ভালা আইয়ে বুড়া যা/ মশা-মাছির মুখ পুড়া যা/
কাতি মায়া পেরেত যা/ অলক্ষ্মী আইয়া ঘর ল/
ধনে-জনে ঘর ভইরা যা/ টেকা-পয়সায় ঘর ভইরা যা/
ভালা আইয়ে বুড়া যা/ মশা-মাছির মুখ পুড়া যা/
এভাবেই গীত গাইতে গাইতে প্রতিবছর কার্তিক মাসের শেষ সন্ধ্যায় মশা-মাছি তাড়ানোর কাজটি করা হয়। গ্রামের ছোট ছোট ছেলেমেয়ে প্রথমে পাটশোলার একটি আঁটি বাঁধে, এর পর আঁটির মাথায় আগুন ধরিয়ে সেটি নিয়ে নিজ বাড়ির চারদিকে ঘুরে তার পর এ-বাড়ি ও-বাড়ি দৌড়ে যেতে থাকে। তাদের মধ্যে এই বিশ্বাস বদ্ধমূল যে, এই লোকাচার পালনের দ্বারা মৌসুমে মশা-মাছির উপদ্রপ কমে যাবে এবং রোগ-বালাই ও কমে আসবে। আবার দেখা যায়, চোখের কোনায় কিংবা চোখের পাতায় মাঝেমধ্যে একধরনের গোটা সৃষ্টি হলে (যাকে আঞ্চলিক ভাষায় আইছতেলেঙ্গা বলা হয়), সেটি সারাতে আইছতেলেঙ্গার ওপর দুগ্ধপোষ্য বালকের শিশ্নের স্পর্শ করানো হয়। সাধারণ মানুষের মধ্যে এই বিশ্বাস প্রচলিত যে এটি করলেই এ রোগ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে।
আমাদের সমাজজীবনে নানা ধরনের সংস্কার ও লোকাচার সুদীর্ঘকাল ধরে গভীর বিশ্বাসের সঙ্গে পালিত হয়ে আসছে। দেশে এমন একজন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর, যিনি কোনোরূপ প্রচলিত লোকবিশ্বাস না মেনেই জীবন পার করেছেন। বাঙালি মুসলমানদের চেয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষই সংস্কার ও লোকাচার লালন-পালনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছেন। বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম অনুষঙ্গ এসব প্রচলিত লোকাচার নিয়ে গবেষক, ছড়াকার, লেখক জাহাঙ্গীর আলম জাহান লিখেছেন ‘সংস্কার লোকাচার লোকবিশ্বাস’ বইটি। যিনি সুদীর্ঘ সময় ধরে লোকভাষা ও লোকজ সংস্কৃতি নিয়ে নিরলসভাবে কাজ করে চলেছেন।
কোনো ধরনের আনুষ্ঠানিক ভূমিকা ছাড়াই লেখক শুরু করেছেন এভাবে, আমাদের সভ্যতা বিনির্মাণেও সংস্কৃতির অবদান অনস্বীকার্য। সব উন্নত উপকরণই হচ্ছে আমাদের সভ্যতা। সে বিবেচনায় সভ্যতা বিনির্মাণে আমাদের হাজার বছরের সংস্কৃতিও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে, তা বলা বাহুল্য। লোকজ সংস্কৃতির হাত ধরেই নির্মিত হয়েছে আধুনিক ও পরিশীলিত সংস্কৃতি। অবশ্য লোকজ সংস্কৃতিতে কুসংস্কারনির্ভরতা লক্ষ করার মতো। জাদুবিশ্বাস, লোকবিশ্বাস, অদৃশ্যবাদিতা ও অদৃষ্টবাদিতাও আমাদের লোকসংস্কৃতির একটি বড় উপাদান। সংস্কার, লোকাচার ও লোকবিশ্বাস ধর্ম-গোত্র নির্বিশেষে সব মানুষের মধ্যে বেশ জোরালোভাবেই অবস্থান করছে। সারা দেশে প্রচলিত সংস্কার, লোকাচার ও লোকবিশ্বাসের উল্লেখযোগ্য বিবরণই এ গ্রন্থের মূল প্রতিপাদ্য। বিধৃত সংস্কার, লোকাচার ও লোকবিশ্বাসের অনেকগুলোর অস্তিত্ব এখন হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিন্তু একসময় আবহমান গ্রামীণ সমাজব্যবস্থায় এগুলো বেশ দাপট নিয়েই টিকে ছিল। হারিয়ে যাওয়া সেই বিষয়গুলো গ্রন্থভুক্ত করে রাখতেই এ গ্রন্থের জন্ম।
