নরসুন্দা ডটকম ডেস্ক:
কিছুদিন আগে পার্ক স্ট্রিটের অক্সফোর্ড বুক স্টোরে দু’দিনব্যাপী বাংলা সাহিত্যের উৎসব বসেছিল। এটা উৎসবের দ্বিতীয় বছর। আয়োজক এ পি জে সংস্থার সঙ্গে মুখ্য সহযোগী প্রকাশন সংস্থা পত্রভারতী।
শঙ্খ ঘোষ উদ্বোধন করলেন। অনেক নামী–দামি সাহিত্যিক অংশ নিলেন। বাংলাদেশ থেকে এসেছিলেন সেলিনা হোসেন।
ছিলেন শিল্প–সংস্কৃতি জগতের বিশিষ্টরা। যাঁরা নিজেরা সাহিত্য করেন, সাহিত্য নিয়ে কাজ করতে ভালবাসেন। বাংলার সেই শিল্পীদেরও পাওয়া গেল যাঁরা গল্প, উপন্যাস, কবিতার সঙ্গে ছবি এঁকে, বইয়ের প্রচ্ছদ তৈরি করে পাঠকের মন জয় করে রেখেছেন। আর ছিলেন অপেক্ষাকৃত তরুণ ও কৃতী, কম নামী ও অনামী, সু–নামী এবং বদনামী (একমাত্র আমি) লেখকরাও।
বাংলা সাহিত্য নিয়ে জটিল, কুটিল, আকর্ষণীয়, জ্ঞানগর্ভ, হালকা আলোচনার সঙ্গে ছিল সাহিত্য বিষয়ক কুইজ, বিখ্যাত চরিত্র নিয়ে সাজুগুজু, শব্দ নিয়ে খেলা, অণু–পরমাণু গল্পের প্রতিযোগিতা। হইচই ব্যাপার। এসব আসল কথা নয়, আসল কথা হল, দু’দিনের এই সাহিত্য আসরে এক ধরনের ‘কর্পোরেট মেজাজ’ দেখলাম। প্রথম বছরের থেকে এবার আরও বেশি।
এটা আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। শুধু যে ঝাঁ–চকচকে চেহারা ছিল তা নয়, গোটা অনুষ্ঠানের মধ্যেই ছিল এক ধরনের পরিকল্পনা, শৃঙ্খলা, হাসিমুখ অথচ শক্ত হাতে লাগাম ধরার ব্যাপার। সব মিলিয়ে বহু ঘণ্টার ব্যাপার। সাহিত্য আসর মানেই আমরা জানি আলসেমি। এলিয়ে থাকা ভাব। হেলতে–দুলতে দেরি করে আসাটাই নিয়ম। মঞ্চে অনুষ্ঠান চলার সময় নিজেদের মধ্যে দল পাকিয়ে গুলতানি। ইচ্ছেমতো চা, সিগারেট। শ্রোতার থেকে লেখকের বেশি গুরুত্ব। তাঁকে নিয়ে ‘আসুন বসুন’ করতে হবে। তাঁর গলায় মালা, হাতে ফুল দিতে হবে। এই সাহিত্য আসরে দেখলাম অন্যরকম।
লেখকদের যত গুরুত্ব, পাঠকদের গুরুত্ব তার থেকে কম কিছু নয়। অতিথি লেখক কেউ এলে তাঁকে গেট থেকে ‘রিসিভ’ করবার জন্য নির্দিষ্ট লোক রয়েছে। ব্যস এইটুকু। নাম ডাকা হলে তাঁকে নিজেই চলে যেতে হচ্ছে মঞ্চে। সেখানে তাঁর হাতে আসছে কফিভর্তি মগ। শ্রোতারাও পাচ্ছেন। চিরাচরিত ‘এলিয়ে পড়া’ টাইপ সাহিত্য উৎসব যে খারাপ এমন কথা আমি বলছি না। সাহিত্য তো আর কোট প্যান্ট, টাই বা খটখট আওয়াজ করা জুতো নয়। অনেক সময় তাকে আলস্যের মধ্যেই জারিত হতে হয়। থাকতে হয় অন্যমনস্ক। অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ডের মতো বারবার পকেট থেকে ঘড়ি বের করে দেখা তার কাজ নয়। কিন্তু মনে রাখতে হবে, চারপাশ বদলাচ্ছে। বদলাচ্ছে লেখকও।
