রেজা ঘটক>>
বন্ধুরা, নন্দিতা দাশের চলচ্চিত্র ‘মান্টো’ দেখতে বাংলা একাডেমিতে গিয়েছিলাম। না, একাডেমিতে ঢুকতে আমার কোনো পাস লাগেনি। বরং সিনেমা দেখার পাস ছিল না বলে সিনেমা দেখার সুযোগ ঘটেনি। ঢাকা লিট ফেস্টের আয়োজকরা খুব আয়েশ করে আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনের নামে বাংলা একাডেমি চত্বরে বড়লোক পাড়ার একটি জুতসই আয়েসি হাট বসিয়েছেন। সেখানে আমার কবি-লেখক বন্ধুরা সানন্দে অংশ নিয়ে তিন হাজার টাকার একটা করে খাম বাগিয়েছেন। কিন্তু ওই সাহিত্য সম্মেলনের কোথাও আমি সত্যিকার সাহিত্য খুঁজে পাইনি।
এমনকি উপস্থিত কবি-লেখক বন্ধুদের মুখেও সাহিত্যের কোনো আলোচনা শুনিনি। বরং আইডি কার্ড (আয়োজকদের পরিবেশিত বিশেষ ধরনের হলুদ পাশ কার্ড) দেখিয়ে আমার বন্ধুরা কখন কীভাবে ঢাকা ক্লাবে ফ্রি মদ্যপান করবে (বছরে ঢাকা লিট ফেস্ট উপলক্ষ্যে তিনদিন) সেই আলোচনায় তাদের ব্যস্ত থাকতে দেখেছি। শুনেছি মন্ত্রণালয় থেকেও এই আয়োজনে বিপুল পরিমাণ অর্থ চাঁদা দেওয়া হয়েছে। আহা ধন্য ধন্য। ওহ হ্যা, আনিসুজ্জামান স্যারকে দেখেছি বয়রাতলায় খাবারের দোকান বেষ্টিত চত্বরে বসে নান্দনিক আড্ডা দিচ্ছেন। সংক্ষেপে এই হচ্ছে ঢাকা লিট ফেস্ট!
নন্দিতা দাশের ‘মান্টো’ যেহেতু আজ দেখা হয়নি। তো কী হয়েছে, আমি কী বসে বসে আঙ্গুল চুষবো? বাসায় ফিরে পাকিস্তানী নির্মাতা সারমাদ খুশাত নির্মিত ‘মান্টো’ চলচ্চিত্রটি দেখে ফেললাম। মান্টো একটি বায়োপিক। ছবি নিয়ে আলোচনা লিখব দুটো সিনেমা দেখার পর। তার আগে চলুন মান্টো সম্পর্কে একটু ধারণা নেই।
ক্লাসের পরীক্ষায় উর্দুতে কখোনো পাশ করতে না পারলেও উর্দু সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ লেখক বলা হয় সাদত হাসান মান্টোকে। পড়ালেখায় অমনোযোগিতার কারণে দু’বার তিনি এন্ট্রান্স পরীক্ষায় ফেল করেছিলেন। কারণ স্কুলের পাঠ্য বই বহির্ভূত গল্প-উপন্যাসের বই পড়ার দিকেই তাঁর ছিল প্রবল আগ্রহ। তরুণ বয়সে অমৃতসর রেল স্টেশনের হুইলার বুকস্টল থেকে তিনি নিয়মিত বই চুরি করতেন।
মান্টো’র লেখা বইয়ের বিরুদ্ধে মোট ছয় বার অশ্লীলতার অভিযোগে মামলা হয়। ভারত ভাগের আগে ব্রিটিশ সরকারের অধীনে ৩ বার এবং ভারত-পাকিস্তান ভাগের পর পাকিস্তান সরকারের অধীনে ৩ বার। অশ্লীলতার অভিযোগে ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশেই তাঁর গল্পকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়। অশ্লীলতার অভিযোগে তাঁর ‘বিটার ফ্রুট’ গল্পের জন্যে তাঁকে ১৯৫০ সালের ২৯ আগস্ট অভিযুক্ত হয়ে আসতে হয়েছিল লাহোর আদালতে।
সাদাত হাসান মান্টো তখন আর্থিক দুরবস্থার কারণে নিজের পক্ষে ভালো আইনজীবী নিয়োগ করতে পারেননি। স্বত:প্রবৃত্ত হয়ে তরুণ আইনজীবী শেখ খুরশিদ আহমেদ, পরে যিনি পাকিস্তানের আইনমন্ত্রী হয়েছিলেন, তিনিসহ আরো তিনজন তরুণ উকিল তখন মান্টোর পক্ষে আদালতে সওয়াল করেছিলেন।
মান্টো’র গল্পে বোহেমিয়ান জীবন, সমাজের অন্ধকার জীবনের নানান কিসিমের জটিলতা, মাতাল, পাগল, ভবঘুরে, বেশ্যা চরিত্রগুলো বারবার ঘুরেফিরে এসেছে। এমন কি আদালতে দোষী সাব্যস্ত হয়ে তাঁকে জরিমানাও দিতে হয়েছে। তাঁর অধিকাংশ কাজ পৃথিবীর বহুভাষায় অনূদিত হয়েছে। সালমান রুশদি মান্টো সম্পর্কে বলেন “Undisputed master of modern Indian short story”।
