গল্প সাহিত্য

গল্প : দুই তিতলির বাসা – রাজেশ ধর

নরসুন্দা ডটকম   অক্টোবর ১৯, ২০১৮

ছোটো প্রজাপতিটা ভেলভেট কালো রঙের, দুই ডানায় সোনালি আর দুধ সাদা ফুটকির মোজাইক।বড়টা, ছোটটার থেকে একটু বড় দৈর্ঘ্যে।তার রঙ হালকা বাসন্তী, দুই ডানায় আবার গুনে গুনে তিনটে করে কচি কলাপাতা রঙের বিন্দু। উড়ছে ওরা বিকাশের শোবার ঘরটা জুড়ে।কখনো দুজনে একসাথে পাশাপাশি সোজা উড়ে এসে বসছে ঘরের দেয়ালে, কখনো দুজন পরস্পর নিজেদের মাঝখানে রেখে পাক খেতে খেতে ডানা কাঁপিয়ে এমনভাবে উড়ছে মনে হচ্ছে যেন নাচের প্রতিযোগিতার দুই প্রতিযোগী।মাঝে মাঝে বড়টা দুই ডানা না মেলে বসে পড়ছে ভাবটা এমন,একটু বিশ্রামের দরকার! কিন্তু ছোটটা বসতে দিলে তো!সে এসে দুই ডানা খুব দ্রুত কাঁপিয়ে বড়টার চারিদিকে গোল করে উড়তে থাকে।বাধ্য হয়ে বড়টা আবার ওড়ে।উড়ে চলে ছোটটাও।উড়তে উড়তে বড়টা এসে ছুয়ে দেয় বিকাশের কাঁধ।

 ‘বাবা এভাবে আর পারা যাচ্ছে না।তুমি চলে এসো।’

‘ কী করে যাই মা বল!’

‘ আমিও তো এভাবে আর পারছি না বাবা। এই এত হাজার হাজার মাইল দূরে থেকে কীভাবে তোমার দেখাশোনা করি বল তো! সব সময় দুশ্চিন্তায় থাকি।কখন কী হল!’

‘ এত ভাবিস না। আরেকজনও তো আছে।’

‘সবকিছুই দেখতে পাচ্ছি বাবা।কোনদিকে তার নজর!তোমার ওষুধগুলো তো নিশ্চই ফুরিয়েছে।এনে দিয়েছে সে?’

‘সবাই ব্যস্ত রে মা।বললেই কী আর হয়! কিন্তু আমি তো বেঁচে আছি।বেশ ভালোই আছি।সে আসে রে।যখনই সময় পায় চলে আসে।’

‘ তোমার প্রশ্রয়েই ছোটবেলা থেকে ও এরকম। ওকে তুমি কিছুতেই বড় হতে দিলে না বাবা!ওর সব বায়না মিটিয়ে যাচ্ছ।এখন বুঝতে পারছ তো।সব বায়না মেটানো যায় না।’

‘ তোর বায়না কি মেটাই নি?’

‘আমার কি বায়না ছিল বাবা! ভাল করে মনে করে দেখ তো?’

‘ তোকে তো মুখ ফুটে কিছু বলতে হত না!সেই তোর সব ইচ্ছেগুলো বুঝে বায়না করে আমার থেকে আদায় করে নি’ত।’

‘এমনভাবে বলছ বাবা।কত কী তোমার থেকে আদায় করেছি।কখনো নাচের জন্য ঘুঙুর কিংবা অঙ্কের একজন ভালো টিচার।এই তো! আর কী পেয়েছি তোমার থেকে।আর দেখো তো আমার ছেলের জন্য …’

‘থাক মা।যা পেরেছি তাই…তুলনা করিস না।ছাড় এসব কথা। আর কী বলবি বল?’

‘কী আর বলব! আমার ঐ একটাই কথা।নিজের জন্য না।তোমার জন্য।চলে এসো আমার কাছে।’

‘তুই তো জানিস সব।তবে বারবার কেন এভাবে বলিস?’

‘তবে থাক এইভাবে।আমার কী!’