অতীতের মতো আজও অনেক লেখক প্যান্টের ওপর পাঞ্জাবি পরতে স্বচ্ছন্দবোধ করেন। কিন্তু এসেছে ব্র্যান্ড। প্যান্ট হয়েছে লিভাইসের জিনস, পাঞ্জাবি হয়েছে ফ্যাভ ইন্ডিয়া। পকেটে স্মার্ট ফোন। অবিরত চলছে ফেসবুক, টুইট, ওয়াটসঅ্যাপ। তাতে নিজের লেখার প্রচার, অন্যের লেখার খবরাখবর। লেখকরা এখন পত্রপত্রিকায় লেখা পাঠাচ্ছেন মেল করে। শুধু লিখেই ক্ষান্ত নন, বইয়ের প্রোডাকশনে নজর দিচ্ছেন। পত্রিকায় একটা গল্প ছাপতে গিয়ে সম্পাদক অলঙ্করণ, ডিজাইন নিয়ে মাথার চুল ছিঁড়ে ফেলছেন। সব কিছু এত বদলাচ্ছে,
বাংলা সাহিত্য আসরের চেহারাই বা বদলাবে না কেন? অক্সফোর্ড বুক স্টোরের আসরে একদল ঝকঝকে ছেলেমেয়ে ক্যামেরা, ল্যাপটপ নিয়ে বসেছিল সর্বক্ষণ। তারা প্রতিটি মুহূর্ত আপলোড করছে। ফেসবুকে পাঠাচ্ছে। নির্দিষ্ট সাইটে লাইভ দেখাচ্ছে। এই কাণ্ড দেখে তো আমি থ। এসব নাচ–গানের অনুষ্ঠানে হয়। রাজনৈতিক নেতাদের বক্তৃতাতেও আজকাল হচ্ছে। বাংলা ভাষার শিল্পী–লেখকদের জন্যও এই আয়োজন করা যায়! দারুণ ব্যাপার! সাহিত্যের আসর তাহলে স্মার্ট হচ্ছে। সব থেকে আনন্দের কথা, দু’দিনই আমি ঠাসা ভিড় দেখেছি। এত পাঠক! এখানে শ্রোতারা শুধু লেখকদের ভাষণ শুনছিলেন এমন নয়, প্রশ্নবাণে জর্জরিতও করছিলেন।
বাঙালি লেখকদের ইংরেজি গল্প–উপন্যাস ঘিরে উন্মাদনা দেখে যে সব বাংলা ভাষার লেখক ‘বাংলায় কেন লিখি’ ভেবে লজ্জা পান, আপশোস করেন, তাঁরা এই দু’দিন অক্সফোর্ড বুক স্টোরে এলে হয়ত খানিকটা সান্ত্বনা পেতেন। কোনও সন্দেহ নেই, এই ধরনের আয়োজন বাংলা বইয়ের পাঠক, বাংলা বইয়ের প্রকাশক, বাংলা বইয়ের লেখকদের জন্য জরুরি।
টাকা–পয়সার আড়ম্বর নেই, কিন্তু মনোভাব স্মার্ট। কেউ যদি মনে করে, আমি আসলে লম্বা–চওড়া কথা বলে এই অনুষ্ঠানের পাবলিসিটি করছি, আমি বলব, বেশ করছি। বাংলা ভাষা, বাংলা সাহিত্যের প্রচার করার জন্য আমি গর্বিত। সুযোগ পেলেই করব। তবে এই উৎসবে কিছু ত্রুটি এবং খামতি হয়েছে। কোনও কোনও গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক বাদ গেছেন, কোনও কোনও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বাদ গেছে। প্রকাশকদের অংশগ্রহণ চোখে পড়ার মতো নয়। লিটল ম্যাগাজিন কই? যে পাঠক