গল্প সাহিত্য

মনির হোসেন এর গল্প “বিয়োগ”

নরসুন্দা ডটকম   আগস্ট ৫, ২০২০
বিয়োগ

‘শুভ, গত রাতে আমি স্বপ্ন দেখি-সমগ্র পৃথিবী নিদ্রামগ্ন। শুধু আমি একা একা রাত জেগে শরতের আকাশে জোছনা দেখছি। মাঝে-মাঝে হুতুম পেঁচা ডেকে উঠে। আকাশে নিশুতি পাখি ডানা ঝাপটিয়ে শব্দ করে। হঠাৎ এরকম শব্দে পিলে চমকে যায়, শুনে ধুক ধুক করে বুক। তবু ঘরে যাই না। রাত জেগে তোমাকে নিয়ে সোনালী স্বপ্নের লহর বুনছি। হঠাৎ দেখি দূর আকাশের বিশাল বুক থেকে একটি নক্ষত্র খসে পড়ে, ঠিক আমার সামনে। তখন আমি ভয়ে চিৎকার দিয়ে উঠি।’

স্বপ্নের একথাগুলো শুনে শুভ স্বাভাবিক ভাবে বলল, ‘এতে কী হয়েছে’?

কী হয়েছে মানে! শাস্ত্র মতে, ‘আমারও এমন একটা মূল্যবান জিনিস হারিয়ে যাওয়ার কথা। আমার মূল্যবান জিনিস তো হলে তুমি, শুধু তুমি।’ কিন্তু নক্ষত্রের খসে পড়ার মতো তুমিও আমার জীবন থেকে হারিয়ে যাও-আমি তা চাইনা। শুভ, চলো আমরা ভারতে চলে যাই।

চিত্রার এ অনুরোধে সম্মতি না দিয়ে শুভ বললো, ‘‘ধ্যাৎ, কি সব আজে-বাজে আর স্বার্থপরের মতো কথা বলো। যে দেশের আলো-বাতাসে আমার বেড়ে উঠা, স্বপ্ন বুনা; সে দেশমাতার বিপদে আমি পালিয়ে আত্মরক্ষা করবো? দেশ মাতার প্রতি বিশ্বাস ঘাতকতা করবো? না, কখনো যাব না। আমি যুদ্ধে যাব। প্রয়োজনে দেশের তরে আমার তাজা প্রাণ বিলিয়ে দেব। বিনিময়ে দেশমাতাকে স্বাধীন করবো।’’

তারপরও চিত্রা তাকে বারবার অনুরোধ করছে পালিয়ে যেতে। কেননা, চিত্রা তার ভালবাসার মানুষটাকে হারাতে চায় না। হারাতে চায় না ছোটবেলার খেলার সাথী ও যুবতী বয়সের প্রিয় মানুষটাকে। চিত্রা তার তিলেতিলে গড়া ভালবাসা নিয়ে স্বপ্নের পৃথিবী গড়তে চায়। শুভ চিত্রাকে বুঝাতে চেষ্টা করে। শুভ বলে- ‘দ্যাখো চিত্রা, স্বপ্নের সাথে বাস্তবতার কোন মিল নেই, তাই এতো ঘাবড়ানোর কোনো কারণ নেই। তুমি শুধু আমার জন্য দোয়া কর-যেন যুদ্ধে জয়ী হতে পারি। চিনিয়ে আনতে পারি বাংলার হারানো স্বাধীনতা। আর তবেই তোমাকে নিয়ে সংসার সাজাবো। স্বাধীন দেশে স্বাধীন নাগরিক হিসেবে বসবাস করবো, বুক ভরে নেব নি:শ্বাস। মুক্ত প্রাণের মুক্ত নি:শ্বাস। তখন দ্যাখবে স্বাধীন দেশে সুখে-সুখে ভরে আছে আমাদের সাজানো ঘর। বছর দু’এক পর তুমি হবে আমার সন্তানের মা, আমি হবো বাবা…। এবার হাসিমুখে আমাকে বিদায় দাও প্রিয়া।’

শুভকে অশ্রুসিক্ত নয়নে অনেকক্ষণ দেখে নেয়ার পর চিত্রা আর্দ্রকণ্ঠে বললো, ‘মাঝে মাঝে খবরা-খবর পাঠিও।’ শুভ এ সংকটময় মুহূর্তেও ভালবাসার উষ্ম আবেশে আলতোভাবে একটা চুম্বন এঁকে দেয় প্রিয়তমা চিত্রার কপালে। যুদ্ধে যাওয়ার জন্য বিদায় নেয় শুভ।

