মানুষ- সমাজ

করোনা দুর্যোগকালে ধর্ষণ: ঘৃণিত বিকৃত মানসিকতা! : মাজহার মান্না

নরসুন্দা ডটকম   মে ২০, ২০২০
ধর্ষণ

করোনার ছোবলে আমাদের জীবন থমকে গেছে। এর অভিঘাত চেনা পরিবেশকে পাল্টে দিয়েছে। বর্তমানে পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন দুর্যোগময় সময় অতিক্রম করছে মানুষ। এর আগে এত বড় বা দীর্ঘস্থায়ী সঙ্কট হয়নি। তাই পরিস্থিতি সামাল দিতে রীতিমতো দিশেহারা সবাই।

প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস এখন শুধু আতঙ্কের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই ছড়িয়ে পড়েছে ব্যাপকহারে। এ পরিস্থিতিতে ‘মানুষ মানুষের জন্য’ এই মানবিক মূল্যবোধ অনেকের মধ্যেই জাগ্রত হয়েছে। মানবিক জায়গা থেকে সবাই অসহায়দের পাশে দাঁড়াচ্ছে। কিন্তু করোনা দুর্যোগের মধ্যেই দেশে নারী ও শিশু ধর্ষণের মাত্রা আমাদেরকে নতুন করে ভাবিয়ে তুলেছে। সর্বত্র এ নিয়ে একধরনের উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে

বিশ্বে ঘৃণিত বিকৃত মানসিকতা ধর্ষণ অপরাধ সাম্প্রতিক সময়ে বেড়ে যাওয়ায় নারী ও শিশুর নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি এখন দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। উচ্চবিত্ত পরিবার থেকে নিম্নবিত্ত কোনো অবস্থানে কোথাও নিরাপদে নেই নারী ও শিশু। হোক সে রেলের অভ্যন্তরে বা রেলস্টেশন, বাসের অভ্যন্তরে বা বাস স্টেশন, রাজপথে অথবা গলিপথে, গ্রামে অথবা শহরে, নির্মাণাধীন ভবনে, সুরম্য অট্টালিকা অথবা জরাজীর্ণ বস্তিতে, বিদ্যালয়ে অথবা নিজের বাড়িতে। দেশে নারী ও শিশু অধিকার সুরক্ষায় কঠোর আইন রয়েছে। এরপরও প্রতিনিয়তই দেশের কোথাও না কোথাও নারী ও শিশুরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।

করোনা পরিস্থিতিতে ধর্ষণের ঘটনা যে হারে হঠাৎ করে বেড়ে গেছে তেমনটি বলতে রাজি নন অনেকেই। বেশির ভাগ শিশু ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনের ঘটনা নানা কারণে আড়ালেই থেকে যায়। অনেক ক্ষেত্রে ধর্ষণের ঘটনার পর থেকে শিশুটি পুরুষ মানুষ দেখলেই আতঙ্কিত হয়ে পড়ছে। এ সময় সে তার নিজের পিতাকেও সহ্য করতে পারে না। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, ধর্ষণ তথা যৌন নির্যাতন হ্রাসের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারে রাষ্ট্র। যদি ধর্ষকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা যায়, তাহলে এমন অপরাধের ঘটনা অনেকাংশে বন্ধ করা সম্ভব হবে।

একশ্রেণীর মানুষ শিশুদের ভোগ্যপণ্য হিসেবে দেখছে। শিশুদের ওপর বল খাটানো বা প্রভাবিত করা, ভয় দেখানো সহজ হয়। ফলে সেই সুযোগটি নিচ্ছে অপরাধীরা। শিশুদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনে ধর্ষণের ঘটনা বাড়ছে। নানা শ্রেণীর এবং বয়সের ব্যক্তিরা এটি করছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে পর্ণোগ্রাফির প্রভাব রয়েছে। ফলে ভবিষ্যৎ জীবনে তারও এ ধরনের অপরাধ কর্মে জড়ানোর আশংকা থাকে। এইসব শিশুরা সমাজে স্বাভাবিক মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে পারেন না। সেও অন্যের প্রতি এমন আচরণ করে।

মূলত দরিদ্র শ্রেণীর শিশুরা বাবা শ্রমজীবী বাবা-মায়েদের এবং তাদের অনুপস্থিতিতে এইসব শিশুদের দেখার কেউ থাকে না। আরেকটি গ্রুপ যারা নিজেরাই কর্মজীবী তারা, এবং গৃহকর্মীরা ধর্ষণের ঝুঁকিতে থাকছে বেশি। এছাড়া সাম্প্রতিক করোনাকালে আমরা দেখতে পাই, ত্রাণ নিতে গিয়েও বিধবা নারী, কর্মস্থলের কথা বলে ডেকে নিয়ে কিশোরীকে গণধর্ষণ ও বিভিন্ন এলাকায় বিশেষ কিছু দেয়ার নানা লোভ প্রলোভন দেখিয়েও শিশুকে ধর্ষণ করতে।

আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনেক নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে কিন্তু বিচার তো হচ্ছে না। বাইরে মিটমাট হয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া ধর্ষণের মামলা চলাকালীন বিভিন্ন বিব্রতকর পরিস্থিতি এবং বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা আইনের আশ্রয় নিতে অনীহা তৈরি করছে। এছাড়া যৌন অপরাধীদের তালিকা না থাকা এবং তদারকির অভাবেও একই অপরাধের পুনরাবৃত্তি ঘটছে। ফলে ধর্ষণের মামলার ক্ষেত্রে এসব প্রতিবন্ধকতার বিষয়ে কি ভাবছে রাষ্ট্র?

