দারিদ্র্য নাকি কাজী নজরুল ইসলামকে মহান করেছিল। দিয়েছিল খ্রিষ্টের সম্মান। কথাটা সত্য হলে মানতেই হবে যে, অভাব-দারিদ্র্য এবং কষ্টবোধ মানুষকে বড় হতে প্রেরণা যোগায়। বড় মানে ধনবান নয়। নয় বিত্ত-বৈভবের সমারোহ। বড় মানে অনেকের মধ্যে অনন্য হওয়া, অসাধারণ হওয়া। কাজী নজরুল ইসলাম সেটি হতে পেরেছিলেন। কিভাবে পেরেছিলেন তা সকলেরই জানা। তিনি সাহিত্যের ঐশ্বর্যে এতো ‘বড়’ হয়েছিলেন যে, জীবদ্দশায় এমনকি মৃত্যুর পরেও তাঁর সাহিত্য-ঐশ্বর্য তাঁকে খ্রিষ্টের সম্মানে মহিয়ান করে রেখেছে। কাজী নজরুল বৈষয়িক দিক থেকে দরিদ্র ছিলেন সত্য, মনের দিক থেকে নয়। বৈষয়িক দারিদ্র্য হয়তো ঘোচানো যায়, মনের দারিদ্র্য ঘোচানো বড়ই কঠিন। বৈষয়িক দারিদ্র্য ঘোচানোর জন্য প্রয়োজন অর্থকড়ির। মনের দারিদ্র্য অর্থকড়িতে ঘোচে না। সমাজে অনেক অর্থশালী আছেন যারা বৈষয়িক দারিদ্র্য থেকে যোজন যোজন দূরে। কিন্তু তাদের কারো কারো মনের দারিদ্র্য এতোই প্রকট যে, এদের জন্য আমাদের করুণা হয়। এই দুর্ভাগা দরিদ্রের সংখ্যা এদেশে দিন দিন বেড়েই চলেছে। এদের দারিদ্র্য ঘোচাতে প্রয়োজন নির্মল সাহিত্য, সুস্থ সংস্কৃতি, নিঃশর্ত জ্ঞানসাধনা। যতদিন তারা সেটি না পারবে ততদিন বিত্তের বড়ত্ব থাকলেও তারা মানবিক বড়ত্বে উন্নীত হতে পারবে না। এটি অলঙ্ঘনীয় সত্য।
মানুষ মাত্রই বড় হতে চায়। বড় হতে চাওয়া অন্যায় কিছু নয়। বৈষয়িক বড়ত্বই মানুষের প্রথম চাওয়া। এ বড়ত্ব মানুষকে বড় করে না। বড় করে মানবিক বড়ত্ব। চিন্তায়, চেতনায়, মূল্যবোধে বড় হতে পারা মহত্তর অর্জনেরই নামান্তর। এ অর্জন সবার দ্বারা সম্ভব নয়। সবাই পারেও না। যারা পারে তারাই অনন্য, অসাধারণ। সৃজনশীল চিন্তার মানুষ যারা তাদের মূল্যবোধ আর দশজনের চেয়ে অবশ্যই প্রখর। বিত্ত তাদের চিত্তকে পরাস্ত করতে পারে না। তারা বড় কিছু করার নেশায় এতোটাই বিভোর থাকেন যে, বড়ত্বের মহিমায় জাগতিক স্বাচ্ছন্দ্যকেও তারা অবলীলায় বিসর্জন দেন। একথা সব সৃজনশীলের ক্ষেত্রে হয়তো প্রযোজ্য নয়, কিন্তু প্রকৃতই যারা নির্মোহ এবং সৃষ্টিশীল মানুষ তাদের কাছে ব্যক্তিগত সুখ-সাচ্ছন্দ্য কখনোই প্রাধান্য পায় না।
একজন সাহিত্যিক সমাজের আর দশজন মানুষের মতোই সামাজিক জীব। তারও থাকতে পারে অভাব, দারিদ্র্য, প্রাপ্তির নেশা। কিন্তু তার নেশাটি কখনোই অন্যদের মতো রূঢ় হবে না। তার প্রাত্যহিক প্রয়োজনটি প্রকাশিত হয় কোমল আবেগে, শিল্পীত ঢঙে। সৃষ্টিশীল মানুষ হিসাবে একজন সাহিত্যিকের কাছ থেকে কেউ রূঢ়তা আশা করে না। রূঢ়তা সাহিত্যিকের স্বভাব বিরুদ্ধ। মানুষ একজন সাহিত্যিককে সাদামাটা, নির্লোভ ও নির্মোহ দেখতেই অভ্যস্ত। সাহিত্যিক মানে নির্মল চিন্তার মানুষ। তিনি হবেন ফুল-পাখি-প্রকৃতির মতোই উদার এবং সুন্দর। মানুষের এই প্রত্যাশাকে সাহিত্যিকও উপলব্ধি করেন। উপলব্ধি করেন বলেই তিনি বিত্ত-প্রত্যাশী নন। তিনি শুধুই চিত্তের কাঙাল। একজন সাহিত্যিককে একটি ফুল দিয়ে যত সহজে জয় করা সম্ভব, অন্যের ক্ষেত্রে তা ততটাই অসম্ভব।
