঠাৎ বলে দিল আজ আব্বার সাথে যা হয়েছে সেটা ঠিক হয়নি,, কি হয়েছে তোর আব্বুর? জয় কথা ঘুরিয়ে ফেললো না আম্মু মানিব্যাগের কথা বললাম! সারাদিন কেটে গেলো রাত তখন ১১টা; হুমায়ুন বাসাই এখনো আসেনি, জয় তোর আব্বু বাসাই আসছে না কেনো এখনো বুঝছি না, এর আগে এরকম দেড়ি কোন দিন হয়নি,আমার বাম চোখটা খুব বেশি কাঁপছে ,, মনের মধ্যে কেমন কেমন লাগছে। আম্মু চিন্তা করো না আব্বু ঠিক এসে যাবে! জয়ের বুক জুড়ে কান্না চোখ জলে ডুবে যাচ্ছে! সে নিজেকে আর সামলাতে পারছে না, দৌড় মেড়ে বিছানাই গিয়ে বালিশ দিয়ে মুখ চেপে ধরলো, আমি এর ঠিক জবাব দেবো বড় হয়ে,আব্বু তুমি কষ্ট পেয়ো না বাসাই তাড়াতাড়ি চলে আসো আব্বু! দেখিয়ে দেবো একজন ড্রাইভারের ছেলে মানুষের মতো মানুষ হতে পারে! রাত বারোটায় দরজাই ধাক্কার আওয়াজ হলো, জয় তোর আব্বু এসেছেন! দরজা খুলতে খুলতে হুমায়ুনের স্ত্রী বলছিল এত দেড়ি কেনো হলো? দরজা খুলে দেখে সামনে দাঁড়িয়ে আছে পুলিশ! আপনারা এত রাতে এখানে? আপনি হুমায়ুন উদ্দিনের কে হোন? আমি উনার স্ত্রী, ম্যাডাম দুঃখের সংবাদ আছে ! আপনারা কি বলছেন! আমি কিছু বুঝতে পারছি না, হুমায়ুনের পকেটের ছোট ডায়রী তে বাসার ঠিকানা পেয়েছি! উনি রাস্তাই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে ছিলেন পথচারীরা উনাকে মেডিক্যাল নিয়ে যাই, ঢাকা মেডিকেল নেওয়ার পথে হুমায়ুন মারা যাই! ঢাকা মেডিক্যালের মর্গে লাশ রাখা আছে….সব কিছু থমকে যাই সেখানে! সুখের সংসার ভেঙ্গে পড়লো কুঠি ছাড়া! অন্ধকার গ্রাশ করেছিল জয় আর জয়ের আম্মুর জীবন,, অভাব অনটন তাদের নিত্য সঙ্গী হয়ে পড়ে! দুবেলা পেটে ভাত যোগাতে কষ্ট হয়ে যাই, সাথে জয়ের পড়ালেখার খরচ! জয় ও জয়ের আম্মু শহর ছেড়ে গ্রামে চলে যায়! গ্রামে গিয়ে ও পারিবারিক সমস্যার সৃষ্টি হয়, চাচাচাচী রা বলল হুমায়ুনের স্ত্রী দায়িত্ব নিতে পারবে কারণ ঘরের কাজের লোক আর লাগবে না কিন্তু কেউ হুমায়ুনের ছেলের দায়িত্ব নিতে পারবে না, পড়ার খরচ তিন বেলা কাজকর্ম ছাড়া ভাত দেওয়া ওদের পক্ষে সম্ভব না! জয়ের আম্মু দিশেহারাই পড়ে যাই! সবশেষে জয়কে নিয়ে মামার বাড়িতে যাই জয়ের আম্মু, জয়ের আম্মু তার ভাইকে সব বলল খুলে,, বুঝছি তোর দুঃখের কথা বোন। কিন্তু দেখ আমার তিন ছেলেমেয়ে সাথে আম্মা আছে এত মানুষের মুখেভাত একা রোজগারে দিতে হয় ;আমি এমনি ও তোর কথা তোর ভাবী কে বলতে পারবো না সে অশান্তি শুরু করে দেবে! তুই এক কাজ কর তুই শ্বশুর বাড়িতে ফিরে যা, জয় আমার সাথে থাকুক আমার মুদির দোকানে হাতেহাতে কাজ করবে এর ফাঁকেফাঁকে পড়ালেখা করবে! ভাই তোমার কাছে আমি চিরঋণী থাকবো আমার ছেলের দায়িত্ব নিয়েছো এটাই অনেক! হুমায়ুনের স্ত্রী বাড়িতে ফিরে যাচ্ছে ছেলেকে কোলে নিয়ে সেকি কান্না, বাবারে তোর এই অভাগী আম্মা টাকে ক্ষমা করে দিস।আম্মা তুমি এভাবে কান্না করছো কেনো? আমি দাদীর সাথে মামামামী দের সাথে ভালো থাকবে ! আম্মু তোমার মনকে শক্ত কর ! সবকিছু পর আশার আলো একদিন দেখবো আমরা, আম্মু চিন্তা করো না দাদীর কাছে ভালোই থাকবো আমি, জয় মামার বাড়িতে রয়ে গেলো, মামীর অজানাই জয়কে জয়ের মামা গ্রামের হাইস্কুলে ৭ম শ্রেণীতে ভর্তি করিয়ে দিলো, শিক্ষকরা তার পড়ালেখা ক্ষেত্রে মনোযোগ দেখে থাকে পড়ালেখা চালিয়ে যাবার জন্য উৎসাহ দিত!