বৃষ্টির জন্য ব্যাঙের বিয়ে, পিছু ডাকলে অমঙ্গল, পানিশূন্য কলস দেখে যাত্রা শুভ নয়, চোখলাগা থেকে রক্ষার জন্য শিশুর কপালে কাজলের টিপ, কু-নজরী লোকদের বদনজর থেকে ফসল রক্ষা, অলক্ষুণে শনি ও মঙ্গলবার, নাকফুল হারালে বৈধব্য আসন্ন, বিয়েবাড়িতে বিধবারা অপয়া গণ্য, শাঁখা ভেঙে গেলে অমঙ্গলের আশঙ্কা, আগে ছোট বোনের বিয়ে হলে বড় বোন অপয়া, সন্ধ্যায় ঘরের বাইয়ে এঁটোঝুটো ফেলা ক্ষতিকর, ঘরের চৌকাঠে বসা অমার্জনীয়, নাকঠশা না থাকলে স্বামীর অমঙ্গল, স্বামীর নাম মুখে নেওয়া অশুভ,ঘরের চালে বাঁধন এঁটে সংসারের স্থায়িত্ব রক্ষা, আজান ও উলুধ্বনি দিয়ে নবজাতকের আগমন ঘোষণা, একত্রে কুলা, দা ও ঝাড়ু রাখলে বিবাদ বাড়ে, কখনো গলায় মাছের কাঁটা বিঁধলে এর যন্ত্রণা থেকে পরিত্রাণের আশায় বিড়ালের পা ধরা, রাতে কুকুর-বিড়ালের কান্না অশুভ, উইপোকার পাখা গজালে খরার সম্ভাবনা, শরীরে প্রজাপতি বসলে নতুন জামা পাওয়া যায়, আটকুঁড়ে ও কলুদের মুখ দর্শন অশুভ, কুটুমপাখির ডাকে মেহমান আসার সম্ভাবনা, জটকলা খেলে যমজ সন্তান হওয়ার সম্ভাবনা, শিশুর মুখে সুন্দর, মজবুত ও ধারালো দাঁতের আশায় শিশুর মুখ থেকে পড়ে যাওয়া দাঁত ইঁদুরের গর্তে নিক্ষেপ, মাথায় মাথায় ঢুঁশ লাগলে মাথা ভেদ করে সিং গজাবে এই ভয়ে মাথায় মাথায় আবার ঢুঁশ দেওয়া, চাকরির ইন্টারভিউ, পরীক্ষা কিংবা কোনো শুভকাজে যাওয়ার আগে ডিম-কলা না খাওয়া, ভাঙা আয়নায় মুখ দেখা অমঙ্গল, ভাঙাপাত্রে খাবার খাওয়া ক্ষতিকর, শিশুর পেটের ব্যথা সরাতে পান পাতায় শর্ষের তেল মিশিয়ে আগুনে পোড়া (যাকে বলা হয় ডিট পোড়া), গরুর খুরা রোগ প্রতিরোধে সুদখোরের নাম ব্যবহার, জন্ডিস নিরাময়ে কলাপড়াসহ অসংখ্য বিষয় বইটিতে বর্ণনাসহকারে স্থান পেয়েছে।
এসব লোকবিশ্বাসের পক্ষে বিজ্ঞানের দ্বারা প্রমাণিত সে রকম কোনো যুক্তি না থাকায় প্রগতিশীল মানুষ একে নিছক কুসংস্কার হিসেবেই গণ্য করেন। তবে কোনো কোনো বিজ্ঞজনকে আবার বলতে শোনা যায় যে এসব বিষয়কে তুড়িতে উড়িয়ে দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কারণ এসব কুসংস্কার পালনের কারণে মানুষ কিন্তু কখনো কখনো উপকৃত হয়েছে। আর সে কারণেই অগ্রসর শহুরে সমাজের চাইতে গ্রামীণ সমাজে এখনো সংস্কার লোকাচার লোকবিশ্বাস বেশ আস্থার সঙ্গেই পালিত হয়ে আসছে।
গবেষণাধর্মী চমৎকার এই বইটির জন্য লেখক জাহাঙ্গীর আলম জাহানকে অভিনন্দন। লেখক বইটি উৎসর্গ করেছেন তাঁর প্রিয় বন্ধু মোহাম্মদ আবদুল কুদ্দুস খানকে। ‘সংস্কার লোকাচার লোকবিশ্বাস’ বইটি ফেব্রুয়ারি-২০১২ সালে প্রকাশ করেছে মুক্তচিন্তা। এর প্রচ্ছদ করেছেন এম এ কাইয়ুম। বইটির মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ১২০ টাকা। লোকজ বিষয় নিয়ে যাঁরা গবেষণা করেন, তাঁদের বইটি পাঠের আমন্ত্রণ রইল।
নোট: লেখাটি এনটিভি অনলাইনে প্রকাশিত।
ফয়সাল অাহমেদ, লেখক, সাংবাদিক।