কে এই হুররাম সুলতান? সেটা জানার আগ্রহ নিশ্চয়ই জাগছে মনে। তার আসল নাম মারিয়াম জারলি। বিশ্বব্যাপী জার্মান ও তুর্কি এ অভিনেত্রী ‘হুররাম সুলতান’ নামেই বেশি পরিচিত। এ দেশের পর্দায় হুররামকে দর্শক আবিষ্কার করেন ‘সুলতান সুলেমান’ নামের টিভি সিরিয়ালের মধ্য দিয়ে। তুর্কি সিরিয়াল ‘মুহতেসেম ইউজিল’, যার ইংরেজি নাম ‘দ্য ম্যাগনিফিসেন্ট সেঞ্চুরি’র বাংলায় ডাবিংকৃত টিভি সিরিজটি দেশে প্রচারের পর থেকেই তার সম্পর্কে জানার আগ্রহ বাড়তে থাকে।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও তুমুল জনপ্রিয়তা এ হুররাম সুলতানের। অটোমান সুলতানকে প্রেমের জালে আবদ্ধ করে হুররামের সাধারণ দাসী থেকে সম্রাজ্ঞী হওয়ার অসাধারণ গল্পের রানী তিনি। যার তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বী সুলেমানের প্রথম স্ত্রী মাহিদেভ্রাণ সুলতান, সুলেমানের মা আয়েশা হাফসা সুলতানা, সুলতানের বাল্যবন্ধু এবং পরবর্তী সময়ে সাম্রাজ্যের প্রধান উজির ইব্রাহিম পাশা।
৭০০ বছর ধরে তুরস্কের অটোমান সাম্রাজ্যের রাজত্ব ছিল পৃৃথিবীজুড়ে। এ সাম্রাজ্যের স্বর্ণযুগ ছিল সুলতান সুলেমানের নেতৃত্বে ষোড়শ থেকে সপ্তদশ শতাব্দী। ক্ষমতার টানাপড়েনে অটোমান সাম্রাজ্যের ষড়যন্ত্র, গুপ্তহত্যা, ভাই হত্যা, সন্তান হত্যা এবং দাসপ্রথার অন্তরালের কাহিনী নিয়ে নির্মিত মেগাসিরিয়ালে সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্রটি হুররাম সুলতান। এ অপরূপ সুন্দরী রানীর কারণেই ধীরে ধীরে সুলতানের প্রাসাদে দানা বাঁধতে থাকে বিদ্বেষ। পরিপ্রেক্ষিতেই ক্রমেই ধ্বংসের দিকে যেতে থাকে অটোম্যানরা।
মজার ব্যাপার হলো, অটোম্যান সাম্রাজ্যের ওই রানী বলতে এখন বিশ্বের সবাই মারিয়েম জারলিকে চিনে থাকেন। চরিত্রের সঙ্গে একেবারেই মিশে গিয়েছিলেন তিনি। জার্মান এ মডেলকে এ চরিত্রে নেয়াটা হুট করেই যেন হয়েছে। ইতিহাসনির্ভর এ হুররাম চরিত্রের জন্য উপযুক্ত কাউকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। ৮ মাস ধরে চলে ‘হুররাম’-এর খোঁজ। এরপর ২০ হাজারের বেশি প্রতিযোগীকে পেছনে ফেলে ওই চরিত্রের জন্য নির্বাচিত হন মারিয়েম।
সুলতান সুলেমানে সম্পৃক্ত হওয়া প্রসঙ্গে বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে ৩২ বছর বয়সী মারিয়াম বলেন, ‘হঠাৎ শুটিংয়ের জন্য তুরস্কে আসার আমন্ত্রণ জানানো হয়। শুটিংয়ের জন্য পাক্কা দুই বছর হোটেলেই থাকতে হয়েছে আমাকে। ‘সুলতান সুলেমানের আগেও জার্মান প্রডাকশনে টেলিভিশন সিরিজ নটরুফ হাফেনকান্তে, আইন ফাল ফুয়ের সোয়াই ছাড়াও সিনেমা জার্নি অব নো রিটার্ন, ইয়েটস আবের বালেট ছবিতে অভিনয় করেন মারিয়াম। তবে ২০১১ সালের সুলতান সুলেমানে অভিনয়ের মধ্য দিয়েই সর্বাধিক খ্যাতির দেখা পান এ তারকা। সিরিয়ালে ব্যতিক্রমধর্মী অভিনয়ের জন্য ২০১২ সালে তিনি পেয়ে যান গোল্ডেন বাটারফ্লাই অ্যাওয়ার্ড। নিউইয়র্কভিত্তিক ম্যান’স ম্যাগাজিন জিকিউয়ের দৃষ্টিতে নির্বাচিত হন ‘ওমেন অব দ্য ইয়ার’ হিসেবে।
হুররাম সুলতানের ভূমিকায় অভিনয় করা মারিয়েম জারলি: তাঁর জন্ম ১৯৮৩ সালের ১২ আগস্ট, জার্মানিতে। বাবা তুরস্কের, আর অভিনেত্রী মা জার্মানির। সে সূত্রে মারিয়েম তুরস্ক ও জার্মানি—উভয় দেশেরই নাগরিক। তবে ছোটবেলা থেকে বেড়ে উঠেছেন জার্মানিতেই। সেখানেই অল্প বিস্তর অভিনয় আর মডেলিং করে নাম করছিলেন তিনি।২০১০ সালের শেষের দিকে ভাগ্যটা একেবারে বদলে যায় মারিয়েমের। তুরস্কের ৬০০ বছরের অটোমান সাম্রাজ্যের অন্যতম সফল শাসক সুলতান সুলেমানকে নিয়ে একটি টিভি ধারাবাহিক নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয় তখন। আর সেখানে সুলতান সুলমানের অপূর্ব সুন্দরী দাসী থেকে স্ত্রী বনে যাওয়া হুররামের চরিত্রে অভিনয় করার জন্য ডাক পান মারিয়েম।