গল্প সাহিত্য

বালক শ্বশুর ।। ইসরাত শিউলী

নরসুন্দা ডটকম   জুন ১৪, ২০২০
বালক

কন্যা বাপের বাড়ি ছাড়িয়া শ্বশুরালয়ে যাইবার কালে যেরূপ কান্নাকাটি করিয়া থাকে, আমি আমার মেসবাড়িটি ছাড়িয়া আসিবার সময় প্রিয় মহিয়সী বন্ধু সোনিয়ার গলা জড়াইয়া ধরিয়া তাহার তিনগুণ কাঁদিয়াছিলাম। এমনকি কান্নার চোটে বার কয়েক বমিও হইয়াছিল।

বিষাদঘন বিদায়-মুহূর্ত অতিক্রম করিয়া ভারাক্রান্ত চিত্তে কর্তা সাহেবের পিছন পিছন বাহির হইয়া পড়িলাম। কর্তা সাহেবও কালক্ষেপণ না করিয়া নব পরিণীতা স্ত্রী আর শ্বশুরবাড়ি হইতে প্রাপ্ত ৫/৬ বস্তা পুস্তকাদি নিয়া সুড়সুড় করিয়া নতুন ঠিকানায় উঠিয়া পড়িলেন। নতুন সংসার গোছাইতে গিয়া বারবার মনে হইতেছিল, আহা! আমার ‘নবাব সিরাজী’র (আম্মা প্রদত্ত নাম) ন্যায় আয়েশি জীবনের বুঝি এইখানেই অবসান ঘটিল।

নতুন বাসায় আসিবার পর শ্রমজীবী জীবনে আমার এক টুকরো আনন্দ ছিলো, দীর্ঘ নামধারী, গাবলু-গুবলু, মুগ্ধ করা, ছয় বৎসরের এক মিষ্টি বালক।পুরান ঢাকাইয়া কোন বালকের মুখে এতো সুন্দর বাংলা বচন ইতোপূর্বে কখনও শুনি নাই। যদিও বালকের নাম মনে রাখিতে আমাকে টানা দুই কি তিনদিন অনবরত জপিতে হইয়াছিল। কয়েক দিনের মধ্যে উনার সহিত আমার চরম বন্ধুত্ব বনিয়া গেল।

তবে তাহার নাম ধরিয়া ডাকিতে আমার কিঞ্চিত অসুবিধা হইত। কারণ ‘যায়ান মুহাম্মদ আযান মিকাত মুত্তাকিম ওরফে নীর’ নামখানি ধরিয়া ডাকা তো চাট্টিখানি কথা নয়। আমাকে রান্না করিতে দেখিলে সে আসিয়া কৌতুহল প্রকাশ করিত-

– আন্টি, কী করো?

– রান্না করি, বাবা।

– কী রান্না করো?

– মুরগি রান্না করি, বাবা।

– ও, চিকেন! চিকেন তো আমার খুবই পছন্দ। আমাকে দিয়ো তো, খেয়ে দেখবো…

মাঝে মাঝে তাহাকে আমার নিজের শ্বশুর বলিয়া বোধ হয়। বেচারা বৌমার হাতের রান্না কেমন হইয়াছে তাহা টেস্ট করিতে আসিয়াছে। আহা রে, আমার ক্ষুদে শ্বশুর বাবাজি!

তাহার সহিত সাক্ষাৎ ঘটিলে প্রথম কথাই হইল, ‘আন্টি, কী করো?’ এমনকি শৌচাগারে থাকিলেও বাহিরে দাঁড়াইয়া চেঁচাইবে, ‘আন্টি, কী করো?’ একদিন তো শৌচাগার হইতে বাহির হইয়া তাহাকে ধমক দিয়া বলিলাম, ‘ঐ ব্যাটা, ওয়াশরুমে গিয়ে মানুষ কী করে, হ্যাঁ?’

সে তো হাসিয়াই খুন।

একদিন স্কুলের ডিউটি সমাপন করিয়া বাসায় ফিরিলাম। খানিক বাদেই তিনি আসিয়া হাজির।

– আন্টি, কী করো?

– কিছু করি না।

– খেয়েসো?

[প্রিয় পাঠকের জ্ঞাতার্থে বলিয়া রাখা আবশ্যক- আমার এই ক্ষুদে শ্বশুর ‘চ/ছ’ এর উচ্চারণ করেন ইংরেজি ‘এস’ এর মতো। ‘খেয়েছো’ না বলিয়া তিনি বলেন- ‘খেয়েসো’]

– হ্যাঁ, খেয়েছি, বাবা।

– জানো আন্টি, তুমি যখন বাসায় ছিলা না, আমি তোমার ছেলেদের গ্লাসে করে পানি খাইয়েছি। আচ্ছা, (রেলিং-এ ঝোলানো টবগুলিকে ইঙ্গিত করিয়া) ওরা কী সত্যিই তোমার ছেলে?