লেখক মানেই সাহিত্যের কর্মী। যারা সাহিত্য করেন তাদের অন্তর্চক্ষু থাকে উন্মীলিত। অন্তর্চক্ষু একজন সাহিত্যিককে অনেক কিছুই দেখিয়ে দেয়। সাধারণ মানুষ সাদা চোখে যা দ্যাখে না, একজন সাহিত্যকর্মী তা-ও দেখতে পান নিবিড় পর্যবেক্ষণে। এখানেই অন্যের সাথে সাহিত্যকর্মীর ভিন্নতা। এখানেই স্বাতন্ত্র্য। সাহিত্যকর্মী একের মধ্যে অনেককে দেখতে পান, অনেক কিছুই দেখতে পান। দেখতে পারার এই শক্তিই একজন সাহিত্যিককে বড় করে, অনন্য করে।
শুধু সাহিত্য করে জীবন চলে না। অতীতেও চলেনি। সবাই তো আর রবীন্দ্রনাথ-মাইকেল নয়। পিতৃ-বৈভব সব লেখকের ভাগ্যে জোটে না। তাই লেখককেও কিছু একটা করতে হয়। এই কিছু একটা করার ‘শৃঙ্খল’ একজন লেখকের জন্য নির্মম নিয়তি। যে নিয়তির ঘেরাটোপে লেখকের সৃষ্টিকর্ম বাধাপ্রাপ্ত হয়। মূল্যবোধ হয় শৃঙ্খলিত, চিন্তার জগত হয় অবরুদ্ধ। লেখকের ‘বড়’ হওয়ার পথে জীবিকার তাগিদ একটি বড় অন্তরায়। এ অন্তরায় দূর করার সহজ কোনো রাস্তা নেই। বাস্তবতার নিষ্ঠুর অভিঘাতে লেখকের সুন্দর স্বপ্নগুলো বারবার হোঁচট খায়। পা’ পিছলে পড়ে।
যারা সুন্দরের আরাধনা করেন তাদের মধ্যে লেখকসমাজ অন্যতম। দেশের এই অন্যতম শক্তিকে টিকিয়ে রাখার দায় যাদের তারাও লেখকের সমস্যা নিয়ে খুব একটা গা করেন না। যা কিছু সুন্দর, যা কিছু কল্যাণকর তা বাঁচিয়ে রাখার দায় যেন শুধুই লেখকের। লেখকের দায় সমাজ নেবে না, রাষ্ট্রও নেবে না। এভাবে সুন্দরের চর্চা সম্ভব নয়; সম্ভব নয় মূল্যবোধের পরিচর্যা করা।
রাষ্ট্রের পরিচয় বিকশিত হয় সাহিত্যের মাধ্যমে, সংস্কৃতির মাধ্যমে। রাষ্ট্রের মানুষকে সাহস যোগায় সৃষ্টিশীল সাহিত্য। নজরুলের কবিতা ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে, এমনকি আমাদের মুক্তিযুদ্ধে কামানের গোলার চেয়ে কোনো অংশে কম ভূমিকা রাখেনি। এই সত্য সবাই স্বীকার করলেও লেখকের মূল্যায়ন সেভাবে স্বীকৃত নয়। রাষ্ট্র যতক্ষণ সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক না হবে ততক্ষণ লেখকের দৈন্য ঘুচবে না। লেখকের দৈন্য না ঘুচলে বড় মাপের সাহিত্যও হবে না। যে রাষ্ট্রে বড় মাপের সাহিত্য নেই, সে রাষ্ট্র ঐশ্বর্যহীন, পশ্চাৎপদ। ঐশ্বর্যহীন ও পশ্চাৎপদ রাষ্ট্রে চিন্তার মুক্তি কখনোই ঘটে না। এ রকম রাষ্ট্রে প্রগতি মূল্যহীন, মূল্যবোধ পর্যুদস্ত। আর মূল্যবোধ বিবর্জিত রাষ্ট্রের একমাত্র ভূষণ হচ্ছে দারিদ্র্য।
দারিদ্র্য ব্যক্তিকে মহান করতে পারে, রাষ্ট্রকে নয়। কল্যাণকামী রাষ্ট্রে দারিদ্র্য হচ্ছে অভিশাপের নামান্তর। দারিদ্র্য মানে শুধু আর্থিক দৈন্য নয়। চিন্তার দৈন্য, মানবিকতার দৈন্য, মূল্যবোধের দৈন্য। এ দৈন্য থেকে মুক্তির প্রধানতম অবলম্বন হচ্ছে সাহিত্য। সাহিত্যের মাধ্যমেই সম্ভব দৈন্যকে অতিক্রম করা। যারা সেই অতিক্রমের কাজটি করছেন, তাদের অর্থাৎ লেখকসমাজের দারিদ্র্য-মুক্তির বিষয়ে কারো কোনো ভাবনা নেই। যদিও ভাবনাটি একান্তই জরুরী, নিতান্তই আবশ্যক।
