বই আলোচনা

বই আলোচনা: বিপন্ন সিরিয়ার গল্প

নরসুন্দা ডটকম   ডিসেম্বর ২১, ২০১৬

।। ফয়সাল আহমেদ।।

সাম্প্রতিক সময়ে সারা দুনিয়ায় আলোচিত রাষ্ট্র সিরিয়া। ক্ষমতার লড়াইয়ে ঠিকে থাকার জন্য পক্ষ-বিপক্ষ শক্তির যুদ্ধ যুদ্ধ খেলার বলি সে দেশের সাধারণ মানুষ। কোথায় যাবে তারা? পালিয়েও যে প্রিয় প্রাণ রক্ষা করতে পারছে না তারা। মনে পড়ে যায় আয়লানের কথা। এই তো সেদিন, গৃহযুদ্ধে আক্রান্ত সিরিয়া থেকে নবজীবনের স্বপ্নে পালিয়ে ছিল আয়লানের পরিবার। প্রথমে তারা আশ্রয় নিয়েছিল প্রতিবেশি দেশ তুরস্কে। এরপর সেখান থেকে গ্রীস যাওয়ার পথে নৌকা ডুবে মৃত্যুর মুখে পতিত হয় আয়লান ও তার পরিবার। প্রাণ হারায় তার মা ও ভাই। তুরস্কের সমুদ্র সৈকতে পড়ে থাকা শিশু আয়লানের নিথর দেহ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে ঘুম ভাঙ্গে মানবিক বিশ্বের। বিপন্ন সিরিয়ার প্রতীক শিশু আইলান কুর্দি। মুহুর্মুহু বন্দুকের গুলি আর বোমার বিস্ফোরণের শব্দে দেশটির সাধারণ মানুষের আত্মচিৎকার সীমানা পেরিয়ে বাইরের দুনিয়ায় পৌাঁছায় না। কিন্তু সেখানকার আর্তনাথ ঠিক পৌঁছে যায় সিরিয়ার মানবিক গল্পকার জাকারিয়া তামেরের কাছে। এর প্রকাশ আমরা তাঁর লেখায় দেখতে পাই।

zakaria-tamerer-golpo

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে তুমি কে? শিরোনামে জাকারিয়া তামের লিখেন-
‘সিরীয় কে? সিরীয় হচ্ছে এক অচেনা নাগরিক; মুক্তির পথ হিসেবে মৃত্যু, কারাগার, ভোগান্তি, সহিষ্ণুতা কিংবা নিজের মর্যাদা ক্ষুন্ন করার পথ বেছে নিলেও যে কখনো খ্যাতিমান হয় না। সিরীয় হচ্ছে সিরিয়ার বাইরে কিংবা সক্ষম হওয়া মাত্র দেশত্যাগে প্রস্তুত সীমান্তের ভেতরে বসবাসকারী নাগরিক। স্বৈরশাসক আর তাদের শাসনের সবকিছুতে অনীহাই সিরিয়ার ভেতরে ও বাইরে বসবাসকারী সিরীয়দের ঐক্যবদ্ধ করছে’।

আরব দুনিয়ার অনন্য কথাকার জাকারিয়া তামের বিশ্বসাহিত্যের সমঝদারদের কাছে অত্যন্ত গ্রহণযোগ্য। নিজের হৃদয় তো অবশ্যই, এক একটি গল্প সিরিয়ার হৃদয় খুঁড়ে বের করেছেন তিনি। বিধ্বস্ত ও রক্তবিধৌত সিরিয়ায় নির্বিরাম হননযজ্ঞ আর মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যে অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় ধরে চলছে তাঁর এই খোঁড়াখুঁড়ি। তুলে আনছেন নৃ ও প্রত্ন উপাদান, ইতিহাস, ঐতিহ্য। নিজের সৃজন ও মননের কামারশালায় গড়েপিটে করে তুলছেন এক একটি সুললিত শিল্পকলা। বলতে গেলে, সারা জীবন শুধু গল্পই লিখেছেন তিনি। বিষয়বৈগুণ্যে উপমা, রূপক ও প্রতীকের মতো বহুল প্রচলিত কথাসাহিত্যিক উপকরণগুলোও জাকারিয়া তামেরের গল্পে পেয়েছে অনন্য মাত্রা। আরবি সাহিত্যের মতো বিশ্বসাহিত্যেও জাকারিয়া তামের অন্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাথাশিল্পী। তাঁর ছোটগল্প বহু ভাষায় অনূদিত হয়েছে। জাকারিয়া তামেরের অনেক গল্পের কেন্দ্র নগর। নগরসভ্যতা ও আরবের মানুষের নৈতিক মূল্যবোধের দ্বন্দ্ব তার গল্পের প্রেক্ষাপট হয়ে ওঠেছে।

