কবিতা সাহিত্য

নির্জনে নিজন : নিজন দে চৌধুরীর কবিতা

নরসুন্দা ডটকম   ডিসেম্বর ১, ২০১৮
নির্জনে নিজন : নিজন দে চৌধুরীর কবিতা
প্রাক্-কথন : গৌতম অধিকারী
সাতচল্লিশের রেডিমেড দেশভাগের ক্ষত স্বাধীনতার আবেগের কাছে বড়ো হয়ে দেখা দিয়েছিল কি না, সেটা রীতিমতো গবেষণার বিষয়। কিন্তু ১৯৪৭-এর ১৫ আগষ্ট তারিখেই এক কিশোর তাঁর প্রথম কবিতাটা লিখেছিলেন এক অনিরুদ্ধ দেশপ্রেমের আবেগে। সে কবিতায় উচ্চারিত হয়েছিল স্বদেশের গান,-
     “ভারতমাতার মুক্তবীনায়     ‌
      সঙ্গীত ওঠে বাজি,
      ভারত স্বাধীন আজি।”
দেশপ্রেমের সমাজ-অভিমুখী এমন ভাবনাতরঙ্গের দুটি চরণ দিয়ে সূচনা করলেও দেশভাগের ক্ষত, বাস্তুচ্যুত মানুষের যন্ত্রণার অংশভাক্ হতে তাঁর বেশি সময় লাগেনি। লাগার কথাও নয়। সেই কিশোরকবি ক্রমাগত নিজের ভেতরকার ভাঙচুরের মধ্য দিয়ে জীবন ও সমাজসত‍্যকে আত্মস্থ করে হয়ে উঠেছেন পঞ্চাশের কবিতার এক স্বতন্ত্র স্বর–কবি নিজন দে চৌধুরী। উদ্বাস্তু জীবনের যন্ত্রণার অপরূপ কাব‍্যরূপ আমরা পেলাম তাঁর ‘চড়ুই চিন্তা’ কবিতায়,-
“ফাঁকা উঠোন । শূন্য ধানের গোলা । মরাই খালি,
ক্ষেত-খামারে মা লক্ষ্মীর শূন্য বরণ ডালি ।
নটে গাছটা মুড়িয়ে গেছে কবে ।
দুঃখী মায়ের থান কাপড়ে রোদ্দুর ধবধবে,
ফাঁকা উঠোন । শূন্য ধানের গোলা । মরাই খালি ।
তুলসী তলায় মাথুর গায় বলাই- বনমালী ।”
একজন সত‍্যিকারের কবি অবশ্যই বাস করেন নিজের সময়ের মধ্যে, সমাজের মধ্যে। আবার যে সময় বা যে ঐতিহ‍্যে তিনি নেই, সেই যাপনে তিনি ভাঙেন সময়-সমাজের সীমা। নিজন দে চৌধুরী এই সীমাতিক্রমী মহত্ব অর্জন করেছিলেন। সেকারণে তাঁকে নিয়ে চর্চার পরিসর তৈরি হওয়া আবশ‍্যিক মনে করি। আত্মকথনের মতো করে তিনি লিখেছেন, “চোখের সামনে ছিল চলমান জীবন,উচ্ছল ও ফেনাময়। ঘোর লাগা সেই চোখে কখনো ছিল আকাশচারী মগ্নতা। কখনো কুটিল আবর্তের অতল পাতাল।

নরসুন্দা ডট কমে আরো পড়তে পারেন…

বীর নারী তারামন বিবি

সিটি ব্যাংক এনএ’র উদ্যোগ- সংবর্ধনা দেওয়া হয় সুরকার আলাউদ্দীন আলীকে

ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কার ২০১৭ প্রদান

ভ্রাম্যমাণ গাছের হাসপাতাল

সেইসব হারানো ছড়ানো স্মরনের সরণি বেয়ে অদ্ভুত অদ্ভুত সব পংক্তি কেমন যেন ঘোর লাগাতো আমার মেধায় আর মননে। এসে যেতো এক আধতা পূর্ণাঙ্গ প্রয়াস। জমে উঠতো নেশাটা। আর তখনই আমি পৌঁছে যেতাম অন্য এক অলৌকিক জগতে। বাহ্য জগত মাটির পৃথিবী সব কিছুই আমার কাছে অবলুপ্ত হয়ে যেতো ।“  সম্ভবত একারণেই সমাজলগ্নতার পাশাপাশি তাঁর কবিতার মধ‍্যে দেখা গেছে এক নির্জন আত্মসন্ধান।  লিরিকধর্মী রোমান্টিকতা, যেখানে জীবনের বহুসত্তায় লীন হয়ে কবিতা। তাঁর কবিতারা তাই বারবার ছুঁয়ে গেছে আবহমানের নিগূঢ় দর্শন। অসাধারণ বাকপ্রতিমা, চিত্রকল্প ও ধ্বনির লাবণ্য এই কবির কবিতাকে চিনিয়ে দেয়।
‘নিজের বৃষ্টিতে’, ‘জলছবি’, ‘হৃদয়ঘটিত জার্নাল’, ‘যাও পরম্পরা যাও’ প্রভৃতি কাব্যের মধ্যে সেই অনন‍্য কবির পরিচয় লুকিয়ে আছে। অন্তর্মুখী নির্জনবিলাসী নিজনের  কয়েকটি কবিতা এখানে উপস্থিত করা হলো।

