প্রাগৈতিহাসিক এক সময় পেরিয়ে এলো মেয়েটি। তারপর যখন সে ট্রেনের দরজায় দাঁড়িয়ে ভাবছে আর তো মাত্র এক পা, দিলেই বা কি। সেই অন্তহীন কষ্ট থেকে এক মুহূর্তে রেহাই। নেমে যাবো, নেমে যাবো, সব চাহিদা পেছনে ফেলে। কিন্তু কি চেয়েছিলাম। নিজেই কি ছাই জানি, কি চেয়েছি। দুমুঠো ভাত, দুটো কাপড়, আর ঐ মাথার উপর রাতে অন্তত একটা ছাদ।
আচমকাই তার পিঠের উপর কে যেন হাত রাখলো। সে দেখেছে তার পিছনে একটি বছর ত্রিশের ছেলে দাঁড়িয়ে ছিল। সেই কি হাত রাখলো। না কি অন্য কেউ।
ঘুরে তাকালো সেই মেয়ে। একটি দু‘আড়াই বছরের ছেলেকে কোলে নিয়ে তার বাবা দাঁড়িয়ে আছে। আর সেই বাচ্চাটির হাত লেগে গেছে তার পিঠে। বাচ্চাটি এবার দুহাত উঠিয়ে তার কাছে চলে আসতে চাইছে। যেন সে তার মাকে খুঁজে পেয়েছে অনেকক্ষণ পর। একদিকে চলন্ত ট্রেনের খোলা দরজা দিয়ে হুহু অন্ধকার, অন্যদিকে —
মেয়েটি এবার সেই ছেলেটির চোখের দিকে তাকালো। ছেলেটি মেয়েটির যেন অন্তরাত্মার দিকে। তারপর ছেলেটি তাকে পাশ কাটিয়ে সরে এলো দরজার দিকে, ভেতরের দিকে যেতে বাধ্য হল মেয়েটি। বাচ্ছটি তখনও মেয়েটির কাছেই যেতে চাইছে। ছেলেটি তার বাচ্চাটিকে মেয়েটির কোলের দিকেই এগিয়ে দিলো। অন্যদিকে হাওয়া দূরন্ত হাওয়া, তার ওড়না উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে, তার বুক উথলে উঠছে বাচ্চাটির দিকে।
– মিনু। মা আমার কোথায় আছো। আজ থেকে তুমি এই ওড়নাটা পড়বে কেমন। তুমি তো এখন বড় হয়ে গেছো।
মিনু সেই প্রথম যেন শুনেছিল সে বড় হয়ে গেছে, তারপর সে আয়নার সামনে যতবার দাঁড়িয়েছে লজ্জা হয়েছে খুব। কিন্তু আজ এই অপরিচিত মানুষটির দিকে তাকিয়েও কেন জানিনা কোনো লজ্জা বোধ আসছে না। তার ওড়না উড়ে যাচ্ছে আকাশের দিকে। তার ভরাট বুকদুটি তাদের চাহিদা নিয়ে যেন এগিয়ে যাচ্ছে আলোর খোঁজে। অথচ কোনো লজ্জা নেই। বাচ্চাটি হয়তো এখনও তার মায়ের দুধ খায়, সে খুঁজে পেয়েছে, সে মুখ নিচু করে খেতে চাইছে, খিদে পেয়েছে তার নিশ্চয়ই। মেয়েটি বাচ্চাটিকে বুকের মধ্যে জাড়িয়ে ধরলো। চোখ বুজে এলো অজান্তে।
একটা কান্না একটা কান্নার শব্দ। দিগন্তের ওপার থেকে একটা বুক ফাটা কান্নার শব্দ। অথচ তা শোনা যায় না। কান্না যেন মুখের মধ্যেই রয়ে যায়। বেরিয়ে আসতে পারে না। তাকিয়ে দেখলে বোঝা যায় কতটা কষ্ট পাচ্ছে সে। চোখ বুজে অনুভব করা যায় তার স্বর।
– কি হয়েছে মা এত কাঁদেনা, তুমি না বড় হয়ে গিয়েছো। এখনকি আর পুতুলের জন্য কাঁদলে মানায়। এবার তো পাকা গিন্নি হওয়ার সময় হয়ে এলো।
চোখ খোলে মেয়েটি বাচ্চাটি তার বাবার কাছে চলে যেতে চাইছে। সে দিয়ে দিলো। আবার সে মিনুর দিকেই আসতে চায়, এই যেন এক খেলা। একবার বাবার কাছে। একবার মিনুর কাছে। খেলছে বাচ্চাটি, সিটে বসে দেখছে তার মা। তার ছেলে কিভাবে যেন হারিয়ে যাচ্ছ। আবার ফিরে আসছে বাবার কোলে।
