স্বাধীন বাংলাদেশের । একথা আজ সর্বজন বিদিত। এই একটি বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করবেন, এমন মানুষ খোঁজে পাওয়া দুস্কর। তাঁর দল আওয়ামী লীগের বাইরেও অপরাপর রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী থেকে সাধারণ মানুষ সবাই তাঁকে শ্রদ্ধা করতেন।
মাত্র সাড়ে তিন দশকের সক্রিয় রাজনৈতিক জীবনে এমপি ছিলেন পুরোটা সময়ই। ১৯৯৬ সালে রাজনীতিতে যোগ দিয়ে কিশোরগঞ্জ সদর আসন থেকে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়ে সেই যে শুরু করেছিলেন তারপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। কিশোরগঞ্জের মানুষ ভালোবেসে বারবার তাঁকে বিজয়ী করেছেন। তিনি যেমনটা তাঁর নিজ এলাকার মানুষের মন জয় করেছিলেন, তেমনটা জয় করেছিলেন দেশবাসীর মনও। নিরহংকারী অতি সাধারণ জীবনে অভ্যস্ত এই মানুষটি নিজকর্মগুণে হয়ে ওঠেন বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণের প্রাণের নেতা।
গতকাল ছিলেন, আজ তিনি নেই! গত রাতে [বৃহস্পতিবার, ৩ জানুয়ারি- ২০১৯] ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে সৈয়দ আশরাফ থাইল্যান্ডের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। সেখানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।
তাঁর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, এমপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ। কিন্তু এর চেয়ে ব্যতিক্রম বিষয় হলো, গণমাধ্যমে সৈয়দ আশরাফের মৃত্যুর সংবাদ প্রচার হওয়ার পর থেকে বিষেশত সোশ্যাল মিডিয়ায় হাজার হাজার মানুষ শোক প্রকাশ করছেন। এরা শুধুমাত্র কিশোরগঞ্জের জনগণ নন, সারা বাংলাদেশের মানুষ। নীরবে তাঁরা চোখের জল ফেলছেন প্রিয় নেতার জন্য, সর্বোপরি একজন মহৎ মানুষের জন্য।
কিন্তু এই মানুষেরা কেন কাঁদছেন? কেন শোক প্রকাশ করছেন তাঁর জন্য? উত্তরটি সবারই জানা, রাজনীতিক সৈয়দ আশরাফ মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, তারুণ্যের শুরুতেই ১৯৭১ সালে প্রিয় মাতৃভূমিকে পাকিস্তানি হানাদারদের কবল থেকে স্বাধীন করার জন্য লড়াই করেছেন। শুধু তিনি নন তাঁর পিতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের অবর্তমানে মুক্তিযুদ্ধকালীন মুজিবনগর সরকারের নেতৃত্বদিয়ে বাংলাদেশকে স্বাধীন করার ক্ষেত্রে অবিস্মরণীয় ভূমিকা রেখে গেছেন। কোনরূপ ব্যক্তিস্বার্থ নয়, দেশের স্বার্থইকে প্রধান্য দিয়ে প্রাণপণে লড়াই করেছিলেন তিনি। নির্লোভী, দেশপ্রেমিক পিতার যোগ্য উত্তরাধীকারী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ও পিতার মতো মন্ত্রী হয়েছিলেন, কিন্তু নিজের জন্য কিছুই করেননি। অনেকেই যেখানে এমপি হয়ে, মন্ত্রী হয়ে নিজের আখের গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন, দুর্নীতির অভিযোগে সংবাদের শিরোনাম হয়ে ওঠেন, সেখানেই ব্যতিক্রম ছিলেন, কিশোরগঞ্জের যশোদলের বীর দাম পাড়ার বীর সন্তান সৈয়দ আশরাফ।
২০১৭ সালে যখন তাঁর স্ত্রী গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেন, সামনে আসলো উন্নত চিকিৎসার বিষয়টি, তখন দেশবাসী জানলেন আসলে তাঁর সে পরিমাণ টাকা নেই, সম্পদ নেই। যারা নতুন জানলেন তাঁরা ভীষণ অবাক হলেন, এও সম্ভব! সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হয়েও তিনি টাকার অভাবে প্রিয়তমা স্ত্রীর যথাযথ চিকিৎসা করাতে পারছেন না। এর আগেও তিনি দুইবার মন্ত্রী ছিলেন, চার বারের এমপি। পত্র পত্রিকায় রিপোর্ট হয় কেউ হাসে কেউ কাঁদে। আহা মানুষ.. সৈয়দ আশরাফ রাজনীতিতে বিরল মানুষ।