 বিকাশ বারান্দার ইজচেয়ারটায় এসে বসে পড়ে।বারান্দার লম্বা মরচেধরা লোহার রেলিঙটা বরাবর টবে বসানো একগাদা ফুলগাছ।অল্প ছায়ায় বাঁচে এইসব গাছ। ফুলগুলোর দিকে নজর গেল বিকাশের। প্রজাপতি দুটো  উড়ে উড়ে টবগুলোর কাছে যাচ্ছে।একটা  অপেক্ষা করছে।অন্যটা  ফুলে বসে মধু খাচ্ছে।তারপর সে সরে এসে অপেক্ষা করছে অন্যজন এসে সেই ফুলে বসছে।

                                                                               ।। দুই ।।

বারান্দা পেরোলে কিছুটা জমি।ঠিক উঠোন না তার থেকে বেশ কিছুটা বেশি।ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বেশ কিছু ফল আর ফুলের গাছ।সাজানো গোছানো বাগান মোটেও না।বাগান করতে গেলে যে শখ, শক্তি লাগে বিকাশের তার কোনটাই নেই।তবুও বিকাশ প্রয়োজন বুঝে গাছগুলোতে জল দেয়, কোনটাকে আগাছা মনে হলে তুলে ফেলে।এর কোনোটাও বিকাশের হাতে লাগানো না। এখান থেকে ওখান থেকে গাছের চারা খুঁজে এনে মাটিতে পুতত ওরা দুজন।কয়েক প্রজন্ম ধরে রয়ে গেছে সেই গাছেরা।বিকাশের মনে পড়ে বিকেল বেলায় স্কুল থেকে বেরিয়ে প্রজাপতির ঝাঁক ছুটে যেত ওদের বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে আর সেই ঝাঁক থেকে বড় আর ছোট দুটো প্রজাপতি বেড়ার দরজা খুলে হাঁপাতে হাঁপাতে এসে থামত।হাতের গাছের চারা তুলে দেখিয়ে সে কী আনন্দ!জামা, কপাল,চোখ মুখ ঘামে ভেজা।দুটো বিনুনি নেতিয়ে পড়েছে।

  এক একদিন দুজনের শুরু হওয়া ঝগড়া স্কুল থেকে ফেরার অনেকক্ষণ পরেও থামতে চাইতে না।কে বেশি ভালবাসে- নিজেদের বাড়ির গাছগুলোকে, দেয়ালগুলোকে,টালির চাল ছেয়ে থাকা লাউগাছের সাদা ফুলেদের,বেড়ার গায়ের কামিনীর ঝোপকে। নিরুপায় হয়ে বিকাশ বকা দিয়ে থামাত।ব্যাস… জলের পাপড়ি ফুটে উঠত দুজোড়া চোখে।

‘আমাদের বাড়িটা সবথেকে সুন্দর…আর তুমি খুব… খুব ভাল বাবা! তাইত ওর থেকেও বেশি ভালবাসি তোমায় ।’

দুজনেরই  এক কথা। বলত এক একদিন এক একজন। তারপর জড়িয়ে ধরত ওকে।কিছুক্ষণ চুপচাপ… তারপর আবার শুরু হয়ে  যেত খুনসুটি।

বাড়ি ছিল না বিকাশের।শহরতলির গরীবের ছেলে।সামান্য আয়ের একটা কাজ জুটেছিল। তার আয়ে সেখানে কোনোমতেই বাড়ি করা যায় না।অথচ আজন্ম চেনা ভাড়া বাড়ি থেকে উচ্ছেদ হতে হয়েছিল একসময়।তারপর সেখান থেকে ট্রেন দূরত্বে প্রায় দেড় ঘন্টার পথ পেরিয়ে দুটো টালির চালের ঘর…এই বাড়িতে থিতু হয়েছিল সে।তখন ছিল কাঁচা রাস্তা,মাটির ঘরবাড়ি, মশা আর প্রচন্ড দারিদ্র্য। এখন দিনকাল অনেক বদলেছে।বিকাশের চুলগুলো সব সাদা।ট্রেনে করে দেড় ঘন্টা পেরিয়ে আর কাজ করার ক্ষমতা নেই। সারাদিন শুয়ে অথবা বারান্দায় বসে কাটে বিকাশের।দালালেরা নিয়ম করে কেউ না কেউ আসে রোজ।

‘ কাকু বেচে দিন।দুলাখ কাঠা যাচ্ছে।সারা জীবন কোনো শখআহ্লাদ করলেন না।টাকা পয়সা নিয়ে মেয়েদের কাছে চলে যান।নাতি নাতকুড় নিয়ে সুখে থাকুন।’