১৯৩২ সালে যখন মান্টো’র বাবার মৃত্যু হয় তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ২০ বছর। কর্মসূত্রে জজ বাবার মৃত্যুর পর মান্টো খুব অসহায় হয়ে পড়েন। পরিবারের অর্থ কষ্ট লাঘবের জন্যে তখন থেকেই তিনি আয়-উপার্জনের পথ খুঁজতে থাকেন। ওই সময় তার্কিক লেখক আবদুল বারি আলিগের সঙ্গে মান্টোর সাক্ষাৎ ঘটে। এই সাক্ষাৎটি ছিল সাদত হাসান মান্টোর জীবনে বিশাল একটি মাইলফলক।
আবদুল বারি আলিগ তখন তরুণ লেখক মান্টোকে রাশিয়ান এবং ফরাসি ভাষা শিখতে দারুণভাবে উদ্বুদ্ধ করেন। কয়েক মাসের মধ্যেই মান্টো, ভিক্টর হুগোর “The last Day of a Condemned Man” এর উর্দু অনুবাদ করেন। যা পরবর্তীকালে “সারগুজাস্ত-ই-আসির” (এক বন্দীর গল্প) নামে উর্দুতে প্রকাশিত হয়। পরবর্তীকালে একইভাবে মান্টোর হাতেই রাশিয়ান গল্পের উর্দু অনুবাদ “রাশি আফ্সানে” প্রকাশিত হয়।
বিদেশী সাহিত্য উর্দু ভাষায় অনুবাদ করতে গিয়ে মান্টো সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি জগতের সন্ধান পান। কিংবদন্তি লেখক ভিক্টর হুগো, অস্কার ওয়াইল্ড, রাশিয়ান লেখক আন্তন চেখভ, মাক্সিম গোর্কি প্রমুখের সাহিত্য কীর্তির সাথে তিনি নিবিড়ভাবে পরিচিত হন। আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনাকালীন মান্টো যুক্ত হন ইন্ডিয়ান প্রগ্রেসিভ রাইটার্স এসোসিয়েশনে। সেখানে তাঁর সাথে পরিচয় হয় লেখক আলি সর্দার জাফরির সাথে। এরপর ক্রমশ তিনি হয়ে ওঠেন উর্দু সাহিত্যের একজন জনপ্রিয় ছোটগল্পকার।
তাঁর বিখ্যাত গল্পের মধ্যে আছে বু, টোবা টেক সিং, তামাশা, ঠাণ্ডা গোস্ত, কালি সালোয়ার, খালি বোতল, ধুয়া ইত্যাদি। তাঁর রচনায় দেশভাগ, সাম্প্রদায়িকতা, দাংগা, মানব চরিত্রের বীভৎসতা বারবার ঘুরে ফিরে এসেছে। প্রগতিশীল অসাম্প্রদায়িক চিন্তার এই উর্দু ছোটগল্পকারকে তাঁর মুক্তচিন্তার কারণেই বারবার ভারত পাকিস্তান উভয় দেশেই অপমানিত ও লাঞ্ছিত হতে হয়েছে।
ভারত-পাকিস্তান দেশভাগের পর ১৯৪৮ সালে মান্টো সপরিবারে লাহোর চলে যান। পাকিস্তানের কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ, নাসির কাজমি, আহমেফ রহি প্রমুখের সংস্পর্শে আসেন মান্টো। প্রগতিশীল রাজনৈতিক সাহিত্যচর্চায় তাঁর বিশেষ খ্যাতি ছিল। মান্টো ছিলেন একজন বেতার লিপি লেখক ও সাংবাদিক।
তাঁর ছোট গল্পের সংকলন ‘Kindom’s end and other stories’, একটি উপন্যাস, তিনটি প্রবন্ধ সংগ্রহ ও ব্যক্তিগত স্কেচের দুটি সংগ্রহ প্রকাশিত হয়। বোম্বাই চলচ্চিত্র জগত বা বলিউডে মান্টো’র অজস্র কাজ রয়েছে। বহু সিনেমার তিনি স্ক্রিপ্ট রাইটার হিসেবে প্রথম শ্রেণির চিত্রাভিনেতা ও পরিচালকদের কাছে দুর্দান্ত কদর পেতেন। আট দিন, চল চলরে নওজোয়ান, মির্জা গালিব ইত্যাদি চলচ্চিত্রে মান্টো ছিলেন স্ক্রিপ্ট রাইটার।
সাদত হাসান মান্টো ১৯১২ এর ১১ মে পাঞ্জাব লুধিয়ানার পাপরউদি গ্রামের ব্যারিস্টার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। মান্টোর পূর্বপুরুষরা ছিলেন কাশ্মিরী বংশোদ্ভূত। ক্রমাগত নিম্ন মানের অ্যালকোহল পানে ‘মান্টো “লিভার সিরোসিস”-এ আক্রান্ত হন। তাঁর জীবনযাত্রাও ছিল চুড়ান্ত রকমের বাউণ্ডুলে এবং বেপরোয়া। শরীরের প্রতি অযত্ন, অপ্রতুল চিকিৎসা, আর্থিক অনটন ইত্যাদিতে জর্জরিত মান্টোর বেঁচে থাকার প্রবল আগ্রহ শেষপর্যন্ত ব্যাধির কাছেই আত্মসমর্পণ করে। মাত্র ৪৩ বছর বয়সে ১৯৫৫ সালের ১৮ জানুয়ারি মান্টোর অকাল প্রয়াণ ঘটে তাঁর দ্বিতীয় আবাস ভূমি লাহোরে।
—————————-
ঢাকা লিট ফেস্ট থেকে ফিরে- রেজা ঘটক, ৯ নভেম্বর ২০১৮।। নোট: লেখাটি লেখকের ফেসবুক আইডি থেকে নেয়া।