এই ধারাবাহিকে হুররাম চরিত্রটি শুধু সৌন্দর্যের নয়; বুদ্ধিদীপ্ত, প্রাসাদ ষড়যন্ত্র আর ক্ষমতার সর্বোচ্চটুকু নিজের করে নেওয়া রহস্যময়ী এক নারীরও। এই সব কটি বিষয়ই এত সুন্দর করে পর্দায় তুলে ধরেছেন মারিয়েম; যেন বাস্তবের মারিয়েম আর পর্দার হুররাম একাকার হয়ে গেছেন। আর এর মধ্য দিয়েই সত্যিকারের তারকাখ্যাতি ধরা দেয় তাঁর কাছে।২০১১ সাল থেকে এই ধারাবাহিকের শুটিং শুরু হয়। তখন জার্মানি থেকে তুরস্কে চলে আসেন তিনি। ওঠেন একটি হোটেলে। যত দিন তিনি এই ধারাবাহিকটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তত দিন তাঁর বাস এই হোটেলেই ছিল। এখানে থেকেই ধারাবাহিকটির যাবতীয় কাজ করেছেন তিনি।
হঠাৎ বদল: ২০১৩ সালে মে মাসে হঠাৎ করেই ধারাবাহিকটিতে অভিনয় বন্ধ করে দেন মারিয়েম। তুরস্কের গণমাধ্যমের কল্যাণে প্রথমে খবর রটেছিল, এই ধারাবাহিকের প্রধান চরিত্র সুলতান সুলেমান হিসেবে অভিনয় করা হালিত এরগেনচের চেয়ে কম সম্মানী পাওয়ায় তিনি কাজ বন্ধ করে দিয়েছেন। তবে সেটি ধোপে টেকেনি এ কারণে যে মারিয়েম তো এত দিন এই সম্মানীতেই কাজ করেছেন। কখনো বিষয়টি নিয়ে তিনি আপত্তি তোলেননি। তা ছাড়া এই চরিত্রে অভিনয় তাঁকে যে খ্যাতি আর সম্মান এনে দিচ্ছিল, সেটা তিনি ভালোভাবেই উপভোগ করছিলেন।
এরপর কেঁচো খুঁড়তে অনেকটা সাপ বেরিয়ে আসার মতো ঘটনা ঘটল। জানা গেল, প্রেমিক চান এতেশের কাছ থেকে চূড়ান্ত প্রতারণার শিকার হয়েছেন তিনি। ওই সময় পাকিস্তানের সাংবাদিক আয়েশা আরমানকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মারিয়েম বলেন, ‘আমি ভুল মানুষকে ভালোবেসেছি।’ এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, তাঁর আর চানের মধ্যে সম্পর্কটা ছিল বাইরে খেতে যাওয়া, ঘুরতে যাওয়া পর্যন্তই। পরিচিতরা চানের মতো প্লেবয়ের সঙ্গে গভীর সম্পর্কে না জড়ানোর পরামর্শ দিয়েছিল। তাদেরও সম্পর্কটা গভীর করার ভাবনা ছিল না। তবে তিনি নিজেই একসময় চানের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েন।
মারিয়েমের ভাষায়, তিনি দীর্ঘদিন পরিবার থেকে দূরে ভিন দেশের এক হোটেলে থাকতে থাকতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। ধারাবাহিকের কাজ ছাড়া বাইরে তেমন একটা যাওয়া হতো না তাঁর। জার্মানিতে বড় হওয়ায় তুরস্কে তেমন কোনো বন্ধু-বান্ধবও ছিল না তাঁর। নির্ভুল কাজ করতে গিয়ে তিনি রাতের পর রাত না ঘুমিয়ে চিত্রনাট্য মুখস্থ করেছেন। সব মিলিয়ে চাপ আর একাকিত্বে ছিলেন তিনি। তাঁর এই জীবনে চান ছিল মুক্তির আলোর মতো। তাই ধীরে ধীরে তাঁর প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েন তিনি। তাঁর প্রেমিকও সেই সুযোগটা নেন।
মারিয়েম বলছিলেন, যখন প্রেমিক চানকে তিনি জানান যে তাঁদের জীবনে সন্তান আসতে যাচ্ছে, তখন প্রেমিকের ভিন্ন রূপ দেখেছেন তিনি। তাঁর ভাষায়, চান এতেশ এ খবর শুনে বলেন যে এই সন্তানের দায়দায়িত্ব তিনি নিতে পারবেন না। তাঁর ঘরে স্ত্রী আর দুই সন্তান আছে। ভালো ক্যারিয়ারের কথা চিন্তা করে তিনি গর্ভপাত করার পরামর্শ দেন মারিয়েমকে। তবে মারিয়েম জারলি সেটা করেননি। তিনি প্রেমিককে ছেড়েছেন। আর অনাগত সন্তানকে আঁকড়ে বাঁচার জন্য তুরস্কের সব পাট চুকিয়ে তিনি জার্মানিতে পরিবারের কাছে চলে যান। ফলে হুররাম চরিত্রটিতে তাঁর আর অভিনয় করা হয়নি। ধারাবাহিকটির কর্তা ব্যক্তিরা নতুন আরেকজনকে এই চরিত্রে অভিনয়ের জন্য নেন। বর্তমানে ৩৪ বছর বয়সী এই অভিনেত্রী ফুটফুটে এক মেয়ের মা। তথ্যসূত্র: প্রথম আলো, আলোকিত বাংলাদেশ।