সামনের রাস্তাটা কুড়ি ফুট, পিচ হয়েছে।ম্যাজিক,বড় অটো যাচ্ছে।বাসও নাকি চলবে।বিকাশ চুপ করে থাকে।নজর চলে যায় সামনের গাছগুলোয়।উচু,নীচু গাছগুলোতে কত রঙবেরঙের পাখি,মৌমাছি,ভ্রমর,প্রজাপতি উড়ছে…ডালে,পাতায়,ফুলে বসছে আবার উড়ছে।বাঁশের চটা দিয়ে তৈরি ছোট দরজাটা খুলে ভেলভেট কালো প্রজাপতিটা ঢুকল উঠোনে।

 ‘ কে রে তুলতুল! আয় আয় মা। আমার পাশে এসে বস। আজ থাকবি তো?’

 ছোট প্রজাপতিটা ছটফটে বড় অধৈর্য।একটাও ফুলে বসছে না।বিকাশের খুব মায়া হয় ওর জন্য।কব্জির ওপর বসিয়ে ওকে খুব আদর করতে ইচ্ছা করে।অনেক আগে এই প্রজাপতিটা…ওর দুই ডানায় সোনালি আর দুধ সাদা ফুটকির মোজাইক …প্রতিদিন…বিকাশ বাড়ি ফিরলেই সে দৌড়ে এসে বিকাশের বুকের ওপর ঝাপিয়ে পড়ত।

আরেকটা যে বড় প্রজাপতি, সে বিকাশের কাছে আসত না।বিকাশকেই তার কাছে যেতে হত।তার মাথার মধ্যে থেকে কেমন একটা অচেনা মিষ্টি গন্ধ উঠে আসত। পাখির পালকের মত হালকা হাত দুটো দিয়ে বিকাশের কোমর জড়িয়ে ধরত সে।অনেক কষ্টে সেই বাঁধন খুলত বিকাশ।

 ‘কী করে থাকব! তুমি সব জানো না? কোথায় থাকব আমি! আমার কোনো থাকার জায়গা নেই।’

‘কেন রে! তোর এই বাড়িটা কি নেই?’

‘ বাবা এমন বোকা বোকা কথা বলে কী লাভ! তোমার জামাই কি বেকার… যে ঘরজামাই থাকবে?’

‘ কিন্তু তোর জন্য সে তো আলাদা কোনো থাকার জায়গা তৈরি করত পারল না আজ পর্যন্ত! আর তুইও শ্বশুরবাড়ির সাথে মিলে থাকতে পারবি না।আর ওখানে তো খুব ঘিঞ্জি!’

‘কিন্তু তার জন্য তো তোমার কাছে কোনোদিনও হাত পাতি নি বাবা।আর তুমিও তো মুখ তুলে দেখলে না আজ পর্যন্ত।মা যে কদিন ছিল…ব্যাস ঐ্টুকুই।সব দায় আমার ঘাড়ে চাপিয়ে একজন স্বর্গে আর একজন সাত সমুদ্দুর পেরিয়ে রাজ সিংহাসনে বসে আছে।’

পা দাপিয়ে খুব জোরে উড়ে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল ছোট্ট প্রজাপতি।টুকটাক ঘরকরনার শব্দ আসতে লাগল।বিকাশ নিজেকে প্রশ্ন করল।কেন দুটো প্রজাপতি ওকে নিয়ে এত চিন্তা করে!ও তো ভালই আছে।এই বাড়ি গাছপালা, ফুল, প্রজাপতিদের বাঁচানোর জন্যই তো ও বেঁচে আছে!তাহলে…

‘চললাম।খাবারগুলো খেয়ে নিয়ো।আর পারলে…’

‘তুলতুলি আবার কবে আসবি মা!’

‘তুমি তো ছাড়বে না!কী আছে এই ভূতের রাজ্যে।ভূতগুলো মরলে তো মানুষগুলো বাঁচে!’

‘সোজাসুজি বল না, কী চাস তুই?’

‘সবই তো জান বাবা।আর কদিন আছ? এরপর যারা থাকবে তাদের কথা ভাববে না!কিছু টাকা যদি তোমার মেয়ে পেত তাহলে সে কি তোমায় আরো ভাল করে যত্ন করত পারত না! কিন্তু তুমি কারোর কথাই ভাব না বাবা!’

