আমিনুল ইসলাম সেলিমের ‘জনক তুমি তীর্থভূমি’ বইটি আদ্যোপান্ত পড়লাম।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে রচিত ৩২টি ছড়া-পদ্যের সমন্বয়ে বইটি সাজানো হয়েছে। গতানুগতিক ছন্দের বাইরে বেশকিছু ছড়ায় ছড়াকারকে আন্তরিকভাবে নিরীক্ষাপ্রয়াসী মনে হয়েছে। ছড়াগুলোতে বঙ্গবন্ধুকে বিভিন্ন আঙ্গিকে উপস্থাপনের চেষ্টা আছে। ছন্দ নির্মাণে সেলিমের কূশলতা অবশ্যই ঈর্ষণীয়। স্বরবৃত্ত ছন্দের বাইরেও যে ছড়ার চালে গতিশীলতা আনয়ন করা সম্ভব সেটি বেশ বিশ্বাসযোগ্যভাবেই এ বইয়ে প্রমাণ করার প্রবণতা পাওয়া যায়।
সেলিম কবিতার চেয়ে ছড়াতেই অধিকতর সাবলীল ও প্রাণবন্ত তা বোঝার জন্য এ বই বেশ সহায়ক।
রবেন তিনি ঘরে ঘরে, আলোর কারিগর, মুজিবুর, জেনেছে বিশ্বময়, পিতার মৃত্যুদিনে, তুমি উজ্জ্বল তারা, হারামিরা, ইতিহাস, চিঠি, এসব খুবই অল্প প্রভৃতি ছড়ায় লেখকের নিরীক্ষাপ্রয়াস ভালো লেগেছে। তবে অনেক ছড়ায় অন্ত্যমিলের ক্ষেত্রে বেশকিছু অসঙ্গতি ও দুর্বলতা লক্ষণীয়। আমিনুল ইসলাম সেলিমের জানার কথা ‘ও’ ধ্বনির সাথে ‘উ’ ধ্বনির অন্ত্যমিল কখনোই যথার্থ নয়।
গ্রন্থভূক্ত ছড়াসমূহের নাম উল্লেখ না করেও তার ছড়ায় এ জাতীয় অন্ত্যমিলের কতিপয় উদাহরণ দেওয়া যাবে। যেমন: ‘ফুল’ শব্দের সাথে ‘দোল’, ‘মুজিবুর’ শব্দের সাথে ‘ভোর’, ‘চোখে’ শব্দের সাথে ‘দুখে’, ‘শোন’ শব্দের সাথে ‘খুন’, ‘পুঁজিত’ শব্দের সাথে ‘রোজই তো’ (পুজিত শব্দে চন্দ্রবিন্দুর ব্যবহার ভুল), ‘ধুক’ শব্দের সাথে ‘লোক’, ‘শুরু’ শব্দের সাথে ‘পুরো’ এবং ‘চূড়ো’ ইত্যাদি অন্ত্যমিল ছড়ার সৌন্দর্যকে অনেকাংশে ব্যাহত করেছে।
এছাড়াও অনেক ছড়ায় বানান ভুলের আধিক্য দৃষ্টিকটু ঠেকেছে। একটি ছড়ায় ‘উদিত’ শব্দের সাথে অন্ত্যমিল দিতে গিয়ে লেখা হয়েছে ‘খুদিত’। এ-রকম কোনো শব্দ বাংলা অভিধানে থাকার কথা নয়। প্রকৃতপক্ষে শব্দটি হবে ‘খোদিত’। অন্ত্যমিল সাজাতে গিয়ে মৌলিক শব্দের চরিত্রহানি করা কোনোভাবেই ঠিক হয়নি। ‘আপোষ’ শব্দটির প্রকৃত বানান হবে ‘আপোস’ বা ‘আপস’। ‘দুদুল দোল’ শব্দটির বানানও ভুল। হওয়া উচিত ছিল দোদুল দোল। জনারন্যে বানানে ‘ণ’ ব্যবহারই সঙ্গত। কয়েকটি ছড়ায় ‘সত্তা’ বানান সঠিক লেখা হলেও একটি ছড়ায় ভুল করে লেখা হয়েছে ‘সত্ত্বা’। অন্য একটি ছড়ায় লেখা হয়েছে ‘ভাঙচি’; যা হবে ‘ভাঙছি’। ‘চূড়া’ শব্দটি তৎসম শব্দ। কমবেশি সবাই জানেন যে, তৎসম শব্দকে তদ্ভব শব্দে রূপান্তর করা হলে শব্দের দীর্ঘ ঊ-কার পরিবর্তিত হয়ে হ্রস্ব উ-কার হয়ে যায়। যেমন তৎসম পূজা=তদ্ভব পুজো, তৎসম ধূলা=তদ্ভব ধুলো ইত্যাদি। সে নিয়মে চূড়া শব্দটি হবে চুড়ো। কিন্তু সেলিম লিখেছে চূড়ো; যা ভুল।
কিশোরগঞ্জে বসে এ প্রজন্মের যারা ছড়াচর্চা করছে তাদের মধ্যে সেলিম অবশ্যই অগ্রগণ্য একজন। তার ছড়ায় যথেষ্ট প্রতিশ্রুতি লক্ষণীয়। কিন্তু যথার্থ অন্ত্যমিল প্রয়োগে অমনোযোগিতা এবং বানানের শুদ্ধতা রক্ষায় নিস্পৃহতা মেনে নেয়া যায় না। তাই তাকে এ বিষয়ে আরও যত্নবান হওয়ার অনুরোধ করব।
উপরে বর্ণিত ত্রুটিগুলো এড়ানো গেলে জনক তুমি তীর্থভূমি একটি ভালো মানের ছড়ার বই হতে পারত। তদুপরি সেলিমকে সাধুবাদ জানাই। তাকে আরও মনোযোগে ছড়াচর্চায় ব্রতী হওয়ার অনুরোধ করি। ছড়ার নির্মাণ-প্রকৌশল না বুঝেই যারা ছড়া লেখেন তাদেরকে পঠন-পাঠনে অভ্যস্ত হওয়ার অনুরোধ জানাই।
জাহাঙ্গীর আলম জাহান: ছড়াকার, লেখক ।