গল্প সাহিত্য

কমলা সুন্দরী।। নুসরাত সুলতানা

নরসুন্দা ডটকম   নভেম্বর ১৩, ২০২৫

সাতক্ষীরা থেকে ছোট চাচুর ফোন কল আসা থেকে আধা ঘন্টা  ধরে থম মেরে বসে আছে আইয়াদ। নি: শব্দে চোখের জল ঝরছে। নীলা-রাশেদ দম্পতির একমাত্র ছেলে আইয়াদ। নীলা-রাশেদ দুজনেই খুব বোঝাতে চেষ্টা করছে ছেলেকে কিন্তু এগারো বছরের শিশুর কাদার মতো নরম, তুলতুলে মন কিছুতেই এই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারছে না। 

নীলা আর রাশেদ দুজনেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী। তারপর বন্ধুত্ব থেকে বিয়ে। নীলার প্রথম সন্তান আট মাসে পেটে মারা যায়। এই ছেলে তাই নীলার কাছে ভীষণ আরাধ্য। রাশেদও পুত্রের ভেতরেই খোঁজে পরম প্রশ্রয়। দুজনে তাই সলাপরামর্শ করতে বসেছে কী করা যায় ব্যাপারটা নিয়ে। কতই বা দাম হবে কমলার!

নীলা একবার রাশেদকে বলে- আমি যদি টাকাটা দিয়ে দিই তাহলে?  তাহলে শহিদুল  এই সিদ্ধান্ত বাতিল করবে না? রাশেদ বলে শুধু শুধু এতগুলো টাকা নষ্ট করবে?

নীলা বলে- শুধু শুধু কীভাবে হল? আমার ছেলের কোমল-শিশু মনের দাবীর চাইতে দামী কী আছে এই পৃথিবীতে ? তুমি ওর সাথে কথা বল। নীলা-রাশেদ এইসব আলোচনা করছে। এরভেতর আইয়াদ দৌড়ে এসে বলে- মা আ আমার সালামির সব টাকা তোমার কাছে না? এই নাও গতকাল টিফিনের পঞ্চাশ টাকা আমি তোমাকে দিলাম। চাচুকে বল- কমলাকে ডাক্তার দেখাতে। আমি আবার দিদা বাড়ি গিয়ে কমলাকে কলাপাতা খাওয়াতে চাই। নীলা ছেলেকে বুকে নিয়ে বলে- দেখাবে বাবা! চাচু অবশ্যই কমলাকে ডাক্তার দেখাবে। তুমি কমলাকে কাঁঠাল পাতা, কলাপাতা সব খাওয়াবে। কিন্তু গাছ থেকে বেশি পাতা ছিড়ো না বাবা। গাছেদের কষ্ট হয়। পাতাগুলো গাছেদের হাতের আঙুলের মতো। ওরা ব্যথা পায়। আইয়াদ বলে- মা তাহলে আমি কমলা আর রঙ্গিলাকে কী খাওয়াব?

নীলা ছেলের কপালে চুমু দিয়ে বলে- ঘাস, নাড়া, খৈল এসব খাওয়াতে হয় বাবা। কমলা তো আমাদের দুধ দেয়। তাই কমলাকে খুব আদর করতে হবে। 

০২.

নীলার মানসপটে ভেসে ওঠে প্রথমবার  ছেলেকে নিয়ে শ্বশুর বাড়ি গিয়েছিল দেড় বছর বয়সে। সেবার  শ্বশুর বাড়ি গিয়ে গরু কেটে আকীকা দিয়েছিল।  দ্বিতীয়বার আইয়াদ যায় আট বছর বয়সে। সেবার হাঁস -মুরগী, গরু-ছাগল সবকিছু দেখে ছেলেটা একেবারে পাগল হয়ে গিয়েছিল। মুরগীর দেখে বলেছিল- দিদা আমি ওকে ঢাকায় নিয়ে যাব। হাঁসের বাচ্চা ঢাকা নিয়ে যাবে, ছাগল ঢাকা নিয়ে যাবে। যে প্রাণী দেখেছে তাই ঢাকা নিয়ে যাবে। নীলার দেবর শহিদুল আলমের তিনটা গরু। বড় গরুটা  কমলা লাল। তাই ওর নাম দেয় আইয়াদ কমলা সুন্দরী। আর দুইটা বাছুর একটা এঁড়ে বাছুর আরেকটা বকনা বাছুর। অই দুটির নাম দেয় রঙ্গিলা আর রাজ।  রঙ্গিলা সাদা-লাল মিলে, রাজ মিচমিচে কালো। খাওয়া আর ঘুম বাদে সারাদিন কেটেছে কমলা, রঙ্গিলা আর রাজকে কলাপাতা আর কাঁঠাল পাতা খাইয়ে। সারা বাড়ি খুঁজে খুঁজে হাতের নাগালে যত কাঁঠাল পাতা পেয়েছে সবই ছিড়েছে। 

সেবার যাওয়ার তৃতীয় দিন নীলা- রাশেদ গিয়েছিল একমাত্র ননদের বাড়ি সাতক্ষীরা বেজপাল্টি। অইখানে গিয়ে দেখেছে- একটা ছাগল আর তিনটা বাচ্চা। একটা বাচ্চা কালো, একটা বাদামী আরেকটা সাদা-কালো। নীলাও সারাদিন বাচ্চাগুলোকে কোলে আগলে রেখেছে। আর আইয়াদও বেজায় খুশি। মায়ের মতোই ফর্সা, বড় চোখের আইয়াদ শুধু বলে- মা ওরা কী সুন্দর! ওদেরকে ঢাকায় নিয়ে যাব আমি!

