হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস ‘দেবী অবলম্বনে অনম বিশ্বাসের পরিচালনায় দেবী মুক্তি পেয়েছে বাংলাদেশের সিনেমা হলে এবং আমেরিকার বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের থিয়েটারগুলোতে। আজকে অরল্যান্ডো শহরে দেবীর প্রিমিয়ার শো হলো। পরিচালক অনম বিশ্বাস কে আমরা জানি তাঁর ‘আয়নাবাজি’ চিত্রনাট্যের জন্যে। আমি দীর্ঘ একটি লেখা লিখেছিলাম কীভাবে আয়নাবাজির গল্প একটি কোরিয়ান সিনেমার মূল স্তম্ভকে ব্যবহার করে লেখা কিন্তু কোন রকমের স্বীকৃতি দেয়া ছিল না সিনেমায়। অন্তত অনম বিশ্বাসকে সাধুবাদ তিনি প্রথম পরিচালনার জন্যে ব্যবহার করলেন হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস কে। যদিও শুরুর দিকে এই কাহিনির কপিরাইট নিয়ে হুমায়ূন-কন্যা শিলা আপত্তি জানান এবং বলেন কোন অনুমতি না নিয়েই করা হয়েছে। বাংলাদেশের নির্মাতাদের কাছে অনুরোধ যে কোন গল্পকেই লেখকের স্বীকৃতি এবং সম্মানী দিয়ে সিনেমা করার জন্যে। অন্যদিকে সরকারও যেন কপি রাইট আইন মেনে না চললে অনুদান দেয়া থেকে বিরত থাকেন।
এবার আসি সিনেমা হিসাবে দেবীর কিছু বিশ্লেষণে। প্রথমত মিসির আলী সিরিজটি হুমায়ূন আহমেদ লিখেছেন প্রফেসর ডক্টর কভুর নামের একজন বিজ্ঞানমনস্ক মানুষের চরিত্রের আদলে। আমাদের সময়ে আমরা জানি ডক্টর কভুর ছিলেন এমন একজন ব্যক্তি যিনি সব সময়, ভূত, অলৌকিক, শয়তান বা জ্বিন জাতীয় অতিপ্রাকৃতিক বিষয়গুলোকে চ্যালেঞ্জ করতেন এবং ভুল প্রমাণ করতেন। ভবানী প্রসাদ সাহুর লেখা “ভূত ভগবান শয়তান বনাম ডক্টর কভুর” বইটি পড়ে দেখতে পারেন বিস্তারিত জানার জন্যে। তবু মিসির আলী যথারীতি হুমায়ূন আহমেদের চরিত্র সৃষ্টির কারিশমায় অনবদ্য এবং আকর্ষনীয়। “দেবী’ উপন্যাস কে কোনভাবেই আমি উপন্যাস বলবো না। বড় জোর একটি বড় গল্প। সাহিত্যের একটি ধারা আছে ‘হন্টোলজি’ নামে। জাঁক দেরিদার কয়েনিং থেকে এর জন্ম; দেবী কে সেই ধারায়ও ফেলা যায় না এর দার্শনিক গভীরতার অভাবের জন্যে। বরং আধিভৌতিক জানরের বা ধারার বড় গল্প বলা যায়। সে যাই হোক, বাংলাদেশের পাঠকের কাছে দেবী জনপ্রিয় উপন্যাস।
এমন জনপ্রিয় উপন্যাসকে চলচ্চিত্রে রূপ দেয়া অনেক চ্যালেঞ্জিং। পরিচালক অনম বিশ্বাসকে সাধুবাদ জানাতে হয় কারণ, গল্পটিকে তিনি সময়পোযোগী করেছেন। সিনেমা ভিন্ন মাধ্যম, সিনেমার দাবিতে গল্পের পরিবর্তন আসতেই পারে। আসলে পরিবর্তন আসাটাই উচিত, অন্যদিকে একটি ভিন্ন মাধ্যমের পরিচালক হিসাবে এই ভিন্নতাই পরিচালকের কৃতিত্ব। সেদিক থেকে, ফেসবুক, নীল খামের বদলে চিঠি, ইনস্ট্যান্ট মেসেস এনে কাহিনিকে সমসাময়িক করেছেন পরিচালক।
দেবীর চলচ্চিত্রায়ন চমৎকার, কিন্তু টিভি ড্রামা আর সিনেমার পার্থক্য কি খুব ভালভাবে বোঝা যায়? ডিজিটাল যুগের আগের সময় সিনেমা আর টিভি প্রোডাক্টশনের পার্থক্য ছিল সহজ-সেলুলয়েডের ফিতা, ৩৫ মিলিমিটার আর ৮ মিলিমিটার, ক্যামেরা আলাদা ধরেনের। কিন্তু এখন ডিজিটালে সব এক রকম। সেক্ষেত্রে সিনেমা আর টিভির পার্থক্য হবে দর্শকের এক্সপেরিয়েন্স বা ভিজ্যুয়াল অভিজ্ঞতায়। সেক্ষেত্রে সিনেমার গতি, গল্পের গভীরতা এবং চিত্রায়নের ব্যাপকতা (খুব সহজেই স্কাইশট, স্পীডশট ইত্যাদি এনে করা যেতো) ইত্যাদির ক্ষেত্রে দেবীতে সিনেমার চেয়ে টিভি ড্রামার আমেজটাই বেশি।