হঠাৎ করেই আকাশে হারিয়ে গেল কালো ভেলভেট ছোট্ট প্রজাপতিটা।ওদের ডানার শব্দ হয় না।তবুও তিরতির করে কখাটা কাঁপছিল বিকাশের দুই কানের পাশে…তুমি কারোর কথাই ভাব না বাবা।

                                                                           ।। তিন ।।

প্রজাপতিদুটো আবার অনেকদিন পর একসাথে।আজও উড়ছে ওরা।একসাথেই উড়ছে।কিন্তু সেই নাচের ছন্দ নেই।আজ ওরা ভাসছে।চৈত্রের বিকেল হাওয়ায় হলুদ পাতা , মৃত টিয়ার পালক… ঢেউয়ে ঢেউয়ে অসহায়…কোনো ফুলের শরীর খুজে পাচ্ছে না ওরা।কথা দিয়ে গাঁথা একটা মালাও উড়ছে ওদের সাথে, ‘বাবা এভাবে আর পারা যাচ্ছে না… তুমি কারোর কথাই ভাব না বাবা।’

হালকা বাসন্তী রঙ, যার দুই ডানায় গুনে গুনে তিনটে কচিকলাপাতা রঙের বিন্দু সেই প্রজাপতি  আর ছোট প্রজাপতি, আজ সকালে অনেকক্ষণ দেখেছিল দুজন,দুজনকে।ভেলভেট কালো প্রজাপতিটা নিজেকে শেকল দিয়ে বেধে রেখেছিল কিছুতেই উড়বে না বড় প্রজাপতিটার সাথে, উড়ে গিয়ে ওর বুকে মিশবে না।সব্বাই…সব্বাই স্বার্থপর, এই দুনিয়ায়!

তবুও দেখতে পেল ছোট প্রজাপতিটা…সাত সমুদ্দুর পেরিয়ে এসেও বড় প্রজাপতি  ক্লান্ত হয় নি।সে উড়ে আসছে ওর দিকে। লাল জবা ফুল চোখদুটোয় সেই শাসন,অভিমান! অনেক খুনসুটি,কান্নাকাটি,জেদাজেদির পর শেষ পর্যন্ত প্রিয় জিনিসটা তুলে দিত ওর হাতে…

‘নে নে সব নে তুই।আমার কিচ্ছু দরকার নেই।’ তার হালকা বাসন্তী রঙের বুকটা কান্নার ঢেউ ভাঙছে।তখনি ভেলভেট কালোর বুকের পাঁজরগুলো আলতো করে ছুয়ে গেল আনকোরা নতুন ব্লেডের প্রান্ত…

‘তুমি কারোর কথাই ভাব না বাবা।’

আর বড় প্রজাপতিটা দেখল সেই ন্যাতাপ্যাতা দুঃখী দুঃখী মুখের পাগলি ছোট্ট প্রজাপতিটা এখনও ঠিক তেমনই।কনকনে ভয়ের তুষার ঝড়ে ডানা গুটিয়ে পালায় নি।ওকে আচড়ে কামড়ে তাড়াবে এমন এতটুকুও আগুন তার চোখে নেই।ও ভাবল,

‘তাহলে এতদিন কেন আসিনি!কেন বোনটাকে  নিয়ে যাই নি নিজের আরামের নীড়ে!সেই এলাম, ইস!আরেকটু আগে এলে!’তার ঠিক পরেই দুটো চোখের জলের বুক একজন আরেকজনের মধ্যে মিশে গেল। কালো ভেলভেট, হালকা বাসন্তীর কানে কানে বলল, ‘কেন তোকে একটাও ফোন করিনি বল তো!যদি করতাম, তাহলে আজ…আর একজন যে!’ ওরা উড়তে উড়তে এসে বসল বারান্দার সিলিঙে আটকে রাখা দড়ির দোলনাটার ওপর।

‘তোর মনে পড়ে তুই বসতিস আর আমি দাড়িয়ে থাকতাম, একসাথে দুলতাম, খুব জোরে…একবার মনে আছে–’

‘আমি ছিটকে গিয়ে পড়লাম একেবার বারান্দা পেরিয়ে ঐ কামিনী ঝোপটার মধ্যে।আর তোর কী কান্না!তারপর বাবাও কাঁদছে, দুই কোলে আমরা দুজন কাঁদছি। মা এসে আমার রক্ত মুছিয়ে,পট্টি বেঁধে দিল।বাবাকে দিল খুব জোর ধমক।’

 ‘কামিনীর ঝোপটা ঠিক একইরকম আছে তাই না!’

