আমাদের আপন-পর আর শত্রু-মিত্র চিনিয়েছিলো একাত্তর। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কে আমার আপন কে আমার পর, কে আমার শত্রু আর কে আমার মিত্র সেটা আমরা চিনতে শিখেছিলাম একাত্তরে, মুক্তিযুদ্ধকালে।
একান্ত ব্যক্তিগত ও পারিবারিক পরিসরের গল্পটা, আপন-পর আর শত্রু-মিত্র চেনার গল্পটা এইবার পেশ করি।
১৯৭১ সালের মার্চের মাঝামাঝি সময়ে বাবার নেতৃত্বে সপরিবারে আমরা আমাদের গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলাম। উদ্দেশ্য আমাকে মুসলমান বানানো। অর্থাৎ কী না মুসলমানি। এই কাজে শহরের কোনো সার্জন নয়, আমার বাবার পছন্দ ছিলো গ্রামের এক্সপার্ট হাজাম। যিনি এই কাজে খুর বা ধারালো ছুরি ব্যবহার না করে ব্যবহার করেন কাঁচা বাঁশের শার্প চল্টা। ওই চল্টার সামান্য ছোঁয়াতেই কেল্লা ফতে!
একাত্তরের পুরো নয় মাস আমরা গ্রামে ছিলাম। ওই সময়টাতেই আমি ফুল চেনেছি, ফল চিনেছি। মাছ চিনেছি, গাছ চিনেছি। নদী এবং জল চিনেছি। জোয়ার ভাটা চিনেছি। ফড়িং প্রজাপতি আর মানুষ চিনেছি।
মানুষের গল্পটাই বলি আজকে।
গ্রামের নাম বাঁশগাড়ি। থানা বাঞ্ছারামপুর। জেলা কুমিল্লা।বাবা সরকারি চাকুরে।
পঁচিশে মার্চের ক্র্যাক ডাউনের পর আমরা আটকে পড়লাম গ্রামের বাড়িতে। চাকরি বাঁচাতে ঢাকায় একা থাকেন বাবা। মাসে একবার গ্রামে আসেন। উত্তরাধিকার সূত্রে পৈত্রিক ভিটের তিন ভাগের এক ভাগ পেয়েছেন বাবা। বাবার বড় দুই ভাই। দুই জেঠুর সঙ্গেই আমাদের খুব সুন্দর সম্পর্ক ছিলো। যদিও বাড়িটা তিন ভাগে ভাগ করার সময়েই আমার দুই জেঠু খুব কায়দা করে বাবাকে ঠকিয়েছিলো। গ্রামের মসজিদটা ছিলো সেই বাবা-জেঠুদের ভিটে বাড়ির মধ্যেই। জেঠুরা এমন ভাবে বাড়িটাকে তিন ভাগ করেছিলেন যাতে আমার বাবার অংশে মসজিদটা পড়ে। বাবা সেটা মেনে নিয়েছিলেন। আমরা সপরিবারে গ্রামে না গেলে আমাদের ঘরটি জেঠুরাই ব্যবহার করতেন। আমরা যাওয়াতে ঘরটি এবং একটি রান্না ঘর ছেড়ে দিতে হলো তাদের। একটা কমন উঠোন আমরা তিনটি পরিবার ব্যবহার করতাম। উঠোনটা বেশ বড় ছিলো।
বাবা পুরো মাস ঢাকায় থাকতেন বলে জেঠুরা, বিশেষ করে বড় জেঠু অনেক কর্তৃত্ব ফলাতে চাইতেন মায়ের সঙ্গে। গ্রাম্য কায়দায়। একবার মাস শেষে বাবা ফিরে এলে একটা পারিবারিক শালিস বসলো। আমার মায়ের প্রতি অনেক অভিযোগ জেঠুর। মা কথা শোনে না। নিজের মতো চলে। এটা মেনে নেয়া যায় না। শালিসে বাবা স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, আমার মায়ের কাছে যেটা ভালো মনে হবে মা সেটাই করবেন। সেভাবেই চলবেন। জেঠুদের দরকার নেই আমাদের মাকে বুদ্ধি পরামর্শ দিয়ে চালানোর। বড় জেঠু ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন,–‘তুই তো তাহলে তোর বউকে রাতা বানিয়ে দিয়ে গেলি!’ (রাতা মানে মোরগ।)
