ফিচার

দিবস উদ্‌যাপন ও তার ফলাফল : আবু তাহের খান

নরসুন্দা ডটকম   সেপ্টেম্বর ১৭, ২০১৮

১৯৪৫ সালের ২৬ জুন বিশ্বের ৫১টি দেশ সম্মিলিতভাবে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার যে সনদে স্বাক্ষর করে, সেটাই পরে কার্যকর হয় একই বছরের ২৪ অক্টোবর থেকে। আর তারই স্মরণে ১৯৪৮ সাল থেকে দিনটি (২৪ অক্টোবর) জাতিসংঘ দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে বস্তুত এটাই হচ্ছে দিবসকেন্দ্রিক উদ্যাপনের শুরু এবং যে দিনটি এখন জাতিসংঘের ১৯৩টি সদস্য রাষ্ট্রের সর্বত্রই অত্যন্ত মর্যাদার সঙ্গে উদ্‌যাপন করা হয়ে থাকে। পরে জাতিসংঘের বিভিন্ন অঙ্গ সংস্থা কর্তৃক আরো বেশ কিছু দিবসকে এভাবে উদ্যাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়, যার মধ্যে ইউনিসেফের আওতাধীন আন্তর্জাতিক শিশু দিবস (২০ নভেম্বর), ইউনেসকোর আওতাধীন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস (২১ ফেব্রুয়ারি) ইত্যাদি অন্যতম।

দিবসকেন্দ্রিক উদ্যাপনের এ ধারা পুঁজিবাদী বিনিয়োগকারীদের চিন্তায় শিগগিরই মুনাফার নতুন সূত্র খুলে দেয়। জাতিসংঘের এসব দিবস উদ্যাপনের রীতিকে অনুসরণ করে এবং একই সঙ্গে মানুষের আবেগ ও হুজুগেপনাকে পুঁজি করে তারা তাদের নিজস্ব ঢং ও আদলে আরো বেশ কিছু দিবসকে এ ধারার সঙ্গে কৌশলে যুক্ত করে দিয়েছে, যেগুলোর মধ্যে রয়েছে বিশ্ব ভালোবাসা দিবস, বিশ্ব মা দিবস, বিশ্ব বাবা দিবস ইত্যাদি। মানুষের কষ্ট, আনন্দ ও আবেগের অনুভবের পাখায় ভর করে এসব দিবস উদ্যাপনের রীতি এরই মধ্যে বিশ্বব্যাপী যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জনে সক্ষম হয়েছে এবং যতই এগুলো জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ততই স্ফীত হচ্ছে পুঁজিবাদী কারবারিদের মুনাফার পাহাড়। মার্কিন পরিসংখ্যান প্রতিষ্ঠান পরিসংখ্যানটি জানাচ্ছে, ২০১৮ সালের বিশ্ব ভালোবাসা দিবস উপলক্ষে সে দেশে শুধু ফুল, জুয়েলারি, কার্ড ও চকোলেট বাবদই ব্যয় হয়েছে প্রায় ২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর সঙ্গে আমোদ-প্রমোদ, বিনোদন, ডেটিং, আহার, পানীয় ইত্যাদির ব্যয় যোগ করা হলে তা প্রায় শত বিলিয়ন ডলারকে স্পর্শ করবে বলে অনুমান করা চলে। এখন ভাবুন, এ বাবদ সারা পৃথিবীতে মোট কত অর্থ ব্যয় হয়েছে আর বাংলাদেশের নাগরিক তরুণ-তরুণীই বা কত ব্যয় করেছে?

অর্থ ব্যয় তথা মুনাফার একই ধারা অনুরূপ অন্যান্য দিবসকে কেন্দ্র করেও একইভাবে কার্যকর রয়েছে বৈকি! এবং ধারণা করা যায় যে পুঁজির বিকাশ ও বিস্তারের ধারায় সামনের দিনগুলোতে এ মুনাফা বাণিজ্য আরো জোরদার ও স্ফীত হবে এবং ক্রমান্বয়ে তা অধিক জনসংখ্যা অধ্যুষিত অনগ্রসর দেশগুলোর দিকে অগ্রসর হতে থাকবে ও ধেয়ে আসবে। কারণ সেখানে মুনাফার হার কম হলেও ক্রেতার সংখ্যাধিক্যের কারণে সর্বাধিক মুনাফার পরিমাণ ঠিকই অনেক উঁচু পর্যায়ে উন্নীত হয়ে যাবে। এবং হলফ করে বলতে পারি, এসব দিবসকেন্দ্রিক আয়োজন ঘিরে পুঁজিবাদীদের আগামী দিনের মূল লক্ষ্যই হবে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলোর তরুণসমাজ, যারা এসব দিবসকেন্দ্রিক ভোগবিলাসকে রীতিমতো নেশার আদলে গ্রহণ করে বোধহীন ‘মুগ্ধতায়’ বুঁদ হয়ে থাকছে। তারা বুঝতেই পারছে না যে নিখাদ ভালোবাসার ভিত্তি কোনো একটি নির্দিষ্ট দিবসকে কেন্দ্র করে নির্মিত হয় না বা মায়ের প্রতি সন্তানের ঋণ মা দিবসের এক দিনের আয়োজনে পূর্ণতা পায় না। এসবের জন্য প্রয়োজন জীবনজুড়ে গভীর উপলব্ধি ও মমতার মানবিক বোধসম্পন্ন ধারাবাহিক নির্মাণ। কিন্তু আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায়, সামাজিক আচরণে এবং রাষ্ট্রীয় কাঠামোর অধীনে তরুণদের সেটি জানার ও তা বোঝার আয়োজন কতটাই বা আছে?