– অমন বুকের নিচে বালিশ রেখে উপুর হয়ে শুয়ে কি ভাবছো মা। উপুর হয়ে বেশিক্ষণ শুয়ে থাকে না। বুকে ব্যাথা হবে। তোমার মা যদি থাকতো তবে তোমার মনের কথা বুঝতে পারতো। আমাকে না পারো তো তোমার মাসিকে বোলো।
মিনু দুখের মাঝে যেন তলিয়ে গেছিল অতলের দিকে। ছেলেটির বাবা তাকে ইশারায় তাদের সাথে বসতে বলল। মিনু এবার মন্ত্রচালিতের মতো এগিয়ে যাচ্ছে। প্রায় তারই সমবয়সী এক মেয়ের দিকে। যার কোলে এমনই এক বাচ্চা এসেছে।
– মিনু কোথায় যাচ্ছ মা তুমি মিনু। তোমার মাসিকে অন্তত বলেছো।
মিনু ধীরে এসে সেই মায়ের কাছে বসে। সেই মা তার ছেলেকে তুলে নেয় মিনুর কাছ থেকে। সে এবার দুধ দেবে। মিনু দেখতে পায় বর্তুল এক সুধা পাত্র যেন নিযের চক্রাকার বাদামী আকাশগঙ্গা নিয়ে তার ব্লাউজের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসছে বাচ্চার মুখের উপর। ছেলে সে অমৃত মুখে নিয়ে দুড়ুম দুড়ুম করে পা ছুঁড়ছে আর সিটের উপর শব্দ হচ্ছে খুব। আনন্দের যেন কোনো সীমানা নাই সেই ছেলের, সে তার মায়ের দুধ পেয়েছে। তার বাবা পিছনে দাঁড়িয়ে দেখছে তাদের। সহসা তার মিনুর দিকে চোখ গেল।
একটি অনন্য সাধারণ মেয়ে থেকে সে এবার সত্যিকারে তার ফেলে আসা মিনুতে পরিণত হয়ে যাচ্ছে। বাচ্চাটির পায়ের শব্দ যেন তার সেই বন্ধ হয়ে যাওয়া ঘরের দরজায় আঘাত দিচ্ছে একটানা। শব্দ হচ্ছে খুব খুলতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু কি যেন এক সংকোচ—
– দরজা খোল মিনু মা, কি হয়েছে বল। সেই সকাল থেকে বন্ধ করে বসে আছিস। তোর মাসিকে ডাকলাম, কতদূর থেকে সে এসেছে, কথা বল তার সাথে। না হলে যে তাকে অপমান করা হয়। অন্যদিন ডাকলে আর আসবে না।
মিনু অনেকক্ষণ পরে এসে দরজা খুলে দিয়ে আবার বিছানায় উঠে গেল। তার মাসি এসে হাত রাখলও তার পিঠে।
ট্রেনের ছেলেটি কিন্তু একভাবে তার দিকে তাকিয়ে আছে, মুখে কোনো কথা নেই। চোখ অনুভূতির শ্রেষ্ঠ মাধ্যম, যার কাছে হেরে যায় মানুষ। মিনুও কি হেরে যাবে। তার কি এই হেরে যাওয়া মানায়। এত দিন গেছে রাত গেছে সে তো হারেনি। হেরে যাওয়াকে সে ঘৃণা করে। ঘৃণাই করে এসেছে সে, তার জন্ম, তার ছেলে বেলা, তার অতীত তার বর্তমানকে। কিন্তু তার ভাগ্য সে নিজে হাতে গড়বে। সেখানে কারোর অধিকার নেই। এগবে সে যেকোনো মূল্যে, যেকোনো মূল্যে।
– মিনু মা আমার একটু ঘরের দিকটা দেখো, একটু নিজের দিকটা দেখো। তুমি কোথায় জন্মেছো। কোথায় বড় হয়েছো তুমি। সবকিছুরই একটা সীমারেখা থাকে, তাই না।