‘শুধু কামিনী! তোর খুব প্রিয় ঐ বুড়ো গন্ধরাজ গাছটাকে দেখ।এখনও কেমন ফুলে ফুলে ভরা।স্কুলের বাগান থেকে চারাগাছ চুরি করে এনে বড়দির বকা খেয়েছিলিস…মনে আছে! সেই রাতে তোরা বাপ মেয়ে খাস নি।’

‘ বা রে, তোর প্রিয় কৃষ্ণচূড়া, কদম,স্থলপদ্ম, আর ঐ যে ঐ কোনায়… বেড়ার ধারে আম্রপালী গাছটা,ওটাও তো দিব্যি আছে!’

‘ বাবা সারারাত ধরে জেগে থাকত।একটা আমও চুরি হতে দেয় নি এতদিন। নিজের হাতে কেটে আমায় খাওয়াবেই, খাওয়াবে।আজকাল আর তেমন ভাল লাগে না। বারবার বলত-আমি যখন থাকব না তখন এই গাছটা কাটিস না।’

‘ ঝুড়িতে রাখা যেত না এই আম,তুই লুকিয়ে চুরি করে খেতিস।’

বারান্দার দেয়ালে কালো কাজল পেন্সিলে, লেখা-আমি আজ কারোর সাথে কথা বলব না। ঢেউ খেলানো মাত্রা,লাইন… ছোট বড় অক্ষর!রঙ হালকা হয়েছে তবে এতদিনে আরো অনেক বেশি বিবর্ণ হয়ে যাওয়ার কথা।ছোট প্রজাপতিটা দেখতে পেল, লেখাটার ওপর বিছানো মমতার স্বচ্ছ মলাট।রোদ,জল,হাওয়া কেউ কোন ক্ষতি করতে পারে নি।…এতদিন ধরে ও আসছে, ঐ মলাটটা চোখেই পড়েনি।একটা ভারী নিশ্বাস পড়ল ওর ডানায়।

‘মেলায় কথা বলা পুতুল চেয়েছিলি,কারখানা তখন বন্ধ,পয়সা ছিল না বাবার কাছে।দুদিন কথা বলিস নি কারোর সঙ্গে।শেষে ধার করে কিনে এনেছিল বাবা।’

দুই ঘরের দেয়াল জুড়ে এখানে ওখানে আবোল তাবোল লেখা, ছবি, নক্সা।মা খুব ঝগড়া করত।দেয়ালগুলো এমনই নোংরা ঝোংরাই থেকে যাবে সারাজীবন,সহ্য করা যায়!দুই প্রজাপতি ভাসতে ভাসতে বারবার দুই ঘরের দেয়ালে মিশে যেতে চাইছিল।কোনো ঝুল নেই, অন্য কোনো নোংরা দাগ- ছোপ, কিচ্ছু নেই।

‘কত বার বলেছি টাকা পাঠাচ্ছি, সব সময়ের জন্য কাজের লোক নাও।বাগানের কাজের জন্য লোক নাও।কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলত।আমার এই আনন্দটুকুও কেড়ে নিবি মা!’

‘আর আমি রান্না বাদে আরো কিছু করে দিতে চাইলে রাগ করে কথা বলত না,গুম মেরে থাকত।’

বারান্দা থেকে উঠোনে নামার বড় ধাপগুলো ছাড়াও দক্ষিণ দিক থেকে নামার জন্য আরো সরু তিনটে  ধাপ বানানো হয়েছিল।আজ খুব দেখার ইচ্ছে হল হালকা বাসন্তী বড় প্রজাপতিটার। চওড়া বারান্দাটার দক্ষিণ দিকটা যেখানে শেষ হয়েছে ও দ্রুত সেই জায়গাটায় এল।উঠোন আগের থেকে আর একটু উচু হয়েছে।তিনটে ধাপের শেষ, নীচেরটা মাটি চাপা পড়ে গেছে।বাঁশের বাখারির শক্ত বেড়া দিয়ে তিনদিক থেকে ঘিরে রাখা বাকি দুটো ধাপ।বোঝাই যাচ্ছে ধাপগুলো দিয়ে কেউ যেন না উঠতে পারে তাই এই ব্যবস্থা।অনেক বছর আগের তৈরি সিমেন্টের মেঝে।একটু সবজে হলদেটে আভা।কিন্তু ঝকঝকে, প্রতিদিন মোছা হয় বোঝা যাচ্ছে।

