কবিতা ভাবনা : খুব ছোটবেলায় বাবা মা কে ছেড়েই গ্রাম থেকে শহরে এসেছিলাম বড় ভাইয়ের কাছে। সেখানেই আমার বেড়ে ওঠা। স্কুলে ভর্তি করানো হলো আমাকে। পড়া- লেখার পাশাপাশি খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড ছিলো আমাদের স্কুলে বাধ্যতামূলক। সপ্তাহের প্রতি বৃহস্পতিবার সাংস্কৃতিক ক্লাশ হতো। এছাড়াও বিভিন্ন দিবসে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানতো ছিলোই। এমনই এক অনুষ্ঠানে পল্লীকবি জসিম উদ্দিনের “কবর” কবিতা যৌথভাবে আবৃত্তির জন্য আমাকে ডাকা হলো, সেই যে কবিতার প্রতি এক ভালোলাগা শুরু হলো..। তারপর থেকে আবৃত্তির দিকেই ঝোঁক ছিলো বেশি।
এক সময় গান শিখতে গিয়েছিলাম কিন্তু ধৈর্য ছিলনা তাই গান শিখতে পারিনি। পরে নাটক শুরু করলাম। নাটক করতে এসে আবৃত্তি চর্চার সুযোগ হলো আরো বেশি। ধীরে ধীরে কবিতার প্রতি আকর্ষন বাড়তে থাকলো কিন্তু লেখার ব্যাপারে সাহস হয়নি তখনো। সেই চতুর্থ শ্রেনীতে পড়ার সময় একবার এক দেয়াল পত্রিকার জন্য একটা কবিতা লিখেছিলাম। দেয়াল পত্রিকায় প্রকাশের পর আমার কবিতাটা আমিই চিনতে পারিনি, কারণ সংশোধন করা হয়েছিলো। তারপর দীর্ঘদিন কবিতা লেখার সাহস হয়নি আর। কিন্তু মাঝে মাঝেই খাতা কলম নিয়ে বসতাম। কিছু কিছু লিখেছি সেগুলি কোথায় আছে খুঁজে পাইনি আর। কবিতা পড়ার মধ্যেই বেশি সময় ব্যয় করেছিলাম।
জাতীয় কবির বিদ্রোহী কবিতাসহ মুক্তিযুদ্ধের কবিতাগুলি রক্তে আগুন লাগিয়েছিলো। এরপর রোমান্টিক কবিতার দিকে ঝোঁক বেড়ে চললো। কবিতার অর্থ মূলত তখন থেকেই খুঁজতে শুরু করি। কবিতার অর্থ সম্পর্কে নানান জনের নানান মত থাকলেও কারো মতামতই চুড়ান্ত করা যায়নি। এরিস্টটল বলেছেন “কবিতা দর্শনের চেয়ে বেশি, ইতিহাসের চেয়ে বড়”।
যতীন সরকারের লেখায় জানা যায়, কবিমন বহমান নদী। চিন্তক সে বহমান নদীর কতটুকু ছুঁতে পারেন! তবুও সময়ের কবিকে, কল্পনার গতি ও ভাষার লক্ষ্যকে আবিষ্কার করেন চিন্তক। চিন্তকের ধারণায় সময়টা স্পষ্ট হয় কিংবা একটা তর্ক তৈরি হয়। এই তর্ক-বিতর্কে আত্ম-অনুভবজাত কবি নিজের রাস্তাটা স্পষ্ট দেখতে পারেন। কবিতা আসলে প্রত্যেক কবির এক অমর সৃষ্টি। মানুষের মন ছেকে যে শব্দগুলো বের হয় সেগুলোই কবিতা, মানুষের হৃদয়ের গভীরে যে ঝড় ওঠে সেই ঝড়ের শনশন শব্দই হলো কবিতা, হৃদয়ের ক্ষত থেকে চুয়ে চুয়ে যে রক্তের ক্ষরণ হয় তাই রূপান্তরিত হয়ে কবিতায়। সমাজে অন্যায় অসংগতি, দূর্ণীতির বিরুদ্ধে বিক্ষুদ্ধ মানুষের প্রতিবাদের শ্লোগান হলো কবিতা।কবি তার কবিতায় নিজের কিছু অনুচ্চারিত কথাও বর্ণনা করতে পারেন আবার অন্যের জীবনটাকেও নিজের মতো করে শব্দ এবং ছন্দে ফুটিয়ে কবিতায় রূপ দিতে পারেন। চোখে দেখা গোধুলী বেলার সেই অপরূপ বর্ণনা কবিতার মাঝেই পেয়ে যাই কবির কলমের খোঁচায়। একজন কবির জন্য কবিতা হলো একজন বাবা-মায়ের কাছে সন্তান যেমন। বাবা-মায়ের সচেতনতায় সন্তান যেমন সমাজে মুখ উজ্জ্বল করে তেমনি কবিতাও সমাজে আলো ছড়ায়। বাবা-মায়ের অসচেতনাতায় সন্তান যেমন দিকভ্রষ্ট হয়ে বিপথে চলে যা কবিতাও কখনো কখনো দিকভ্রষ্ট হতে পারে। অতএব একজন কবির কাছে তার কবিতা হলো এক নতুন পৃথিবী সৃষ্টির শুভ সংকেত।
আমি যখন পৃথিবীর সবচেয়ে দুখী মানুষ হয়ে যাই তখন কবিতা আমাকে সাহস যোগায় ঘুরে দাঁড়াবার। আবার যখন আমি নিজেক পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ মনে করি তখন কবিতা আমাকে সাবধান করে যে, সামনে বিপদজনক রাস্তা নিয়ন্ত্রিত গতিতে এগোতে হবে। সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনায়, বিক্ষোভে-বিপ্লবে কবিতা হলো সবচেয়ে ভালো এবং কাছের বন্ধু। কবিতা কখনো প্রতারণা করে না। তাই কবিতা খুঁজি দিবা-নিশি।
।। সাহস ।।
কবিতা লিখবো তাই দাঁড়িয়েছিলাম
শান্ত সুনীল সাগরের সামনে
কিছু শব্দ সংগ্রহ করবো এ আশায়।
আমাকে দেখেই মধ্য সাগর থেকে
এক একটি জলোচ্ছ্বাস ফুঁসে উঠলো
সিডর আইলার রূপ নিয়ে তারা
ধেয়ে আসতে লাগলো উপকূলের দিকে।
পরে জেনেছি ধ্বংস নয়, সাহসী করতেই
সাগরের এই ভয়ঙ্কর রূপ
কবিদের নাকি অনেক সাহসী হতে হয়!