।। চড়ুই চিন্তা ।।

রোজই দেখি, আমার ঘরের পাশে
কেমন করে ঘুরে বেড়ায় এক-বুক বিশ্বাসে
দুটো তিনটে পাঁচটা দশটা চড়ুই ।
কেমন যে নির্ভয়ে, কেমন নির্ভাবনায় আসে
এই উঠোনে ঘুরে বেড়ায় এক- বুক বিশ্বাসে
দুটো তিনটে পাঁচটা দশটা চড়ুই ।
হায়রে চড়ুই ! কেবল হাহাকার ।
হায়রে চড়ুই, চারদিকে সব অভাবী সংসার:
খুঁটে খাবার খুদ কুড়ো কি রুটির টুকরো আর
তাও মেলে না, এমন হাহাকার ;
আহা, চড়ুই উড়ে বেড়ায়, ঘুরে বেড়ায়, তার
চারদিকে সব বাড়ন্ত সংসার ।
ফাঁকা উঠোন । শূন্য ধানের গোলা । মরাই খালি,
ক্ষেত- খামারে মা লক্ষ্মীর শূন্য বরণ ডালি ।
নটে গাছটা মুড়িয়ে গেছে কবে ।
দুঃখী মায়ের থান কাপড়ে রোদ্দুর ধবধবে,
ফাঁকা উঠোন । শূন্য ধানের গোলা । মরাই খালি
তুলসী তলায় মাথুর গায় বলাই- বনমালী ।
তবুও আজো আমার ঘরের পাশে
কেমন করে ঘুরে বেড়ায় এক-বুক বিশ্বাসে
দুটো তিনটে পাঁচটা দশটা চড়ুই ।
কেমন যে নির্ভয়ে, কেমন নির্ভাবনায় আসে
এই উঠোনে ঘুরে বেড়ায় এক- বুক বিশ্বাসে
দুটো তিনটে পাঁচটা দশটা চড়ুই ।

।। বৈষ্ণবী ।।

সাঁকো যেমন পলকা, নদী তেমনি খরস্রোতা।
একবারটি পা ফসকালে ছিটকে যাবো কোথা!
গহীন নদী অথৈ, তার বাঁও মেলে না, তাই
কাজ নেই পার হয়ে আমার, ঘরকে ফিরে যাই।
দিন ডুবছে দ‍্যাখে হেথায় রোগা দুবলা কবি
সাঁকোর পাশে দেইড়ে আছে খলবলে বৈষ্ণবী।
এই গহীনে শীর্ণ দু-পা ফসকালে কী হবে?
বৈষ্ণবী চোখ মটকে ডাকে সাঁতার শেখো তবে!

।। গ্রহণ ।।

কে নেবে সর্বস্ব তোর?
আগ্রাসী আগুন ।
কী পড়ে থাকবে শেষে?
ছাই ।
তবু যদি কিছু বাকি থাকে?
জলধারা নেবে ।
তারপর?
পরমা গতির শূন্যে সারা হবে সব গ্রহিষ্ণুতা।

।। নান্দনিক ।।

অযাচিত মুক্তি ছিলো আমার নিয়তি,আমি জানি
আশ্চর্য নির্মম ।
দু চোখে শ্রাবণ ঢেলে আজ হঠাৎ কেন মুছে দিলে
লিপিবদ্ধ ভ্রম ।
সমস্ত দুয়ার জুড়ে কেন আলুলায়িত অমায়
হঠাৎ দাঁড়ালে ?
খড় কুটোর শান্তি ছিলো যতটুকু,কেন তার দিকে
দু হাত বাড়ালে?
রহস্য ইজেলে তুমি এতকাল লগ্ন হয়ে ছিলে,
শান্ত মোনালিসা ।
অলক-লাবণ্যে হলে আজ হঠাৎ দূরন্ত ম্যাডোনা,
খুঁজে পাইনে দিশা ।
মুখের প্রচ্ছদে লেখা, রহস্য তোমার বর্ণমালা
হায়ারোগ্লোফিক ।
মুখোশে মুখশ্রী ঢাকো, অন্ধকারে অনন্য পরমা-
তবু নান্দনিক ।।

নির্জনে নিজন : নিজন দে চৌধুরীর কবিতা

About the author

নরসুন্দা ডটকম