…খুব কাঁদছিল সেদিন বড় প্রজাপতি।জল ছেঁচে ফেলা পুকুরের পাতলা কাদায় পা দিয়ে সদ্য নিজের পায়ের ছাপ দেখে এসেছিল।সরু ধাপগুলোয় সেদিন বিকাশ নিজে শেষ বারের জন্য সিমেন্টের তরল আস্তরণ দিচ্ছিল।মিতুলের বায়না ওখানে পা দিয়ে নিজের পায়ের ছাপ দেখবে।একটাই চড় খেতে হয়েছিল মায়ের হাতে।সঙ্গে সঙ্গেই বাবা কোলে করে নিয়ে এসে ওর বাঁ পায়ের পাতা যত্ন করে ছুইয়ে ছাপ নিয়েছিল।ছোট প্রজাপতিটাও বাদ যায় নি।

…ছোট্ট ছোট্ট দুটো বালিকা পায়ের ছাপ।এত বছরের ঠান্ডা সিমেন্ট জমে পাথর।কিন্তু কী আশচর্য! প্রজাপতি দুটো কিছুতেই সেই সিমেন্টের ছোঁওয়া পেল না।যতবারই তারা নেমে এসে বসতে যাচ্ছিল ঐ পায়ের ছাপে ততবারই একটা মায়াবী দোলনা তাদের বুকে টেনে নিচ্ছিল।তারপর দুলতে দুলতে একসময় পাথরের পায়ের ছাপটার ওপর দিনের পর দিন ধরে জমে থাকা আদর আর চোখের জলের গন্ধ ওদের ভেতরে ঢেঊ তুলল…গাঁয়ের ছোটো নদীটার টলটলে ঢেউ।

 ‘আর একটু সময় রেখে দিতে পারলি না!’

‘ তুই কখন এসে পৌছোবি তা কেউ আমায় জানায় নি।’

‘ তুই নিজে আমায় ফোন করতে পারতিস!’

‘তুইও তো ফোন করে বলতে পারতিস।তখন কি কথা বলার মত অবস্থায় ছিলাম আমি!’

‘আমিও তো…তুই তাও সামনে ছিলিস।ঝাপিয়ে পড়েছিলিস বুকের মধ্যে।আর আমি হাজার হাজার মাইল দূরে…’

‘তোর ওপর খুব রাগ হচ্ছিল।কেন কথা বন্ধ করেছিলিস আমার সঙ্গে!এই বাড়ি বিক্রির টাকা যে আমার দরকার নেই তা কি তুই জানিস না!’

‘এই জন্যই তো কথা বলতাম না তোর সাথে। গরীব হতে পারি, কিন্তু কোনোদিন হাত পেতেছি কারো কাছে? অনেক হাতে পায়ে ধরেছি।পারি নি।তাই আজকাল বকে,রাগিয়ে যেভাবেই হোক এই বাড়ির মায়া ছাড়াতে চেয়েছিলাম আমি।নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে রাখতে চেয়েছিলাম।’

‘আমিও তো তাই চেয়েছিলাম রে! কিন্তু কিছুতেই কিছু…’

‘এ বাড়ির মায়া সে কাটাতে পারল না…’ দুই প্রজাপতি নিজেদের চোখের জল মুছে দেয়।

 ‘ তুই কিছুই বুঝতে পারিস নি?’

‘না রে! আগের দিন দুপুরে এসে রান্না করে দিয়ে গেলাম।একটু রাগারাগি করেছিলাম।কিন্তু যখন গেলাম তখন তার মুখে সেই হাসি…’

                                                                           ।। চার ।।

 ‘তুতুলদি, মিতুলদি বাড়িটা তোমরা কী করবে?’

‘তোর কী দরকার রে পালান?’

‘না জেঠু তো থাকল না! তোমাদের তো নিজেদের আলাদা বাড়ি আছে।তাই জিজ্ঞাসা করছিলাম।’

তুলতুল বলে ‘নিজের চরকায় তেল দে পালান।আমি জানি তুই বারবার বাবার কাছে আসতিস।লোভ দেখাতিস…ভাল হবে না কিন্তু!’