জাকারিয়া তামের স্বশিক্ষিত। আশির বেশি বয়স এখন। বসবাস বরছেন লন্ডনের অক্সফোর্ডের অক্সফোর্র্ডশায়ার এলাকায়। তিরিশ বছরের বেশি সময় ধরে যুক্তরাজ্যে স্বেচ্ছানির্বাসিত তিনি। তার জন্ম সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কের পাশে বাহাসা এলাকায় ১৯৩১ সালের ২ জানুয়ারি। ১৯৫৬ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম গল্প। প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘সাদা ঘোড়ার হ্রেষা’ (দ্য নেইং অব দ্য হোয়াইট হর্স/সাহিল আল জাওয়াদ আল আবিয়াদ) প্রকাশিত হয় ১৯৬০ সালে। গল্পকার জাকারিয়া তামের সম্পর্কে আমরা এসব তথ্য পাই ‘ জাকারিয়া তামেরের গল্প’ গ্রন্থে। বাংলা ভাষায় সাংবাদিক, লেখক ষড়ৈশ্বর্য মুহম্মদ এটি অনুবাদ করেছেন।

বাংলায় ভাষান্তরের কাজে অনুবাদক যথেস্ট মুনশিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর এই প্রাঞ্জল অনুবাদের কারণে গল্পগুলো পাঠকের কাছে সহযবোধ্য হয়ে উঠেছে।

বইটির শুরুতেই বাংলা ভাষার পাঠকদের প্রতি শুভেচ্ছা জানিয়ে গল্পকার জাকারিয়া তামের লিখেন- নিজের লেখা গল্পের সমালোচনায়ও আমি দ্বিধাহীন। তবে আমার কাছে, গল্পগুলো সব গানপাগল পাখি। যারা খাঁচা এবং খাঁচার নিদয়া মালিকের হাত থেকে পালাতে ব্যস্ত। হত্যা আর নিপীড়নে পটু শিকারি থেকেও তারা রেহাই চায়। এই পাখিরা নিরাপদ আশ্রয়ের খুঁজে উড়ে উড়ে আজ এক নতুন উর্বর ভূমিতে নেমেছে। যে ভূমির বাসিন্দারা স্বাধীনতাকে পবিত্র বলে মানে। গানপাগল পাখিদের আশা, এবার বেশ নতুন সখা জুটবে। সেই সখারা স্বাধীনতা হরণ করবে না। তারা মেতে উঠবে পাখিদের গানে। পাখিরা জানে, আকাশের মুক্ত পাখির খাঁচার কারিগর একদিন মানুষের জন্যও খাঁচা বানাতে পারে।