আস্তে আস্তে সমস্ত বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে পাকবাহিনী ছড়িয়ে পড়ে। বর্বর হামলা ও নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালায় অগুণিত মানুষের উপর। তারা এদেশে বাবার সামনে ছেলেকে হত্যা করে, ভাইয়ের সামনে সম্ভ্রমহানী করে বোনের। হত্যা করে অগুণিত নিরস্ত্র-নিরীহ বাঙালীকে। গ্রামকে-গ্রাম আগুন লাগিয়ে পুঁড়িয়ে দেয়। সেদিন সন্ধ্যায় আগুনের লেলিহান শিখা দেখা গেল ধূয়াশাপুর গ্রামে। চেঁচামেচি আর উদভ্রান্ত ছুটে চলা। কেউ কারো খবর রাখেনি। কতশত শিশু আগুনে পুঁড়ে হয়েছে ভষ্ম। যে যেদিকে পেরেছে সেদিকে পালিয়েছে। কোনো রকমে পালিয়েছে চিত্রারাও। ভারতে এক প্রদেশে আশ্রয় নেয় চিত্রা ও তার পরিবার। তারা অনেকটাই নিরাপদ। কিন্তু শুভ? শুভ’র কথা ভাবে চিত্রা। শত সংকোচের মধ্যে একটা একটা সংকোচ সবসময় চিত্রার মনে হানা দেয়; শুভ যদি আর ফিরে না আসে! শুভ যদি যুদ্ধে শহীদ হয়ে যায় তবে চিত্রা কী করবে? কাকে নিয়ে বাসবে?

আকাশবাণী কলকাতা থেকে যুদ্ধের খবর প্রচারিত হয়। খবর পড়ুয়া যখন বলল, ‘স্বাধীনতা যুদ্ধ অনেকটাই বাংলাদেশের অনুকূলে’ তখন সকলের সাথে চিত্রাও অনেকটা স্বস্তি পায়। স্বপ্ন দেখে এক নব-ভোরের।

১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে খবর প্রচার হলো। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজী ৯৩ হাজার সৈন্য ও অস্ত্রসহ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) যৌথ বাহিনীর নিকট আত্মসমর্পন করে। স্বাধীন বাংলার আকাশে উড়ে লাল-সবুজের পতাকা। সেদিন থেকেই শুভ’র ফিরে আসার প্রত্যাশায় পথ চেয়ে বসে আছে প্রেমিকা চিত্রা। পথ চেয়ে থাকে শুভ কখন আসে। অপেক্ষার প্রহর গুণতে গুণতে অতিবাহিত হয় চার-চারটি বছর। তবুও সে পথ চেয়ে আছে শুভ’র ফিরে আসার প্রত্যাশায়। চিত্রার বিশ্বাস শুভ এখনো বেঁচে আছে। অবশেষে তার বিশ্বাসের মৃত্যু না হলেও সমাজের নানা কথায় মা-বাবা তাকে বিয়ে দেয় তমালের সাথে। প্রেমের স্মৃতি চিত্রার হৃদয়ে নিরবে নিভৃতে গুমড়ে-গুমড়ে কাঁদে। তারপরও ভালই কাটছিল তাদের দাম্পত্য জীবনের দূর্গাপুরের দিনগুলো। কিন্তু বড় দঃখের বিষয়, দু’বছর পার হতে না হতেই পান থেকে চুন খসে পড়ে। জীবনের পাতা থেকে হারিয়ে যায় তার স্বামী তমাল। সদ্য বিবাহিতা চিত্রা তার স্বামীকে হারিয়ে একেবারে নি:স্ব হয়ে যায়। জীবনের দ্বিতীয় দফায় এ বিয়োগান্তরকে কোনো ভাবেই মেনে নিতে পারছে না চিত্রা। অনেকটা মনমরা ও শুকিয়ে গেছে চিত্রা। কেননা স্বামী হারানোর বেদনা ও প্রেমিককে না পাওয়ার ছাই-চাপা কষ্টের কথা কেউ বুঝতেও চায় না, শুনতেও চায়না। রবং রাক্ষসী বলে কলঙ্ক দেয়। আর তখন থেকেই চিত্রা তার মনের সাথে কথা বলে। কবিতা লেখে। আস্তে আস্তে চিত্রা বড়মাপের কবি হয়ে উঠে। স্বাধীনতার পর আজ অবধি তিন দশক কেটে যায়। তখনো ধুঁকে ধুঁকে বেঁচে আছে প্রৌঢ় বয়সের কবি চিত্রা।