বাড়ির সামনের রাস্তায় ওরা দুজন। মাটিতে কোথাও তখন আর বিকেলের আলো নেই।আকাশের এখানে ওখানে খুচখাচ ঝিলমিলে গোধূলি।সেই হালকা নীল সন্ধ্যায় পালানের মুখের রঙও নিভে গেল।

 ‘হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করা বেকার। কী করব আর? দালালি ছাড়া কিছু আর নেই যে!একটা বড় রিসর্ট হবে এখানে,জমি দরকার।তাই যেতাম জেঠুর কাছে…’

 মিতুল নিজের মনেই একটু জোরে বলে ফেলে,

‘তুই বাবাকে…’

‘ এই কদিন রাতে ঘুমোতে পারছি না। মা-বাবা, বৌ, বাচ্চা, ভাই বোন আমাদেরও আছে…’

‘তার মানে তুই কী বলতে চাইছিস পালান?’ পালানের জামার কলারের বোতামদুটো চেপে ধরে তুলতুল। ওর চোখগুলোয় শরীরের সব রক্ত এসে জমেছে।

 সেদিন ডেভেলপার একটা ব্যাগ দিয়েছিল।কথায় কথায় জেঠুকে খুলে দেখালাম, পাঁচলাখ ছিল।টাকাটা দেখার পরেই জেঠুর মুখচোখ লাল হয়ে গেল, শুয়ে পড়ল, আমায় চলে যেতে বলল। আমি চলে এলাম। পরদিন সকালে দরজা ভেঙে… ঐ শোয়া অবস্থাতেই জেঠুকে…ক্লাস ফাইভে বাবা মারা গেল।তারপর থেকে প্রতি বছর পরীক্ষার শেষে তুলতুলদির বইগুলো আমার বাড়িতে পৌছে দিত জেঠু।’

মিতুল কেঁদে উঠল হাউহাউ করে। তুলতুলের পাথরের মূর্তিটা পালানের থুতনি তুলে ধরে বলল,

‘বাবা আর কিছু বলেছিল তোকে?’

ওপর থেকে নীচে তিনবার মাথা নাড়াল পালান–

‘অদ্ভূত কয়েকটা কথা…এটা প্রজাপতি, আমার তিতলিদের বাসা রে… তাই তো এত গাছ,ফুল,আলো… টাকার লোভ সব গিলে নেবে…উঃ কী কষ্ট!যা, যা চলে যা।’

পরদিন সকালের আলোয় দেখা বিকাশের ঘুমিয়ে থাকা কষ্টে মাখামাখি  মুখটা তুলতুলের চোখের সামনে ভেসে উঠল। ওর চোখের মধ্যে সন্ধে আকাশের তারার আলোয় মিতুলও সেই মুখ দেখল। অনেকটা সময় ওদের দুচোখ ভরে থাকল সেই মুখ।

তারপর ওরা দুজন একসাথে তাকাল বেড়ার ওপারে ওদের বাড়িটার দিকে।ঝাঁকঝাঁক জোনাকি আর ঘন সন্ধ্যার আলোয় তখন মায়াময় তিতলির বাসা।বারান্দায় এক অস্পষ্ট মানুষের অবয়ব বসে আছে। খুব ছোট,ছোট,মাঝারি, বড় নানা আকৃতির কালো ভেলভেট আর হালকা বাসন্তী রঙের প্রজাপতি উড়ে  ঘর, বারান্দা, উঠোন, বাগান জুড়ে নেচে নেচে উড়ছিল আর সেই মানুষটাকে স্পর্শ করছিল।নক্ষত্র আর জোনাকিদের আলোয় ডুবে থাকা মানুষটার চোখে মুখে অপার প্রশান্তি ।তুলতুল আর মিতুল দুই প্রজাপতি আরেকবার দুজন দুজনের চোখের তারায় ডুব দিয়ে উঠে এল।তারপর ডানা মেলে মিশে গেল তিতলির বাসা্‌ প্রজাপতিদের মেলায়।পালান দুই হাটু মুড়ে রাস্তার ওপরেই বসে পড়ল।

রাজেশ ধর : লেখক, কলকাতা।

অারো পড়ুন…

দরজার ওপাশে আইয়ুব বাচ্চু : লুৎফর রহমান রিটন

রুপালী গীটার ছেড়ে চলে গেলেন আইয়ুব বাচ্চু : জীবন তাপস তন্ময়

কবিতাগুচ্ছ : গৌতম অধিকারী                            

                                    

About the author

নরসুন্দা ডটকম