বাবা আবার ঢাকায় চলে গেলেন।
সারা দেশে জোরে সোরে মুক্তিযুদ্ধ চলছে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শুনি আমরা উঠোনে, উৎসাহী গ্রামবাসীদের নিয়ে। বাবা আমাদের বড়সড় একটা রেডিও কিনে দিয়ে গেছেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ‘চরমপত্র’সহ সব অনুষ্ঠানের আমি একনিষ্ঠ শ্রোতা। বিশেষ করে গানগুলো–জয় বাংলা বাংলার জয়, সালাম সালাম হাজার সালাম, মুজিব বাইয়া যাও রে, মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি, তীর হারা এই ঢেউয়ের সাগর, পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে, শোনো একটি মুজিবরের থেকে, ভেবো নাগো মা তোমার ছেলেরা হারিয়ে গিয়েছে পথে গানগুলো আমাকে মোহিত ও আবিষ্ট করে রাখতো। পুরান ঢাকায় ওয়ারিতে আমাদের বাসা ছিলো বলে ঢাকাইয়া ভাষায় রচিত ও পঠিত ‘চরমপত্র’ ছিলো আমার দারুণ পছন্দের। গ্রামের মাঠে, নদীর তীরে, ধানের ক্ষেতে একলা একা হাঁটতে হাঁটতে আমি মুকুল ভাইয়ের কণ্ঠস্বর নকল করে মুখস্ত চরমপত্র পাঠ করতাম। আর গাইতাম জয় বাংলা বাংলার জয়/ হবে হবে হবে, হবে নিশ্চয়/ কোটি প্রাণ একসাথে জেগেছে অন্ধ রাতে নতুন সূর্য ওঠার এইতো সময়…।
এভাবেই দিন যাচ্ছিলো।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে এবং বাবার গ্রামে আসার সুবাদে মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা প্রবাহের সাম্প্রতিকতম তথ্যও আমাদের নাগালের মধ্যে থাকতো।
মাকে জেঠুর কথিত ‘রাতা’ বানিয়ে বাবার ঢাকা চলে যাবার পরে আমাদের বিশাল উঠোনটা একদিন ছোট হয়ে গেলো। আমার বড় জেঠু সীমানা মেপে তার ভাগের জায়গায় এমন ভাবে নতুন একটা ঘর তুললেন যে আমরা রীতিমতো বন্দি হয়ে গেলাম। তিনি তার নতুন ঘরটার পেছন দিকটা আমাদের দিকে স্থাপন করলেন এমন ইঞ্জিনিয়ারিং বুদ্ধিতে যে গ্রামের সড়ক পথ দিয়ে আমাদের বাড়িতে ঢোকার বিশাল প্রশস্ত পথটা একেবারে সরু হয়ে গেলো। দু’জন মানুষ পাশাপাশি হেঁটে যাওয়াও দুষ্কর, এমন অপ্রশস্ত। গ্রামের লোকজন বিস্ময় প্রকাশ করলো–এইটা কেমন কাজ হলো! তোতা মিয়াকে (আমার বাবার নিক নেম) তো একেবারে একঘরে করে ফেললো!
সারাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আঁচ এসে পৌঁছালো আমাদের বাঞ্ছারামপুরেও। পাকিস্তানি একদল মিলিটারি বাঞ্ছারামপুর থানায় এসে বিশাল ক্যাম্প খুলে বসলো। আশপাশের গ্রামে শুরু হলো হত্যা, মারপিট, অগ্নিসংযোগ আর নারী নিপীড়ন। বাঞ্ছারামপুর গ্রামটা আমাদের গ্রাম থেকে খানিকটা দূরে এবং মাঝখানে একটা নদী থাকায় আমাদের বাঁশগাড়ি গ্রামটা মোটামুটি নিরাপদই ছিলো। দূর থেকে আমরা আগুনের ফুলকি দেখতাম। গাঢ় ধোঁয়ার কুণ্ডলি দেখতাম। আর শুনতাম ঠা ঠা ঠা টা ঢিঁচো ঢিঁচো গুলির শব্দ। বড় ভয়ংকর ছিলো সেই গুলির শব্দ। কোনো কোনোদিন সারা রাত ব্যাপি, কোনো কোনো দিন দিনব্যাপি চলতো গোলাগুলি। আমরা বুঝতে পারতাম দূরের কোনো গ্রামে মুক্তিযোদ্ধারা এসেছে। তাঁদের সঙ্গেই লড়াই হচ্ছে ভয়াবহ।
এক বিকেলে হঠাৎ খবর রটলো যে পাকিস্তানি একদল সৈন্য স্থানীয় দালাল রাজাকারদের সহযোগিতায় আমাদের গ্রামের দিকে রওনা হয়েছে।
পুরো গ্রামে হইচই পড়ে গেলো। পালাও পালাও। যে যেদিকে পারছে পালাচ্ছে। আমার বড় জেঠু একটা কোশা নৌকায় তার মেয়ে এবং দুই ভাস্তিকে নিয়ে নিরাপদ জায়গায় সরে যাচ্ছেন। ওদের কোষা নৌকোটা স্টার্ট নেবার সময় আমার মা আর বড় ভাই আমার ইমিডিয়েট বড় বোনটিকে নিয়ে জেঠুকে অনুরোধ করলেন ওদের সঙ্গে আমার কিশোরী বোনটিকেও নিতে। ভীত হরিণীর মতো সন্ত্রস্ত কম্পমান আমার কিশোরী বোনটির পাশে আমিও দাঁড়িয়ে আছি। আর ভাবছি, যাক পাকিস্তানি পশুরা আমাদের গ্রামে এলেও কিশোরী বোনটি আমার বেঁচে গেলো। কিন্তু আমাদের অবাক করে দিয়ে জেঠু হাসতে হাসতে ‘আমাদের নাওয়ে জায়গা নাই’ বলতে বলতে নৌকা ভাসিয়ে দিলেন! অথচ নৌকায় প্রচুর জায়গা ছিলো। আমার বোনের মতো আরো অন্তত চারটি মেয়ে ওই নৌকায় অনায়াসে ঠাঁই পেতে পারতো!
আমার কিশোর মনে এই ভয়ংকর দৃশ্যটা চিরস্থায়ী হয়ে রইলো। এরকম ঘোর বিপদের সময় নিজের ছোট ভাইয়ের কিশোরী কন্যাকে ফেলে যায় কী করে একজন মানুষ! লোকটাকে ক্ষমা করিনি আজও।
২
মাসের শেষে ঢাকা থেকে বাবা এসে ঘটনা শুনে আমাদের জন্যে একটা কোশা নৌকা কিনে ফেললেন। আমার বড় ভাই আর আমি শিখে নিলাম নৌকা চালানো। লগি আর বৈঠা দু’টোই চালাতে শিখে গেলাম দ্রুতই।
ভবিষ্যৎ বিপদের সময় মা আর ভাইবোনকে নিয়ে আমরা দুই ভাই পালাতে পারবো কারো সাহায্য ছাড়াই।
৩
এই নৌকাটা আমার খুব প্রিয় হয়ে উঠলো। বাতাস আর স্রোতের সময় অনুকুল পথে আমি শুধু বৈঠা ধরে বসে থাকি। জলের স্রোত আর বাতাস আমার নৌকাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় দূরে বহু দূরে। তারপর প্রতিকুল পথে বৈঠা চালিয়ে অনেক পরিশ্রম করে ঘাম ঝরিয়ে ফিরে আসি আমি একলা একা। সে এক অন্যরকম অনুভূতি। কোশা নৌকায় বৈঠা মেরে জলের সঙ্গে লড়াই করে নদীতে ভাসতে যে বিপুল আনন্দ সেই আনন্দের ধারে কাছেও নেই ঝা চকচকে গাড়িতে স্টিয়ারিং হাতে ড্রাইভিং সিটে বসে থাকা। খুব মিস করি আমি আমার কালো সেই নৌকাটকে। কতো ঘুরেছি ওই নৌকাটা নিয়ে। নৌকাটা বাইবার সময় আমি গলা ছেড়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গানগুলো গাইতাম প্রাণ ভরে।