গ্রন্থে অর্ন্তভূক্ত প্রথম গল্পটির নাম ‘দশম দিনে বাঘ’ বিখ্যাত এই গল্পটি পৃথিবীর কয়েকটি দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠ্যসূচির অর্ন্তভূক্ত হয়েছে। গল্পে দেখতে পাই খাঁচায় বন্দি বাঘ কিভাবে একজন বশীকরণবিদের অনুগত হয়ে দশ দিনে কাগুজে বাঘে পরিণত হয়।
“পঞ্চম দিনে শিক্ষার্থীদের নিয়ে বাঘের খাঁচা ঘিরে দাঁড়ান বশীকরণবিদ।
বাঘকে বলেন, ‘ছোট্ট পুষি-বিড়ালের মতো মিউ মিউ করো তো সোনা! একদম, ইয়া বড় এক টুকরা তাজা মাংস দেব।’
বাঘটি ছোট্ট বিড়ালছানার মতো মিউ মিউ করে। বাঘের মিউ মিউ শুনে আহ্লাদে হাততালি দেন বশীকরণবিদ। খুশিতে ডগমগ হয়ে বলেন, ‘দারুণ! চমৎকার! তুমি তো এক্কেবারে উঠতি বয়সের একটি গরম হুলোর মতো মিউ মিউ করলে।’ বাঘের দিকে বড় এক টুকরা মাংস ছুড়ে দেন তিনি।
নবম দিনে এক ব্যাগ খড় নিয়ে খাঁচার কাছে আসেন বশীকরণবিদ। বাঘের দিকে খড়কুটো ছুড়ে দিয়ে বলেন, নাও, খাও!’
কান্ড দেখে বাঘ একেবারে বেকুব হয়ে যায়। বশীকরণবিদের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘এই এইগুলো কী? আমি তো, আমি তো মাংস খাই, মাংসাশী।’
বশীকরণবিদ বলে, ‘এখন থেকে তুমি খড় ছাড়া আর কিছু পাবে না।’
এক সময় প্রচন্ড ক্ষুধায় বাঘটি সেই খড় চিবানোর চেষ্টা করে।
দশম দিনে বশীকরণবিদ, শিক্ষার্থীদের দল, বাঘ আর লোহার খাঁচা- সবকিছু অদৃশ্য। বাঘটি হয়ে যায় সুসভ্য এক নাগরিক আর খাঁচাটি হয়ে ওঠে এক সুরম্য নগরী। (‘দশম দিনে বাঘ’)”

বইটিতে রয়েছে বেশ কিছু ছোট গল্প। দশম দিনে বাঘ, অনাবৃত চাঁদ, নিদ্রিতা, ড্যাগারের মৃত্যু, অঙ্কুর, ছোট সূর্য, গ্রীষ্ম, শেষ রাতের তুষার, সব শেয়ালের জন্য একটি সমাপ্তি, ‘টক আঙ্গুর’ গ্রন্থের তিনটি গ্রল্প, আরও তিনটি গল্প, আমার অদৃশ্য বন্ধু, শ্রত্রুরা, ‘হাঁটুভাঙা’ গ্রন্থের শিরোনামহীন কয়েকটি গল্প, ফেসবুক পেজে ছাপা ৫টি রচনা এছাড়াও গ্রন্থটির শেষদিকে যুক্ত করা হয়েছে গ্রন্থটির লেখক জাকারিয়া তামেরের সঙ্গে লেবানিজ লেখক ও রাজনীতি গবেষক জিয়াদ মাজেদের সংলাপ, আরো রয়েছে সিরিয়ার সমাজ-রাজনীতি ও সাহিত্য নিয়ে একটি প্রবন্ধ ও বিপন্ন সিরিয়ার কথাকার জাকারিয়া তামেরের জীবন ও কর্ম সম্পর্কিত একটি লেখা। পাঠকের সুবিধার্তে বইয়ের প্রতিটি গল্পের শেষে লেখা সম্পর্কিত একটি নোট দেয়া হয়েছে।

গল্পগ্রন্থটি অনুবাদক ষড়ৈশ্বর্য মুহম্মদ উৎসর্গ করেছেন তাঁর দুই সাংবাদিক বন্ধু জাহিদ নেওয়াজ খান ও মীর মাসরুর জামানকে।

আরব সাহিত্যের একজন সফল লেখকের গল্প বাংলা ভাষায় আমাদের সামনে উপস্থাপনের জন্য ষড়ৈশ্বর্য মুহম্মদকে আন্তরিক অভিনন্দন ও ধন্যবাদ জানাই।

জাকারিয়া তামেরের গল্প ।। ভাষান্তর : ষড়ৈশ্বর্য মুহম্মদ।। প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি-২০১৫খ্রি.।। প্রকাশক: মেঘ।। প্রচ্ছদ স্কেচ: জয়ন্ত সরকার জন ।। মূল্য: ১৮০ টাকা।।

 

foysal-ahmed

ফয়সাল আহমেদ: সাংবাদিক, লেখক।

About the author

নরসুন্দা ডটকম

Leave a Comment