তোমার সামনে যখন দাঁড়িয়েছি আজ
ভালোবাসার আশায়
তোমার অগ্নিমূর্তি তখন আমাকে আর
ভীত সন্ত্রস্ত করে তোলে না।
সাগরের কাছে থেকে জেনে এসেছি
প্রেমিক হতে হলেও নাকি সাহসী হতে হয়।
আমাকে সাহসী করতেই তোমার অগ্নিমূর্তি
সে কথা জেনেছিলাম অনেক আগেই।
তাইতো আজ সোহরাওয়ার্দীর জনারণ্যে
সাহসী দুহাতে জড়িয়ে তোমায়
শত কোটি চুম্বনে জানিয়ে দিলাম
ভালোবাসি তোমায়।।
।। ভালোবাসার পাহাড় ।।
ভালোবাসার পাহাড় জমেছে এই বুকে।
ভুমি দস্যুদের ভয়ংকর থাবার পূর্বেই
দখলে নিয়ে যেও তুমি প্রিয়তমা।
তোমার হাতেই সপে দিলাম আজ
তিলে তিলে জমানো এই ভালোবাসা।
ভূমি দস্যুদের তীক্ষ্ণ নখের আচরে
রক্তাক্ত হবার আগেই
তোমার নিরাপদ বুকে জড়িয়ে রেখো,
শাড়ির আঁচলে ঢেকে দিও আমায়।
ইদানিং এই পাহাড়কে ঘিরে
ভূমি দস্যুদের আনাগোনা বেড়েছে বেশ
আতংকিত আমি প্রতিমুহুর্তে
এ চোখে ঘুম আসেনা, আমি ঘুমাতে পারিনা
ওরা আমার নরম, কোমল হৃদয়টা ছিঁড়ে
রক্ত মাংস, হাড়গোড় একসাথে দু পায়ে দলে
ইট ভাটার গনগনে আগুনে পোড়াতে চায়
স্বার্থের অট্টালিকা তৈরীতে তাদের নাকি
ইটের বড় প্রয়োজন।
প্রিয়তমা আমার,
তোমার শুণ্য বক্ষের উষর মরুতে
যদি ভালোবাসার বীজ বপন করো
তবে অনবরত জল সেচে সেই মরুতে
সবুজ শষ্য ফলাতে পারি আমি অনায়াসেই।
যদি লাঙ্গল চষার ক্লান্তি নিয়ে
ঘুমিয়ে যাই দুজনে সেই সবুজ বিছানায়
পাখিদের কলকাকলিতে আসবে ভোর
ঘুম ভেঙ্গে গেলেই সূর্যের আহবানে
শুরু হবে আমাদের নতুন পৃথিবীর যাত্রা।।
।। নীল অপরাজিতা ।।
নীল অপরাজিতা
যত নীলের সমারোহ।
নীল নিলঞ্জনার নুপুর নিক্কনে
সবার ভালবাসা ছিল।
সেই থেকে নীল আমারও
পছন্দের রঙ ছিল।
সাপের বিষের জ্বালায়
মানুষ নীল হয়ে যায় যখন জেনেছি,
তখন থেকেই নীল দেখলেই বেদনার
কথা মনে পড়ে যায়, শিউরে উঠি।
মনে হয় নীল তো বিষের পরবর্তী রূপ।
তবে আকাশ যে নীল? সমুদ্রের জল নীল?
বৃষ্টি হয়, বিষের জ্বালায় আকাশও কাঁদে।
সাগর গর্জন করে বেদনায়।
তাই নীল অপারাজিতা
নীলের মাঝেই থাক।।
সোহেল খান : কবি, সংগঠক ও নাট্যকর্মী । প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ “তন্দ্রমনি”- ২০১৮।।