৪
পূব পাড়া আর পশ্চিম পাড়া মিলিয়ে আমাদের বাঁশগাড়ি গ্রামটা ছিলো খুব সুন্দর। কিন্তু অধিকাংশ মানুষই ছিলেন গরিব। তাঁদের পরনের পোশাক ছেঁড়া কিংবা মলিন। বাচ্চা এবং কিশোরদের গায়ে জামা নেই বেশির ভাগ। এরা উদোম গা-য়ে থাকে। পায়ে স্যান্ডেল নেই একজনেরও। এখানে কিশোরীরাও শাড়ি পরে। সালোয়ার কামিজ পরা কিশোরীর সংখ্যা হাতে গোণা। মহিলারা প্রায় প্রত্যেকেই মাথায় ঘোমটা দিয়ে রাখেন। বয়স্ক পুরুষরা বেশিরভাগই দাঁড়িঅলা। বৃদ্ধ আর বৃদ্ধারা রোগা-পটকা। পুরো গ্রামে মোটা মানুষ প্রায় নেই বললেই চলে। কঠিন শারীরিক পরিশ্রম আর খাদ্য-স্বভাবের গুণেই গ্রামে মোটা হবার সম্ভাবনা কম থাকে। সুঠাম দেহের মানুষ আছেন অনেক, কিন্তু জীর্ণ শীর্ণ মানুষের সংখ্যাই বেশি। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া অধিকাংশ বাড়িঘরগুলোয় দারিদ্র্যের ছাপ স্পষ্ট। বর্ণহীন ঘোলাটে টিনের চালের নিচে কেমন হলদেধুসর রঙের বেড়ার ঘর। কিছু বাড়ি পাটখড়ি দিয়ে বানানো। আমাদের বাড়িটা টিনশেড হলেও মোটামুটি ঝকঝকে। বাড়ি দেখেই বোঝা যায় এটা ধনাঢ্য গৃহস্থের বাড়ি। গ্রামের একমাত্র কুয়োটা ছিলো আমাদের বাড়ির সীমানার ভেতরেই। গ্রামের মহিলারা এখান থেকেই পানি সংগ্রহ করতেন কলস ভরে। আর গ্রামের একমাত্র মসজিদটাও আমাদের বাড়ির সীমানার ভেতরেই। গ্রামের লোকজন নামাজ পড়তেন সেই মসজিদেই। মসজিদটা আমার বাবার ভাগে পড়েছিলো বলে দ্বিতীয় একটা ঘর তোলার জন্যে পর্যাপ্ত জায়গা আমাদের ছিলো না।
গ্রামের ছেলেমেয়েদের আরবী পড়ানোর জন্যে একজন মুনশী ছিলেন। মুনশী থাকতেন ছোট্ট একটা টং মতোন ঝুপড়ি ঘরে। ওটা আমাদের বাড়ির সীমানার ভেতরে পড়েনি। মুনশী একা মানুষ। তিনি অন্য গ্রামের লোক। কিন্তু থাকেন এই গ্রামে। গ্রামের ছেলেমেয়েদের আরবী পড়ানোর বিনিময়ে তিনবেলা খাওয়া আর বছর শেষে একবার নতুন লুঙ্গি-পাঞ্জাবি-জায়নামাজ-টুপি এবং তসবিহ কিনে দেয়া হয় মুনশীকে।
মুনশীর খাওয়ার সিস্টেমটা ছিলো দারূণ! মাসের তিরিশ দিন ঘুরেফিরে পাঁচ-ছটা বাড়িতে তিনি খাওয়া-দাওয়া করতেন। কোন বাড়িতে কবে খাবেন সেটা পূর্ব নির্ধারিত। নির্ধারণ করে দিয়েছেন বাবা আর জেঠুরা। আমাদের বাড়িতে এক সপ্তাহ খাওয়ার কথা থাকলেও মুনশী ঘুরে ফিরে আমাদের বাড়িতেই খেতে আসতেন বেশিরভাগ সময়। শুধু দু’সপ্তাহ অন্যদের বাড়িতে খেতেন। ব্যবস্থাটা আমার কাছে খুবই চমৎকার লেগেছিলো!