জয়ের মামী এসব পছন্দ করতো না, জয় সকালে পড়তে বসলে গরুর জন্য ঘাস কাটতে পাঠাতো,, স্কুল থেকে দুপুরে আসলে ভাত দেওয়া হতো না ভাগ্যে জোটতো শুকনো মুড়ি না হলে চিড়া, রাতে ভাত হিসেবেপাতে বাসি ভাত, বাসি তরকারি! দাদি ও কিছু বলতে পারতো না জয় ভাত খেতে বুক ছিঁড়ে যেতে, আব্বা আম্মার কথা ভাবতো!একদিন ভালো তরকারী না হলে আমি কান্না বসিয়ে দিতাম! আম্মা আব্বা আমাকে কত আদর করে ভাত খাওয়াতে, আজ আমার পাশে কেউ নেই! জয় রাত জেগে পড়ালেখা করতো। জয়ের দাদী কুড়ানো পাতা, গাছের ডালপালা বিক্রি করে টিউশান টিচার টাকা পরিশোধ করে দিতো , মামার পুরানো হিসাবের খাতাই অবশিষ্ট পৃষ্টা গুলোতে পড়া লিখতো! এভাবে সে SSCতে গোল্ডেন A+ পাই,, জয় এর দাদী মারা যাই কিছুমাস পর! মামার বাড়ির গ্রামে একটা ঘর ভাড়া নেই জয়, জয় তার আম্মু কে চাচাচাচীর কাছ থেকে নিজের কাছে নিয়ে আসে!জয় গ্রামে টিউশানি করতো জয়ের আম্মু সেলাই কাজ করতো, এভাবে আস্তে আস্তে জয় অনেক দূর এগিয়ে যাই,জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি বি এ একাউন্টিং নিয়ে অনার্স পাশ এবং এম বি এ পাশ করে,, এখন সে বড় একজন ব্যাংকার! চার বছর পর ::জয় অফিসে ছিল,, হঠাৎ বন্ধুর ফোন.. –হ্যালো জয়! কেমন আছিস–হুম ভালো, তুই? –ভালো, যার জন্য ফোন করলাম তুই বলেছিলে শহরের উপর পুরাতন বিল্ডিং বা প্লট পেলে খবর দিতে, একটা পেয়েছি সিদ্দিক মঞ্জিল, খুব সুন্দর বাড়ি নিলামে বিক্রি করছে! —কি আবার বল, —হুম সিদ্দিক মঞ্জিল,, তোর পরিচিত জায়গা হবে, ছোট বেলা যেখানে কাটিয়েছিস সেখানের কাছাকাছি হবে! —হুম তাই!তোকে কিভাবে ধন্যবাদ জানাবো জানি না দোস্ত, আমার বিশ্বাস হচ্ছে না দোস্ত,,কিন্তু বাড়ি বিক্রি করে দিচ্ছে কেনো জানিস? যেভাবে সম্ভব সেই বাড়িটা আমি চাই চাই। —ব্যবসায় লোকসান খেয়ে দেউলিয়া হয়ে গেছে সিদ্দিক সাহেব, একমাত্র ছেলে অভয় একজন খুনি, ফাসির রায় হয়েছে! ঠিক আছে জয়,, আমি সব ব্যবস্থা করছি!–কি বলিস এত খারাপ অবস্থা! আচ্ছা, ভালো থাকিস রাখি। কয়েকদিন পর আম্মু তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও, এখনি আমরা একটি জায়গায় যাবো, কোথাই বাবা,, সব প্রশ্নের উত্তর সেখানে দিয়ে দেবো আম্মা! গাড়ি করে রওনা হলো তাদের গন্তব্যস্থানে।যেতে যেতে জয় ও জয়ের আম্মুর সব স্মৃতি মনে পড়ছিল! বাবা আমরা এখানে কেনো এলাম?আম্মু সেই পুরাতন দিন কে নতুন করে ফিরে পাওয়ার জন্য!সঠিক গন্তব্যে পৌছলো গাড়ি থামানো হলো বাড়ির গেইটের সামনে। গেইটের উপর বড় করে লেখা “হুমায়ুন মঞ্জিল “!জয় এখানে তোর আব্বু কাজ করতো, গেইটে তোর আব্বুর নাম?হুম যা দেখছো ঠিক দেখছো, আব্বু এখান থেকে শেষ কষ্ট পেয়ে মৃত্যুর পথে যাত্রী হয়েছিল, জয় আম্মুকে সব চেপে রাখা কথা গুলো খুলে বলল!জয় আর জয়ের আম্মু জড়িয়ে ধরে কান্না ভেঙ্গে পড়লো দুজন, তুই এতদিন আমার থেকে লুকিয়ে রেখেছিস আমি কষ্ট পায় বলে! আম্মু চোখের জল মুছো তোমাকে আর কোন কষ্ট পেতে দেবো না! সব ব্যাথা ভুলে গিয়ে আব্বার দোয়া নিয়ে আব্বার সুখের সংসার নতুন করে শুরু করবো আম্মু ! আব্বুর স্বপ্ন আমি পূরণ করেছি এই বাড়ি এখন আমাদের….­­..

About the author

Md. Sohel Ahmed Khan