জয়া আহসান অসাধারণ অভিনয় করেছেন, করেছেন নীলু চরিত্রের শবনব ফারিয়া। চঞ্চল চৌধুরী ভাল অভিনেতা কিন্তু দেবী’তে তাঁর স্কোপ খুব কম দেয়া হয়েছে গল্পের ফোকাস রানু চরিত্রের ওপরে বেশি থাকায়। অন্যদিকে চঞ্চল চৌধুরীর গেট-আপ, মেকআপ মিসির আলীকে ধারণ করতে পারেনি, পাকা চুলকে সব সময় বানানো মনে হয়েছে, ম্যানারিজম একেবারেই মিসির আলীর মতো গাম্ভীর্য ও রহস্যময় হয়ে ওঠেনি। এখানে গল্পকে কাটছাঁট করাও একটা কারণ হতে পারে। মিসির আলী যেভাবে প্যারানরমাল বিষয়গুলোর বিশ্লেষণ এবং অনুসন্ধান করতেন তা বেশি ফুটে ওঠেনি। যেমন মিসির আলী মূল গল্পে সেই মন্দিরটির ভেতরে রাত কাটান। এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ অংশ রানুর অভিজ্ঞতাকে বোঝার জন্যে। কিন্তু এটা সিনেমাতে অনুপস্থিত।
সিনেমাটোগ্রাফি বা চিত্রায়ন, আবহ সংগীত, স্পেশাল ইফেক্ট চমৎকার। ভৌতিক দৃশ্যগুলোতে বেশীমাত্রায় শব্দ মাঝে মাঝে কানে লেগেছে। একটি মাত্র গান- অসাধারণ, আবহ সংগীত চমৎকার।
এবার কতগুলো মোটাদাগের ভুলকে উল্লেখ্য করি; নীলুর ফেসবুক বন্ধু যিনি সরল, কেয়ারিং, ভদ্র দেখতে কিন্তু আসলে সিরিয়াল খুনি, তার ক্যারেক্টার প্রোগ্রেশন একদম বেখাপ্পা। হঠাৎ ধাক্কা খেতে হয়, এটা দূর্বলভাবে তৈরি।
কাহিনি যদি ফেসবুক, ইনস্ট্যান্ট মেসেজ দিয়ে সমসাময়িক করা হবে তাহলে কোথাও একবারও কেউ উচ্চারণ করলো না মেয়েটির স্কীজোফ্রেনিয়া হতে পারে। ২০১৮ সালে কেউ যদি বলে সে অডিটরি বা ভিজুয়াল হ্যালুশিনেশন দেখে তাকে স্কিজোফ্রিনিয়ার রোগী না বলাটাই সবচেয়ে বড় ভুল। আর এটা রুল-আউট না করলে তো রানুর অতিপ্রাকৃতিক ক্ষমতাকে প্রতিষ্ঠিত করা যায় না। অন্যদিকে মিসির আলী ‘প্যারা নরমাল সাইকোলজি” নিয়ে কাজ করেন। সিনেমায় লেখা হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লিনিক্যাল সাইকিয়াট্রি পড়ান (আমি ভুল দেখলে ভাল, না হোলে ক্লিনিক্যাল সাইকিয়াট্রিস্ট লাইসেন্স হারাবেন স্কিজোফ্রেনিয়া রুল আউট না করলে)। এটা একেবারে মূল গল্পকে চ্যালেঞ্চ ছুঁড়ে দেয় এর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে। অন্যদিকে পুরনো মন্দিরের ভেতরে আমরা দেখতে পাই ঝকঝকে বেদী মূর্তি যা বিশ্বাসযোগ্য থাকে না, যেখানে বলা হয় ওখানে কেউ যায় না সাপের ভয়ে।
ভালমন্দ সব বললাম। আবার বলি সব যুক্তির বাইরে কী। পুরো সময়টা আনন্দে কেটেছে। পৃথিবীর অনেক বিখ্যাত বিখ্যাত সিনেমায় ব্লুপার বা চরম ভুল আছে সেগুলো নিয়ে আস্ত বই লেখা যায়। দেবী সবকিছুর পরে একটি ভাল সিনেমা, বাংলাদেশের জন্যে চমৎকার নিজস্ব সিনেমার ধারায় কৃতিময় সংযোজন। এজন্যে এর পরিচালক, কলাকুশলী সকলেই অভিনন্দন।
লেখক : সেজান মাহমুদ, ডিসেম্বর ২, ২০১৮ অরল্যান্ডো, ফ্লোরিডা।
নোট: লেখাটি লেখকের ফেসবুক আইডি থেকে নেয়া।