নিবিষ্টভাবে আলোচনা শুনে প্রশ্ন করলেন, তিনি কি হাতে একটা সার্টিফিকেট পেতে পারতেন না? সেটা হয়ত তাঁকে আরও উৎসাহ দিত। আমি জানি, কী কী হয়নি সেটা আলোচনার বিষয় হতে পারে না। কী কী হয়েছে সেটাই আসল। তারপরও বললাম। বাংলা সাহিত্যের অতীতকে যথাযথ সম্মান দেখিয়ে, বর্তমানকে সামনে এনে, ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবনা–চিন্তায় এই সাহিত্য আসর দৃষ্টান্ত তৈরি করল।
আমি আবার বলছি, সব থেকে বড় পাওনা এর কর্পোরেট–সুলভ ভঙ্গি। যে ভঙ্গি বলে, বাংলা বই যেমন মননের, তেমন অর্থকরীরও। এটা একটা শিল্প। বহু মানুষের অন্নসংস্থানের পথ। একজন লেখক থেকে একজন ভ্যানরিকশা চালকও এর ওপর নির্ভরশীল। এটা এড়িয়ে গেলে চলবে না। অবশ্যই আর–পাঁচটা শিল্পের থেকে সে আলাদা, কিন্তু বিচ্ছিন্ন নয়। ইংরেজি ভাষার বই গোটা বিশ্বে একটা বড় শিল্প। লেখার পর বইকে একটা ‘প্রোডাক্ট’ হিসেবে দেখা হয়। বইয়ের প্যাকেজিং, পাবলিসিটি, মার্কেটিং আর–পাঁচটা মূল্যবান সামগ্রীর মতো।
বাংলা বইয়ের বাজার কিন্তু একেবারে খুব ছোট নয়। কিন্তু সেই বাজারে পৌঁছনো যাচ্ছে না। তাকে নিয়ে নতুন করে ভাবার সময় এসেছে। বাংলা বই থেকে একটা বড় প্রজন্ম মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। ব্যবসা ভাল নয়। ক্ষতির আশঙ্কায় প্রকাশকরা বই করতে চান না। বইয়ের বিক্রিবাটা নেই। বহু নতুন লেখক সুযোগ পাচ্ছেন না। তার অনেক কারণের একটা হল, বাংলা বই নিয়ে ‘এলিয়ে পড়া’ ধরনের ভাবনা।
গোটা ভঙ্গির মধ্যে ‘দেরি করে আসব’, ‘গুলতানি মারব’, আমি লেখক, আমি পাঠক, আমি শিল্পী, আমি প্রকাশক— ব্যস এতেই তৃপ্তি, এতেই ফাঁপানো অহঙ্কার। বাংলা বইয়ের কী হল তাতে কী এসে যায়! এই করতে করতে অনেকটা তলিয়ে যেতে বসেছে। টাকা ফেরত আসার সম্ভাবনা কম বলে বাংলা বইয়ের পেছনে বিনিয়োগ নেই। তাই ভাল বইয়েরও প্রচার নেই। যেন ধরেই নেওয়া হয়েছে, বাংলা বই মানে খুঁড়িয়ে চলতে হবে, বাংলা বই মানে হাতে গোনা কয়েকজন পড়বে, বাংলা বই মানে ধূসর, মলিন, দারিদ্র্য। ঝাঁকুনি দরকার।
কোনও কোনও প্রকাশক নানাভাবে চেষ্টা করছেন। যাঁদের আর্থিকভাবে অতটা ক্ষমতা নেই তাঁরা সামর্থ্য অনুযায়ী ভাবছেন। সবাই নিশ্চয় এই ভাবনার শরিক হবেন। বাংলা বইকে খুঁজে নিতে হবে, এলিয়ে পড়া ভঙ্গি নাকি কর্পোরেট মেজাজ— কীভাবে সে চলবে?
নোট: লেখাটি কলকাতার দৈনিক আজকাল থেকে নেয়া।