লম্বাটে গড়নের টিঙটিঙে স্বাস্থ্যের মুনশীকে আমার বেশ সুখি মনে হতো। খুব হাসিখুশি থাকতেন সারাক্ষণ। কথা বলতেন নিচু স্বরে। আচরণে ভীষণ ভদ্র আর বিনয়ী। এমনিতে মুনশী গরিব মানুষ। কিন্তু গ্রামের লোকজনের শ্রদ্ধা ভালোবাসায় লোকটা টইটম্বুর। গৃহবধুরা মুনশীর জন্যে খুব আন্তরিকতা আর মমতা দিয়ে রান্না করেন। এই মানুষটার কল্যাণেই তাঁদের ছেলেমেয়েরা আরবী পড়তে শিখছে। লোকটাকে খাওয়ালেও সওয়াব। আমিও আরবী পড়েছি মুনশির কাছে। আমাকে তিনি খুবই ভালোবাসতেন। আমি খুব চটপটে স্বভাবের ছিলাম। মুনশি আমার কথাবার্তায় খুব মজা পেতেন। মন খুলে হাসতেন। তাঁর হাসিতে অপরূপ একটা মিষ্টি সারল্য ছিলো। আমাদের অনুকরণে আমার মাকে তিনিও ‘আম্মা’ সম্বোধন করতেন। আম্মা খুব যত্ন করে খাওয়াতেন এই মুনশিকে।
আরো পড়তে পারেন…
ভিনগ্রহীরা এসে পৃথিবী ঘুরে গিয়েছে- এমনটাই দাবি করলেন নাসার এক বিজ্ঞানী
দুনিয়া সেরা ১০ নিষিদ্ধ সিনেমার গল্প
৫
একাত্তরের অক্টোবর-নভেম্বরে আমাদের পরিবারে একজন নতুন সদস্যের আগমন ঘটলো। একটি মেয়েশিশুর জন্ম দিলেন আমাদের আম্মা। বাবা তখন চাকরি সুবাদে ঢাকায়। ছোট্ট কন্যা শিশুটির জন্মের দু’দিন পরেই যেনো বা কেয়ামত নেমে এলো গ্রামটায়। সকাল নয়টার দিকে খবর এলো মিলিটারি আসছে। গ্রামের নারী-পুরুষ-বৃদ্ধ-শিশুকিশোরের দল ছুটে পালাতে লাগলো উত্তর দিকে। সড়ক পেরিয়ে ক্ষেতের আল ধরে পড়িমরি ছুটে যাচ্ছে ভয়ার্ত মানুষের বিশাল কাফেলা, অন্য কোনো নিরাপদ গ্রামের উদ্দেশ্যে। পুরো গ্রাম জনশূন্য হয়ে গেলো খুব দ্রুত। জেঠুরাও কখন চলে গেছেন! শুধু আমরা, ভাইবোনেরা বসে আছি শুয়ে থাকা মাকে ঘিরে। মায়ের পাশে ছোট্ট কাঁথা মুড়ি দিয়ে নির্ভয়ে ঘুমুচ্ছে দু’দিন বয়েসী ছোট্ট তুলতুলে আমাদের বোনটা। আমরা পালাতে পারবো না। দু’দিন আগে যে মায়ের গর্ভ থেকে সন্তান ভূমিষ্ট হয় সেই মা দৌঁড়ুতে পারেন না। সুতরাং আমাদের কোথাও যাবার তাগিদ নেই। যা হবার হবে। যে কোনো পরিস্থিতির জন্যে আমরা প্রস্তুত।
সহসা উঠোনে হাঁকডাক শোনা গেলো মুনশির। আমি দৌঁড়ে তাঁর কাছে গেলাম। আমাকে দেখেই বিস্মিত মুনশি জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমরা এহনো বাড়িত্ বইসা রইছো! পুরা গ্রামে কুনো জনমানব নাই।’ বড় ভাই মুনশিকে জানালেন আমাদের ছোট্ট বোনটির কথা। বললেন, ‘এই অবস্থায় আম্মাকে নিয়ে পালানো সম্ভব না।’
হঠাৎ, নিচুস্বরে কথা বলা মায়ের দিকে চোখ তুলে না তাকানো মুনশি আশ্চর্য দৃঢ়তায় সাহসী রাজকুমারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন। আমাদের ঠেলে তিনি দরোজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। তারপর অনুচ্চ স্বরে বললেন, ‘আম্মা আমি আপনের আরেকটা সন্তানের মতোই তো! আমি আছি না! আমি আমার বইনটারে কোলে নিতাছি। আপ্নে কুনু চিন্তা করবেন না। তারে আমি খুব আস্তে কইরা কোলে রাখুম। আপনে আস্তে আস্তে হাঁটবেন। দৌঁড়ানের দরকার নাই। যা আছে কপালে। আপ্নের লগে লগে আমরা হাঁটমু। কুনু ডর নাই। আল্লা ভরসা। উঠেন। যাইতে হইবো। বাঁচতে হইবো। ছোডো বইনটারেও বাঁচান লাগবো আম্মা।’
মুনশির কথায় আম্মাও কেমন সাহসী হয়ে উঠলেন। অসুস্থ্য শরীরে উঠে দাঁড়ালেন আম্মা। আম্মাকে ঘিরে আমরা কয়েকটা কিশোর ভাইবোন। আমার বড় ভাই আর কিশোরী বোনটা দু’দিক থেকে আম্মাকে ধরে রেখেছে। আম্মার একেবারে সামনেই মুনশির কোলে একটা কাপড়ের পুটুলি। সেই পুটুলির ভেতরে দুইদিন আগে পৃথিবীতে আসা আমাদের ছোট্ট বোনটা পিট পিট করে তাকাচ্ছে! আহারে, কী বিপদেই না পড়েছে বাচ্চাটা পৃথিবীতে এসে!