– হুম।

– আচ্ছা, তাহলে ওরা তো আমার ভাই, তাই নাহ? ওদের নাম কী বলো?

– ওদের নাম হলো- বিরুৎ।

– আচ্ছা আন্টি, তুমি কবে মরবা?

– অ্যাঁ, কেনো? আন্টিকে মরতে হবে কেনো, বাবা?

– না মানে, তুমি মরলে, তোমার ছেলেগুলোকে আমি নিয়ে যাইতাম। আর ওদের সাথে একটু ক্রিকেট খেলতাম। দেখো না, আমার বাবা সবসময় বাসায় থাকে না। তখন তো খেলতে পারি না।

 এই তো কয়েকদিন আগের কথা, দেশে লকডাউন চলিতেছে। অফিসের ছুটিহেতু কর্তামশাই বাসায়ই অবস্থান করিতেছেন। আমার কাজের পরিধিও বেশ বাড়িয়াছে। এইদিকে সকাল হইতে বিদ্যুৎ বড়োই জ্বালাতন করিতেছে। সন্ধ্যা অবধি যাওয়া-আসার মধ্যেই আছে। হঠাৎ ক্ষুদে শ্বশুর আসিয়া উপস্থিত।

– আঙ্কেল কী করো?

– বসে আছি।

– অনেক গরম, নাহ?

– হুম।

– আচ্ছা আঙ্কেল, আজকে কারেন্টের কী হইসে, বলো তো?

– আজকে কারেন্টের আম্মা মরছে তো, তাই এমন করতেছে (কর্তামশাই একটু রসিক স্বভাবের কিনা)।

 খানিক বাদে শুনিতে পাইতেছিলাম, রান্নাঘরে গিয়া তার মাকে বলিতেছে-

– আচ্ছা মা, কথা কি সত্যি?

কোন কথা?

– (অতিশয় সিরিয়াস ভঙ্গিতে) আজকে নাকি কারেন্টের আম্মা মারা গেছে।

শুনিয়া তাহার মা মুখ টিপিয়া হাসিলেন। অতঃপর মৃদু ধমক সহকারে ঘরে পাঠাইয়া দিলেন।

বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাস পরিস্থিতি, দেশের সার্বিক পরিস্থিতি এবং কঠিন বাস্তবতার নিরিখে উভয়ে মিলিয়া সিদ্ধান্ত লইয়াছি- এই বাসাখানি ছাড়িয়া দিয়া কর্তাসাহেবের কর্মস্থলের নিকটে থিতু হইব। সেই মোতাবেক প্রস্তুতিও চলিতেছে। কয়েকটা দিন ধরিয়া ‘চলিয়া যাইতেছি’ বা ‘চলিয়া যাইবো’ ভাবিলেই ঐ পরানকাড়া অবোধ বালকটির জন্য মনটা কেমন যেন পোড়াইতেছে। তাহার বিস্তর দুরন্তপনা সমুদয় পিছনে ফেলিয়া যাইতে হইবে- একেবারেই মানিয়া লইতে পারিতেছি না। মিষ্টি ছেলেটি যখন হইতে ‘চলে যাবো’ শুনিয়াছে, বড়ো মনমরা হইয়া পড়িয়াছে। আজকাল বড়ো একটা কাছেও আসিতে চায় না। জানি না, ওর ছোট্ট হৃদয়ে কী চলিতেছে। জীবন বুঝি এমনই, মালবাহী নৌকার ন্যায়। ঘাটে ঘাটে থামিয়া ক্ষণিকের তরে সওদা করে, ফের নতুন নতুন ঘাটে গিয়া বাজার জমায়। অতঃপর তাহাকে ছুটিতে হয় নতুন কোনো ঘাটের খোঁজে।


ইসরাত শিউলী, জন্ম ও বেড়ে ওঠা কিশোরগঞ্জ জেলা শহরে। কৈশোরের শুরুতেই লেখালেখি, বিতর্ক ও অভিনয়ের হাতেখড়ি। কিশোরগঞ্জের ‘প্রচিত সাংস্কৃতিক পরিবার’-এর হাত ধরে আবৃত্তিচর্চার শুরু। ঢাকার ঐতিহ্যবাহী সংগঠন ‘কণ্ঠশীলন’-এর মূল দলে আবৃত্তি করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। পড়াশোনা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে। বর্তমানে সাহিত্যপত্রিকা ‘ৎ’ (খণ্ড-ত)-এর নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে কর্মরত।

আরও পড়তে পারেন….
ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে কাশবন- মার্জিয়া লিপি
বদরুজ্জামান আলমগীরের কবিতা- বাউবাব
কাপ ডিশ ও ভাঙা সকাল ।। ঋভু চট্টোপাধ্যায়

About the author

নরসুন্দা ডটকম