তিনি তখন দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নিজ দলের ২০তম সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখছেন- ‘আওয়ামী লীগের আমি সন্তান। আওয়ামী লীগের ঘরেই আমার জন্ম। আওয়ামী লীগ যখন ব্যথা পায়, আমারও কিন্তু হৃদয়ে ব্যথা লাগে। আওয়ামী লীগের একটা কর্মী যদি ব্যথা পায় সেই ব্যথা আমিও পাই।’ বক্তব্য শুনে অনেকের চোখের পাতা সেদিন ভিজে গিয়েছিল। আজ নতুনকরে ভেবে দেখার সময় এসেছে এমন করে কজন ভালোবেসেছিল, আওয়ামী লীগকে। এখান থেকেই নিরুপণ করা যায়, সৈয়দ আশরাফ কতটা কমিটেড ছিলেন দলের প্রতি, কর্মীদের প্রতি। আর তা হবেই বা না কেন, তাঁর পিতাও যে এমনভাবে আওয়ামী লীগকে, বঙ্গবন্ধুকে ভালোবেসেছিলেন। তিনি ৩ নভেম্বর ১৯৭৫ জীবন দিয়ে তার প্রমাণও রেখে গিয়েছেন, পৃথিবীর বুকে।
সদ্য অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কিশোরগঞ্জ-১ [কিশোরগঞ্জ সদর- হোসেনপুর উপজেলা] আসন থেকে এমপি প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে রের্কড সংখ্যক ভোট পেয়ে তিনি নির্বাচিত হয়েছেন। তাঁর অনুপস্থিতিতেই লোকে তাঁকে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করেছেন। সেই নির্বাচনের হলফনামাসূত্রে জানা যায়, পূর্বের তুলনায় তাঁর সম্পদ আরো কমেছে। সবশেষ, মৃত্যুার আগ পর্যন্ত থাইল্যান্ডের যে হাসপাতালে তিনি চিকিৎসা নিয়েছেন, সেখানকার ব্যয়ভার বহন করেছেন, মাননীয় প্রধানন্ত্রী, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। অন্যথায় তাঁর চিকিৎসার কি হতো আমরা জানি না।
৬৮ বছর বয়সী, ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত এই মানুষটি যেদিন আমাদের ছেড়ে চিরতরে পাড়ি দিলেন অচিন দেশে, সেদিনই তাঁর কিশোরগঞ্জ-১ আসন [কিশোরগঞ্জ সদর- হোসেনপুর উপজেলা] থেকে নির্বচিত সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নেবার কথা ছিল। আমরা জেনেছি, বৃহস্পতিবার (৩ জানুয়ারি) নবনির্বাচিত সংসদ সদস্যরা শপথ নিলেও তিনি চিকিৎসাধীন থাকায় শপথ নেওয়ার জন্য চিঠির মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির কাছে সময় চেয়েছিলেন।
খুব বেশি দিন আগে নয় ২০১৭ সালের ২৩ অক্টোবর তার স্ত্রী শিলা ইসলাম মারা যান। এরপর থেকে ধীরে ধীরে তিনি নিজেও অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনিও যখন না ফেরার দেশে পাড়ি দিয়েছেন তখন পৃথিবীতে রেখে গেছেন তাঁর একমাত্র কন্যা রীমাসহ তিন ভাই দুই বোনকে। মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ সবাইকে এই শোক বইবার শক্তি দিন এই প্রার্থনাই রইলো।
বড় অসময়ে সৈয়দ আশরাফের এই চলে যাওয়া বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক অপূরণীয় ক্ষতি এটি যেমন সত্য, তেমনি সত্য রাজনীতি ও সমাজ উন্নয়নে তার অবদান বাংলার সাধারণ মানুষ আমৃত্যু শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে।
বাংলার রাজনীতির উজ্জ্বল তারকা, ক্ষণজন্মা এই মানুষটিকে খুব কাছ থেকে দেখার এবং কথা বলার আগ্রহ যখন প্রবলভাবে তৈরি হলো, ঠিক তখনই তিনি অসুস্থ হয়ে বিদেশের হাসপাতালে ভর্তি হলেন। বড় আশা ছিল তিনি সুস্থ হয়ে দেশে ফিরবেন, আবার সক্রিয় হবেন রাজনীতিতে। আর আমি তাঁর হাতে তুলে দিব আমার লেখা “সৈয়দ নজরুল ইসলাম- মহাজীবনের প্রতিকৃতি” বইটি। আফসোস সে সুযোগ আর পেলাম না!!
ঢাকা, ৪ জানুয়ারি- ২০১৯
লেখক : সাংবাদিক।
সূত্র: জাগো নিউজ২৪ডট কম, প্রকাশিত: ১২:৪৮ পিএম, ০৫ জানুয়ারি ২০১৯।।