মুশকিল হল পরেরদিন ননদের মেয়ে বিউটিদের বাড়ি 

যাওয়া নিয়ে। ছাগল এবং অই তিন বাচ্চা রেখে কিছুতেই আইয়াদ অন্যকোথাও যাবে না। দমকে দমকে কান্না করছে। কিছুক্ষণ চুপ করে নীলা ছেলেকে বোঝালো – এই বাচ্চাগুলো খুব ছোট।  ওরা মা ছাড়া থাকতে পারবে না। ওরা একটু বড় হোক। আমরা একজনকে নিয়ে যাব। তুমি তো জানো মা-মনি সরকারি কর্মকর্তা। অফিসার্স কোয়ার্টারে তো পোষ্য প্রাণী  রাখা যায় না। তাই চারজন নিয়ে রাখা যাবে না। আর তাছাড়া দিদা বাড়িতে কমলা- রঙ্গিলা- রাজ তোমাকে খুঁজছে।

এইকথায় যদিও ফুপাতো বোনের বাড়ি গিয়েছিল আইয়াদ কিন্তু মন খারাপ ছিল অনেকক্ষণ। ছেলের বিষাদ নীলা একেবারেই নিতে পারে না। বিউটিকে ডেকে নীলা বলে- বিউটি তোদের ছাগলগুলো আইয়াদকে দেখা। ওরাও তো আইয়াদের বন্ধু হবে। বিউটি বলে – এস ভাইয়া। আমাদেরও ছাগল আছে, মুরগী আছে, গরু আছে। চল আমরা দেখি। সেবার চলে আসার সময় কমলা, রঙ্গিলা আর রাজের সাথে অনেকগুলো ছবি তুলেছিল আইয়াদ। ছবিগুলো ফেসবুক থেকে বের করে দেখে নীলা। এরপর পৃথিবী পড়েছিল মহামারী করোনার করাল গ্রাসে। সবকিছু উল্টেপাল্টে গিয়েছিল। রাশেদের চাকরিতে সমস্যা। ছেলের স্কুল অফ। অর্থনৈতিক সঙ্কট কত- কী! স্মৃতি ভেলায় ভেসে ভেসেই নীলা আবার আসে বর্তমানে। স্বামী রাশেদকে বলে আমার একটাই ডি. পি. এস ছিল

সেটা ভেঙে চল্লিশ হাজার টাকা দিচ্ছি। তুমি শহিদুলকে পাঠিয়ে দাও। আর বলে দাও কমলা সুন্দরীকে কষাইয়ের কাছে বিক্রি না করতে। আমার ছেলের মানবিক মূল্যবোধ আমার কাছে অমূল্য। রাশেদ ও ব্যাপারটা বুঝতে পারে। তারপর বলে চল – সাতক্ষীরা যাই সবাই। কমলার সাথে দেখা হোক আইয়াদের। নীলা একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেপুটি রেজিস্ট্রার। রাশেদ ব্যাংকার। দুজনেই তিনদিন ছুটি নিয়ে চলে যায় গ্রামের বাড়ি সাতক্ষীরা জেলার কালিগঞ্জ থানার শুইলপুর গ্রামে। অপরূপ সুন্দর এই গ্রাম। গ্রামটাকে রূপের জন্য পরীদেরও বুঝি ঈর্ষা হয়।

সকাল পাঁচটায় গিয়ে পৌঁছায় রাশেদ, নীলা আর আইয়াদ। আইয়াদ তখনই কমলাকে দেখবে। শহিদুলকে বলে চাচু আমি কমলাকে দেখব। শহিদুল টর্চ লাইট হাতে নিয়ে ভাইয়ের ছেলেকে দেখিয়ে নিয়ে আসে কমলাকে। রাশেদের মা এসে আইয়াদকে বলে – ভাইয়া তুমি জার্ণি করে আসছ। ভাত খেয়ে  একটু ঘুমিয়ে নাও। ঘুম থেকে উঠে কমলা, রঙ্গিলাকে কাঁঠাল পাতা, কলাপাতা খাওয়াবে। আইয়াদ বলে- ঠিক আছে দিদা ভাত দাও।

ভাত খেয়ে  ঘুমাতেয়ে নেয় আইয়াদ।  কিন্তু ছটফট করে উঠে যায়। উঠে ই কাঁঠাল পাতা ছিড়ে চলে যায় কমলার কাছে। বয়স হয়েছে কমলার। খাওয়া দাওয়া কমিয়ে দিয়েছে। চোখ থেকে ঝরছে ফোঁটা ফোঁটা জল। আইয়াদ কাঁঠাল পাতা মুখে দেয় আর বলে- কেঁদো না কমলা। আমার সালামীর সব টাকা চাচুকে দিয়ে দিয়েছি। তোমাকে চাচু আর বিক্রি করে দেবে না। তুমি যতদিন বাঁচবে চাচু তোমার যত্ন করবে। আর তুমি যখন মরে যাবে, তোমাকে কবরে রাখলে তুমি আকাশের তারা হয়ে যাবে। নানুও তো তারা হয়ে গিয়েছে। আমি তো নানুর সাথে প্রতি সন্ধ্যায় দেখা করি। নানুও আমাকে দেখে। তেমনি তোমাকেও আমি দেখব, তুমিও দেখবে। এখন পেট ভরে কাঁঠাল পাতা খাও। তুমি খুবই ভালো গরু। এরপর গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করতে থাকে কমলাকে। 

লেখক: নুসরাত সুলতানা 

কবি ও কথাসাহিত্যিক

About the author

নরসুন্দা ডটকম

Leave a Comment