মিনু দেখছে সেই ছেলের বাবা যেন তার সীমারেখা ভেদ করে তাকিয়ে দেখছে তার দিকে। বাচ্চাটি মায়ের বুকের আঁচলের ভিতর থেকে টুকি টুকি খেলছে তার দিকে তাকিয়ে। একবার সে দুধ মুখে নিচ্ছে, একবার মুখ সরিয়ে দেখে নিচ্ছে তাকে। তার হয়তো পেট ভরে গেছে কিন্তু মায়ের বুক ছাড়তে চাইছে না। টুকি টুকি খেলা আর প্রাণ ভোলানো হাসি। তার মা তাকে উঠিয়ে দিতে চাইছে কিন্তু সে কিছুতেই ছাড়বে না। তার বাবা তাকে টেনে তুলে নিলো জোর করে। তবু সে কিছুতেই উঠবে না। শুয়ে থাকবে তার মায়ের কোলের উপর। হাত পা ছুঁড়ছে সে, মিনু হাত বাড়ালও।
একটা অবুজ হাওয়া, কিছু ছেঁড়া কাপড়, কিছু ঝরা পাতা মিনুর দিকে উড়ে আসছে সেই কখন থেকে। সে তার শাড়ি সামলাতে ব্যাস্ত। কিভাবে যে মানুষ এই সব কিছু নিয়ে চলা ফেরা করে। কে জানে। শাড়ি সায়া ব্লাউজ টুকরো টুকরো এতগুলি কাপড়। একসাথে কি জুড়ে দেওয়া যায়না। এতকিছু পরেই বা লাভ কি সেই তো দেহের অনেকটাই দ্যাখা যায়। শাড়ি নিজেকে ঢেকে রাখার জন্য নাকি দেখানোর জন্য।
–মিনু মা আমার হাত বাড়াও কিন্তু নিজেকে সামলে। তোমার কাপড় তোমাকে ঢাকার জন্য।
মিনু বাচ্চাটিকে তুলে নিলো। তার মা কাপড়ে ঢেকে নিলো নিজেকে, ছেলে কোলে নেওয়া, বুক খুলে দুধ দেওয়া। যেন কত সাবলীল। এ দৃশ্যে শান্তি আছে, পুণ্য আছে কিছু। এত মানুষ চারিদিকে, সব অপরিচিত তবু এ ছবিতে কোনো খোট নেই। ভুল নেই কিছু। বাচ্চাটি পা দাপিয়ে বাবার কাছে চলে যাবে। বাবা মৃদু হাসিতে বলবে আমি আছি, ভয় নেই। আর অন্যদিকে মিনু সে যখন তার কোল থেকে সেই ছেলেকে তুলে দিচ্ছে তার বাবার দিকে। বাড়ানো হাতের আঁচ পেল যেন।
এমনই কোনো আঁচ কি সে চেয়েছিল তার বুকের উপর নেমে আসবে। তাকে শূন্যে তুলে ভাসিয়ে দেবে ইথারে। জানেনা সে, জানার সময় পেরিয়ে গেছে। ভেশে যেতে সুখ আছে, স্বপ্ন দেখতে দেখতে ঘুমের মাঝে যদি বিষও কেউ দেয় তাও আরাম। যে যাই বলে বলুক এক মুহূর্ত যদি বাঁচি নিজের জন্য।
– মিনু, চলে যাচ্ছ নাকি ফিরে আসছও ঘরে। দেখো ফেরার রাস্তা কিন্তু খুবই সংকীর্ণও। আসলে ফেরার কনো পথই নেই, লোভ আছে মানুষের। শুধু লোভ।
– কিন্তু বাবা আমি কি নিজের জীবনটা গড়ে তুলতে পারিনা।
– পারো, অবশ্যই, কিন্তু পরিশ্রমে, কোনো রকম সর্ট-কার্টে নয়।
ছেলেটি আবার তার সেই পুরনো খেলায় মেতে উঠেছে। এবার তিন জনের মাঝে। একবার তার বাবা, একবার তার মা, একবার মিনু। সে টলোমলো পায়ে, তবু কি স্থিরতা, কি বিশ্বাস।
তাদের হয়তো ষ্টেশন এসে গেছে, নেমে যাবে তারা। উঠে দাঁড়ালো সবাই একসাথে। উঠে দাঁড়ালো সেও। কিন্তু তার গন্তব্য। মিনুর ভিতর কিন্তু কেঁদে ওঠার পরিবর্তে ছেলেটির বাবার দিকে ফিরে তাকালও। সে কি মানুষের ভিতর পর্যন্ত দেখতে পারে। কত স্থির তার চোখের ভাষা। এতক্ষণে সেই মানুষের মুখ থেকে প্রথম কথা উঠে এলো, সে তার ছেলের দিকে তাকিয়ে বলল
– মাথা ধরার সবচেয়ে বড় ওষুধ। নাহলে আর আমরা বেঁচে আছি কিভাবে।
মিনু আবার ট্রেনের দরজায় দাঁড়িয়ে, হাত বাড়িয়ে টাটা করলো বাচ্চাটিকে।
সুকান্ত দেবনাথ : গল্পকার, দুর্গাপুর, পশ্চিম-বর্ধমান, পশ্চিমবঙ্গ