আইনজীবীদের মতে, বয়স বিবেচনায় জামিনে মুক্ত হয়ে ধর্ষণ মামলায় কম সাজা ও আইনী দীর্ঘসূত্রিতায় বারবার ঘটছে অপরাধ। এ কারণে দেশে যারা ধর্ষণ করছেন তাদের সাজা খুবই কম। মাত্র ৩ ভাগের সাজা হচ্ছে। এর কারণ যারা ধর্ষণ করছে তাদের সাথে একটা মীমাংসা হয়ে যায় বা তাদের সাথে বিয়ে করিয়ে দেয়। তাই এই মামলাগুলো বেশিদূর চলতে পারেনা। যদিও নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে বলা আছে, ১৮০ দিনের মধ্যে মামলা প্রক্রিয়া শেষ করতে হবে। কিন্তু ধর্ষণ মামলায় সাক্ষ্য আইনের সাহায্য নিতে হয়। এছাড়া বিভিন্ন তথ্য-প্রমাণের সন্নিবেশ ঘটাতে গিয়ে বিচারের দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হয়।

তবে ব্যতিক্রমও আছে, এমন অনেক দেশ রয়েছে যেখানে ভিক্টিম একজন মাইনর, সেখানে মেডিকেলে ধর্ষণের আলামত মিললেই উই দ্যা আউট ট্রায়াল অপরাধীদের সরাসরি শাস্তি ফেইস করতে হয়।

মানবাধিকারকর্মীদের মতে, বিশ্বের অনেক দেশেই যৌন অপরাধে অভিযুক্তদের তালিকা করে তদারকি করে স্থানীয় প্রশাসন। এ ব্যবস্থায় যেমন অপরাধ ঠেকানো যায় পাশাপাশি অপরাধীদের কাউন্সিলিং করার সুযোগ থাকে। তাদের মতে, যে সমস্ত আসামীদের ধরা হয় নাই অথবা যারা জামিনে বের হয়ে গেছে। বিশেষ করে যেখানে ধর্ষণ মামলা এ সমস্ত যৌন অপরাধীদের একটা তালিকা থাকে বিভিন্ন দেশে যাতে তাদের মনিটরিং করার হয় অপরাধীরা কোথায় যাচ্ছে, তারা কি ভিক্টিমদের হুমকি-ধামকি দিচ্ছে কি-না? সেই বিষয়গুলো তদারকি করা আমাদের দেশে এখনো সে পরিবেশ হয়নি।

তাদের অভিযোগ, জামিন অযোগ্য অপরাধ হওয়ার পরও অনেক ক্ষেত্রে জামিন পেয়ে যাচ্ছে অভিযুক্তরা। ফলে বিচারহীনতার সংস্কৃতি শক্তিশালী হয়ে উঠছে। অনেক দেশে কিন্তু দ্রুত বিচার আইনে সাজা হয় এবং মানুষ তা দেখে সচেতন হয়

সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, একই অপরাধের পুনরাবৃত্তির পেছনে আইনী ও সামাজিক কাঠামো অনেকাংশে দায়ী। কেননা তারা মনে করে, যেহেতু গতবার আমি শাস্তি পাইনি, সেহেতু এ ঘটনাটা আবার ঘটাচ্ছি। সুতরাং সামাজিক কারণ আর মনস্তাত্তিক কারণ যদি উদ্ঘাটিত করা না যায়, তাহলে সমাজ থেকে ধর্ষণ নির্মূল করা সম্ভব নয়। আর এটি করা না গেলে অপরাধ বারবার সংগঠিত হবে একই অপরাধীর দ্বারা। তখন এর শাস্তি হচ্ছে একমাত্র প্রতিষেধক। গণমাধ্যমের তথ্যানুযায়ী, করোনা পরিস্থিতিতে দেশে গত ২ মে পর্যন্ত ৬০টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে।


মাজহার মান্না: সাংবাদিক-লেখক ও কর আইনজীবী, কিশোরগঞ্জ।

আরও পড়তে পারেন…
আমাদের গ্রামে যদি রাক্ষস না থাকত ।। সৌরভ চক্রবর্তী
স্বপ্নের জানাজা ।। দিব্যেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়

About the author

নরসুন্দা ডটকম