বিভিন্ন বই প্রকাশনার কাজে কবি চিত্রা প্রায়-ই ঢাকা আসে। একদিন ঢাকা থেকে যাওয়ার পথে নেত্রকোণায় একদিনের জন্য অবস্থান করে চিত্রা। সেদিন ছিল ১৫ ডিসেম্বর। বিজয়ের মাস। উদ্যাপিত হচ্ছে ‘শহীদ শুভ দিবস’। সূর্য তরুণ সংঘের আয়োজনে আলোচনা অনুষ্ঠানে, ‘মাসিক কলম’, এর সম্পাদক শাহনাজ আক্তার শাহানা শহীদ শুভ’র জীবন বৃত্তান্ত নিয়ে আলোচনা করছেন। সম্পাদক শাহানা তার ম্যাগাজিনের পাতা থেকে পড়ছেঃ- ‘‘দরিদ্র পরিবারের দেশ প্রেমিক সাহসী ছেলে শহীদ শুভ বেড়ে উঠে শহরের অদূরে ধূয়াশাপুর গ্রামে। পিতৃহারা শুভ’র মা সেখানে কোন এক ভূপতির বাড়িতে কাজের বুয়া হিসেবে কাজ করতো এবং শুভ মনিবের মেয়ে চিত্রার সঙ্গে খেলাধুলা করতো এবং স্থানীয় পাঠশালায় লেখাপড়া করতো। দিনে দিনে তারা বেড়ে উঠে। মনের অজান্তেই তাদের মাঝে গড়ে উঠে দুর্দ্যম ভালবাসার অপ্রতিরোধ্য অবিচ্ছেদ্য জাল। তখন দেশের দূর্যোগ মুহুর্ত। যৌবনিক ভালবাসার পাশাপাশি শুভ দেশ মাতার ভালবাসার টানে ঝাঁপিয়ে পড়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে। তারপরও প্রেমিক ও যুদ্ধা শুভ, প্রিয়তমা চিত্রাকে ভুলেনি। অবশেষে আজকের এইদিনে অর্থ্যাৎ ১৫ ডিসেম্বর শুভ শহীদ হন। মৃত্যুর পূর্ব মূহুর্ত পর্যন্ত তিনি প্রাণপণ যুদ্ধ করেছেন। যেদিন শুভ শহীদ হন, সেদিন তার প্রেমিকা চিত্রাকে উদ্দেশ্য করে একখানা পত্র রচনা করেন শুভ। রক্ত ভেজা সেই ছোট্ট চিঠিটি সহযোদ্ধারা সংরক্ষণ করেছিল।’’ আমি সে চিঠি থেকে হুবুহু পড়ছিঃ-

‘‘প্রিয়তমা চিত্রা, আর মাত্র কয়েকটি দিন অপেক্ষা করো লক্ষ্মীটি দোয়া করো যাতে যুদ্ধে জয়ী হতে পারি। ইনশাল্লাহ্ যুদ্ধ জয় করেই বাড়ি ফিরবো। তারপর তোমাকে আমার বউ সাজাবো। ইতি শুভ’’

শাহানার এই বক্তব্য শুনে কবি চিত্রা চমকে উঠে। সঙ্গে সঙ্গে ম্যাগাজিন হাতে নিয়ে দেখে সত্যিই এ তার প্রেমিক শুভ। যার ফিরে আসার প্রত্যাশায় তিন দশক পথ চেয়ে আছে চিত্রা। ছবিটি দেখতে দেখতে কবি চিত্রার চোখ জল পর্দায় ঝাপসা হয়ে আসে। কবি চিত্রা তার জীবনের হিসেব কষে দেখে তার জীবনে কখনো যোগ আসেনি; সব সময় এসেছে শুধু বিয়োগ।


আরও পড়তে পারেন….
সুস্বাস্থ্য সম্পর্কে জানতে হবে ।। তাহ্ নিয়া কাদের
আমরা যাকে নাম দিয়েছি ।। ছাদেকুর রহমান
বালক শ্বশুর ।। ইসরাত শিউলী

About the author

নরসুন্দা ডটকম