ক্রীড়া ও খেলাধুলা বলিষ্ঠ জাতি গঠনে ভূমিকা রাখে সন্দেহ নেই। খেলাধুলার মাধ্যমে বহির্বিশ্বে রাষ্ট্রের পরিচিতি বৃদ্ধি পায়, এতেও সন্দেহ নেই। এ কারণেই রাষ্ট্র খেলাধুলাকে যথাসাধ্য পরিচর্যা করে, পৃষ্ঠপোষকতা দেয়। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ গঠিতও হয়েছে এ কারণেই। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের নিয়ন্ত্রণে জেলায় জেলায় এবং থানা পর্যায়েও রয়েছে ক্রীড়া সংস্থার নিজস্ব অবকাঠামো। রয়েছে স্থানীয় কমিটি, কমিটির অনুকূলে বার্ষিক সরকারি বরাদ্দ। সবই ঠিক আছে। এসবের প্রয়োজনও অনস্বীকার্য। একজন ক্রীড়াবিদ তৈরির জন্য রাষ্ট্র প্রতি বছর যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে, ক্রীড়াবিদের স্বাচ্ছন্দ্য নিশ্চিত করার জন্য যেভাবে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়, তার ছিটেফোঁটাও কি আছে সাহিত্যের ক্ষেত্রে? নেই। কেন নেই সে প্রশ্ন আজ অবধি কেউ তুলেছেন বলে জানা যায় না। সাহিত্যের বিকাশ সাধনে সবেধন নীলমণি বাংলা একাডেমি রাষ্ট্রীয় অর্থে পরিচালিত হচ্ছে বটে, কিন্তু তার বিস্তৃতি কোথায়? জেলায় জেলায় ক্রীড়াসংস্থা এবং শিল্পকলা একাডেমির অবকাঠামো থাকতে পারলে বাংলা একাডেমির থাকবে না কেন? ৬৪ জেলায় বাংলা একাডেমির ৬৪টি অফিস এবং অবকাঠামো স্থাপন করা কি খুব কঠিন কাজ? মোটেই নয়। এক্ষেত্রে সদিচ্ছাই জরুরি। দুঃস্থ ও অসহায় সাহিত্যিকদেরকে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে নামমাত্র সম্মানী প্রদান করলেই সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা হয়ে যায় না। যে সাহিত্য জাতিকে উজ্জীবিত করে, সাহস যোগায়, সুন্দরের স্বপ্ন দেখতে উৎসাহিত করে, তার প্রতি রাষ্ট্রের উদাসীনতা শুধু দুঃখেরই নয়, লজ্জারও।
একজন ক্রীড়াবিদ সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পান। চাকরির পর খেলাধুলার জন্য অফিসেও পান বাড়তি সুযোগ। কিন্তু সাহিত্য করার যোগ্যতায় কোনো লেখক চাকরি-ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পেয়েছেন তার একটি উদাহরণও নেই। বরং চাকরির পর একজন সাহিত্যিকের লেখালেখির ক্ষেত্রে নেমে আসে ‘আচরণবিধি’ নামক নিয়ন্ত্রণের খড়গ। সাহিত্যিকের সামনে প্রতিনিয়ত বাধার দেয়াল। কোনোটি দৃশ্যমান, কোনোটি অদৃশ্যমান। চাকরিতে থেকে খেলাধুলা করলে বাধা নেই, বাধা আছে সাহিত্যকর্মে। এই বিপরীত চিত্র লেখকের জন্য অমোঘ ললাট লিখন। নিয়তির খড়গ সবসময় ঝোলে লেখকের ঘাড়ে।
এ অনিবার্য নিয়তি থেকে মুক্তির উপায় খুঁজতে হবে। রাষ্ট্র কেন নির্লিপ্ত থাকবে সাহিত্যের প্রতি? সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতার জন্য রাষ্ট্রকে অবশ্যই এগিয়ে আসতে হবে। ক্রীড়াবিদ তৈরির জন্য রাষ্ট্রের যে পরিচর্যা ও অর্থ ব্যয় তা সাহিত্যের ক্ষেত্রেও বিস্তৃত করতে হবে। সাহিত্যের জন্য গঠন করতে হবে পৃথক মন্ত্রণালয়। জেলায় জেলায় স্থাপন করতে হবে বাংলা একাডেমির শাখা অফিস। জাতির মানবিক দৈন্য ঘোচাতে সাহিত্য যদি ভূমিকাই রাখে তাহলে এর প্রতি অবহেলা কিছুতেই কাম্য নয়। লেখককে ‘বড়’ হবার সুযোগ দিতে হবে। সৃষ্টিশীল কর্মের মাধ্যমে দেশ ও জাতির জন্য ‘খ্রিষ্টের সম্মান’ অর্জনে লেখকই পারেন চিত্তের বিকাশ ঘটাতে। সুতরাং মননশীল সাহিত্য ও সাহিত্যিকের যথাযথ মূল্যায়ন আজ সময়ের সবচেয়ে বড় দাবি।
জাহাঙ্গীর আলম জাহান- ছড়াকার, লেখক।