অনাত্মীয় মুনশির নেতৃত্বে ধীর পদক্ষেপে আমরা হেঁটে যাচ্ছি আপাতত নিরাপদ দূরের একটা গ্রামের দিকে। সেই গ্রামে আমার মায়ের একজন ভাই থাকেন। মামা নিশ্চয়ই আমাদের আশ্রয় দেবেন।
সকালের উজ্জ্বল রোদ ক্রমশঃ তীব্র হচ্ছে। সবুজ দুর্বা ঘাস মুগ সরিষা আর কলুই ক্ষেতের অজস্র খুদে খুদে পাতায় জমে থাকা ভোরের শিশিরকণারা তখনো একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে লড়াই করে যাচ্ছে সূর্যের আলো ও তার উষ্ণতার সঙ্গে। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই পরাজিত হবে জেনেও।
আহা একাত্তর! তুমি আমাদের নিক্ষিপ্ত করেছিলে নৃশংসতা অমানবিকতা প্রেম সৌন্দর্য স্বপ্ন আর ভালোবাসার পরস্পর হাত ধরাধরি করে থাকা আশ্চর্য এক কুয়াশার ভেতরে!
অটোয়া ০১ ডিসেম্বর ২০১৮।
লুৎফর রহমান রিটন : বাংলাদেশের খ্যাতিমান ছড়াকার। নোট: লেখাটি লেখকের ফেসবুক ওয়াল থেকে নেয়া।
লুৎফর রহমান রিটন : খ্যাতিমান শিশুসাহিত্যিক। মূলত ছড়াকার হিসেবে তিনি সুপরিচিত। তিনি ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম তোফাজ্জল হোসেন এবং মাতার নাম আফিয়া আক্তার। নবাবপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে তিনি এসএসসি এবং ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লাভ করেন স্নাতক ডিগ্রী।
তাঁর উলেস্নখযোগ্য ছড়াগ্রন্থ গুলো হলো- ধুত্তুরি (১৯৮২), ঢাকা আমার ঢাকা (১৯৮৪) পানত্মাবুড়ি (১৯৮৭), তোমার জন্যে (১৯৮৯), ছড়া ও ছবিতে মুক্তিযুদ্ধ (১৯৮৯), রাজাকারের ছড়া (১৯৯০), শেয়ালের পাঠশালা (১৯৯২), শেখ বুজিবের ছড়া (১৯৯৪), পানত্মাবুড়ি (১৯৯৫) , মুক্তিযুদ্ধের ছড়া (১৯৯৭), ভাই-বোনের ছড়া (২০০৪) ইত্যাদি ছোটগল্প, নিখোঁজ সংবাদ (১৯৮৬), ঝন্টু পন্টুদের গোয়েন্দাগিরি (১৯৯২), ফুটবল (১৯৮৬)। এছাড়া বেশ কিছু উপন্যাস, জীবনীগ্রন্থ ও স্মারক গ্রন্থ রচনা করেছেন তিনি।
তিনি বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কারসহ বেশ কিছু পুরস্কার লাভ করেন-সিকান্দার আবু জাফর সাহিত্য পুরস্কার ১৯৮২, অগ্রনী ব্যাংক শিশু সাহিত্য পুরস্কার ১৯৮২ ও ১৯৯৬, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পুরস্কার ১৯৮৪, টেনাশিনাস পদক ১৯৯৭, জসীমউদ্দীন পুরস্কার ১৯৯৭, দাদাভাই শিশু সাহিত্য পুরস্কার ১৯৯৯ তাইমুর হোসেন স্মৃতি পদক ১৯৯৯।