আরো পড়ুন…

পরিবেশ দূষণ : বাংলাদেশে এক বছরে মারা গেছে ৮০ হাজার মানুষ

নাগাল্যান্ডের আদিবাসীরা বন রক্ষার জন্য তাদের প্রাচীন ঐতিহ্য শিকার করা ছেড়ে দিয়েছে

অন্যদিকে জাতিসংঘের আওতাধীন দিবসগুলো পালনের ক্ষেত্রে বাস্তবায়নকারী দেশগুলোতেও লোক-দেখানো আনুষ্ঠানিকতার প্রাধান্য। এসব দিবস উদ্যাপনের কাজটি যেহেতু রাষ্ট্রীয়ভাবে হয়ে থাকে, সেহেতু সংশ্লিষ্ট সরকারগুলো এ কাজ যতটা না অন্তর্গত তাগিদ থেকে করে, তার চেয়ে বেশি করে দায় সারানোর কিংবা উদ্দেশ্যমূলক প্রচার-প্রচারণার প্রয়োজনে। ফলে এ ক্ষেত্রে যা হওয়ার তা-ই হচ্ছে। দিবসটি পার হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দিবস পালনের প্রকৃত উদ্দেশ্যটুকুও হারিয়ে যেতে থাকে। আর এসব দিবস উদ্যাপনের প্রস্তুতিতে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে যা যা করা হয় এবং যে যে খাতে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা হয়, সেসব নিয়েও প্রশ্ন তোলার অবকাশ রয়েছে। জনগণের কষ্টার্জিত করের অর্থ এসব আয়োজনে যেভাবে ব্যয় করা হয়, তা আসলে জনগণের প্রকৃত স্বার্থকে খুব সামান্যই রক্ষা করতে পারে। বলা হতে পারে যে এসব আয়োজনে ব্যয়িত অর্থের একটি বড় অংশই আসে উন্নয়ন সহযোগীদের দেওয়া অনুদান থেকে। অতএব, এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় অর্থ অপচয়ের প্রশ্নই আসে না। সে ক্ষেত্রে বিনীতভাবে জানাই, উন্নয়ন সহযোগীরা যে অনুদান-সাহায্য দিয়ে থাকে, সেটিও আসলে সদস্য দেশগুলোর জনগণের কষ্টার্জিত করের পয়সায় পরিশোধিত চাঁদা থেকেই দেওয়া হয়ে থাকে। আর অর্থ যে সূত্র থেকেই আসুক না কেন, মনে রাখা প্রয়োজন যে সেটি এ বিশ্বসম্প্রদায়েরই সম্পদ, যার হিস্যা এ দেশের জনগণেরও রয়েছে।

জাতিসংঘ সংশ্লিষ্ট দিবসগুলোর পালনপ্রক্রিয়ার আরেকটি দুর্বলতার কথা এখানে না বললেই নয় এবং সেটি হচ্ছে, এসব দিবস পালনের আয়োজনগুলো এখন পর্যন্ত মূলত শহরকেন্দ্রিক। গ্রামভিত্তিক সাধারণ মানুষ, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে যারা এসব দিবস পালনের মূল লক্ষ্য—জনগোষ্ঠী, তারা এসব আয়োজন থেকে বলতে গেলে বিচ্ছিন্নই থেকে যাচ্ছে। তাদের এ পালনপ্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত করতে না পারলে এসব দিবস পালনের আসল উদ্দেশ্যই অনর্জিত থেকে যেতে বাধ্য।

সব মিলিয়ে বিষয়টি দাঁড়াচ্ছে এই যে জাতিসংঘকেন্দ্রিক দিবসগুলোর পালনপ্রক্রিয়া অনেকটাই আনুষ্ঠানিকতাপ্রধান, লক্ষ্য—জনগোষ্ঠী থেকে বিচ্ছিন্ন এবং সেখানে অর্থের যথাযথ ব্যবহারের প্রশ্নটিও আসছে। অন্যদিকে ব্যবসাকেন্দ্রিক দিবসগুলো ঘিরে রয়েছে একচেটিয়া মুনাফা অর্জনের ছড়াছড়ি। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, দিবস পালনের অন্তর্গত দিকগুলোর ব্যাপারে বিশ্বের বেশির ভাগ দেশের সাধারণ মানুষই প্রকৃত অর্থে সচেতন নয়। আর এই অসচেতনতার কারণে একদিকে জাতিসংঘকেন্দ্রিক দিবসগুলো পালনের উদ্যোগ কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হচ্ছে এবং অন্যদিকে ব্যবসাকেন্দ্রিক দিবসগুলোর ক্ষেত্রে প্রকৃত মানবিক বোধ ও উপলব্ধিকে এড়িয়ে হুজুগেপনা ও ব্যবসায়ীদের মুনাফাই শুধু বাড়ছে।

লেখক : পরিচালক, ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট সেন্টার, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি। সূত্র: কালের কন্ঠ।

About the author

নরসুন্দা ডটকম