মানুষ- সমাজ

সুবেদার মেজর মো. ইদ্রিস মিয়া, বীর প্রতীক

নরসুন্দা ডটকম   ডিসেম্বর ২২, ২০১৬

সুবেদার মেজর মো. ইদ্রিস মিয়া ছিলেন একজন অকুতোভয় সৈনিক। ১৯৭১ সালের মে মাসের শেষের দিকে তাঁর নেতৃত্বে এক কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধা নোয়াখালী জেলার বিবির বাজারে অবস্থিত বর্ডার সিকিউরিটি ক্যাম্পে পাক বাহিনীর শক্ত ঘাঁটির উপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। এসময় পাক হানাদার ও মুক্তিবাহিনী পাল্টাপাল্টি সশস্ত্র যুদ্ধে লিপ্ত হয়। হানাদারের ক্যাম্পে এক প্লাটুন পাক সেনা ছিল। ফলে উভয়পক্ষে প্রচণ্ড গোলাগুলির এক পর্যায়ে পাক হানাদার বাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়। তুমুল যুদ্ধের পর চারজন পাঞ্জাবি সৈন্যকে মুক্তি বাহিনীরা ধরে আনতে সক্ষম হয়। যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর তিনজন মুক্তিযোদ্ধা শাহাদাত বরণ করেন।

সুবেদার মেজর মো. ইদ্রিস মিয়া বীর প্রতীক কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার নীলগঞ্জ এলাকার বড়খাপন গ্রামে ১৯৩২ সালে জন্মগ্রহণ করেন। দুই ভাই তিন বোনের মধ্যে তিনি সবার বড় ছিলেন। গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষাগ্রহণের পর কিশোরগঞ্জ কটিয়াদী উচ্চবিদ্যালয় থেকে নবম শ্রেণী পাস করে দশম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। ছাত্রজীবনে একজন স্কাউটার ও ভালো ফুটবলার ছিলেন। পরে ১৯৪৪ সালের জুন মাসে ব্রিটিশের অধীনে ইন্ডিয়ান পাইওনিয়ার কোর্সে (আইপিসি) যোগদান করেন। ভারতের আড়ঙ্গবাদে ব্রিটিশ সৈন্যরা প্রশিক্ষণ দেন। ১৯৪৮ সালে ঢাকার পিলখানায় মেজর গণির নেতৃত্বে প্রথমে যে বেঙ্গল রেজিমেন্ট গঠিত হয় তাতে মো. ইদ্রিস মিয়া একজন সৈনিক হিসেবে যোগদান করেন।

১৯৫২-৫৩ সালে এম এ জি ওসমানী খুলনায় প্রথম বেঙ্গলের সিও ছিলেন। তখন তিনি তার সাথে ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের সময় তিনি সামরিক বাহিনীর ৪ নম্বর বেঙ্গল রেজিমেন্টের একজন সুবেদার মেজর ছিলেন।

১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল ব্যাটালিয়নকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে প্রেরণ করানো হয়। ২৬ মার্চেও আগে কুমিল্লা সেনানিবাস জনগণ দ্বারা অবরুদ্ধ হওয়ায় রসদপত্র সরবরাহ ও খাবার-দাবারের বিঘ্ন ঘটায় তাদের দলটিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পাঠানো হয়। ২৭ তারিখ দুপুরের পর পাক বাহিনীর সাথে দলটি বিদ্রোহ ঘোষণা করে এবং গোমতী নদীর তীরে ছাউনিসহ একটি অংশ ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় চলে যায়। এ সময় সুবেদার মেজর ইদ্রিসের নেতৃত্বে একটি দল গোমতী নদীর তীরে অবস্থানে ছিলেন। তখন তৎকালীন ক্যাপ্টেন এ টি এম হায়দার নদী পার হয়ে আসেন এবং জানতে চান চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল ব্যাটালিয়ন কোথায়? পরে সবাই মিলে সিলেটের তেলিয়াপাড়ায় পৌঁছে এক সপ্তাহ অবস্থানের পর ভারতের মতিনগর হয়ে মেলাঘরে চলে যায়। মেলাঘরে অবস্থিত ২ নম্বর সেক্টরের চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল ব্যাটালিয়নের মো. ইদ্রিস মিয়া সুবেদার মেজর হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। এ সময় তিনি বিভিন্ন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। একাত্তরের ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে তিনি ব্যাটালিয়নসহ ফেনী হয়ে চট্টগ্রামে চলে যান। সেখানে পাকিস্তানি নৌ বাহিনীকে আত্মসমর্পন করানো হয়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের সময় ভারতীয় বাহিনীও এতে যৌথভাবে অংশ নেয়। ১৯৭২ সালের মাঝামাঝি সময়ে ইদ্রিস মিয়া ঢাকায় বদলি হন। বদলি হওয়ার পরে মিরপুরে বিহারিদের সঙ্গেও তাকে লড়াইয়ে অংশ নিতে হয়।

মুক্তিযুদ্ধে অসম সাহসিকতা প্রদর্শনের জন্য বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৩ সালে সুবেদার মেজর মো. ইদ্রিস মিয়াকে বীর প্রতীক উপাধিতে ভূষিত করেন। তবে খেতাবের জন্য তিনি কোনো প্রকার আর্থিক সম্মানী পাননি।

মো. ইদ্রিস মিয়া ১৯৯০ সালের ২৫ জানুয়ারি বুধবার কিশোরগঞ্জের গ্রামের বাড়িতে মৃত্যুবরণ করেন। তার পাঁচ ছেলে ও ১১ জন মেয়েসন্তান রয়েছে। বড় ছেলে মো. রমজান মিয়া জানান, তার বাবা একাত্তরের একজন অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধা হলেও কোনো সরকারের আমলেই তাকে মূল্যায়ন করা হয়নি। তাঁকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফনও করা হয়নি। বসত ঘরের পাশে অত্যন্ত অবহেলায় তাঁর কবরটি অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে আছে। তারা কোনো সরকারি সাহায্য-সহযোগিতা পান না। এমনকি মুক্তিযোদ্ধা ভাতাও পান না। সামান্য জমিজমার উপর অনাহারে-অর্ধাহারে তাদের দিনাতিপাত করতে হয়। চাকরির জন্য তারা দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন। মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে তারা চাকরি পাননি। এসএসসি পাস ছোট ভাই মো. আরকান মিয়া ও অষ্টম শ্রেণী পাস মো. এরশাদ মিয়া যোগ্যতা অনুযায়ী বিভিন্ন সরকারি বিভাগে পিয়ন ও এলএমএসএস পদে নিয়োগের জন্য একাধিকবার আবেদন করেছেন। অথচ মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে তাদের চাকরি হয়নি।

ছেলে মো. আরকান মিয়া জানান, বাবা সবসময় আলবদর-রাজাকাররে বিরুদ্ধে ছিলেন। জীবদ্দশায় বাবা এদের বিচার দেখে যেতে পারেননি। তাঁর সন্তান হিসেবে রাজাকার-আলবদরদের বিচার চাই। মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে সরকারের কাছে যোগ্যতা অনুযায়ী তাদের চাকরি দেয়ারও আবেদন জানিয়েছে আরকান মিয়া।

সুবেদার মেজর মো. ইদ্রিস মিয়া বীর প্রতীকের বাবার নাম মো. হোসেন মিয়া, মায়ের নাম সুনাতন নেছা।

 

0022

লেখক: সাইফুল হক মোল্লা দুলু, সাংবাদিক

About the author

নরসুন্দা ডটকম

Leave a Comment