নরসুন্দা ডটকম ডেস্ক:
সালটা ১৯৪৮ অথবা ১৯৪৯ হতে পারে। সেই সময় আমি শ্রী ভারতলক্ষ্মী পিকচার্সের স্টুডিওতে রসায়ন বিভাগে কাজ করি। সিনেমা কর্মী ও ফ্রিল্যান্স কলাকুশলীদের সংগঠন ’সিনে টেকনিসিয়ান্স অ্যাসোসিয়েশন অব বেঙ্গল’-এর ভারতলক্ষ্মী স্টুডিওর কর্মীদের তরফ থেকে কার্যকরী সমিতিতে প্রতিনিধি। আমার কাছে একজন একটা চিরকুট দিয়ে গেল, তাতে লেখা আছে আপনি পার্কশো হাউসে সকাল ১০টায় মৃণাল বসুর সঙ্গে দেখা করুন। আমিও যথারীতি পার্কশো হাউসে গেলাম, সেদিন পার্কশো হাউসে সকাল ১০টায় যে ছবিটি দেখানো হয়েছিল সেই ছবিটির নাম ‘রোড টু লাইফ’। উদ্যোক্তাদের মধ্যে একজন ছিলেন মৃণাল সেন। যা হোক, সেদিন মৃণাল বসুর বদলে আমার দেখা হয়ে গেল মৃণাল সেনের সঙ্গে। এরই নিমন্ত্রণে আমার প্যারাডাইস কাফেতে আড্ডা মারার সূত্রপাত। সেদিন মৃণালদাকে মৃণালবাবু বলতাম। ধীরে ধীরে মৃণালবাবু, মৃণালদা হয়ে গেল। হ্যাঁ, আর একটা কথা, ‘রোড টু লাইফ’ও দেখেছিলাম ওইদিন। যে সময়টার কথা বলছি, তখন কমিউনিস্ট পার্টি বেআইনি। আমিও কমিউনিস্ট পার্টির সভ্য হওয়ার দরুন জেলে গিয়েছিলাম। জেল থেকে ফিরে কাজে যোগ দিয়েছি। প্যারাডাইস কাফেতে সেদিন যাঁরা আসতেন, তাঁদের মধ্যে অনেকেই কমিউনিস্ট পার্টির সভ্য ছিলেন, অথবা সমমনোভাবাপন্ন মানুষ ছিলেন। মৃণাল সেনও তাঁদের মধ্যে একজন।
বাংলা সিনেমা শিল্পের অবস্থা ভাল ছিল না। আমরা সেদিন বিদেশি ছবির দক্ষতা ও পটুতার সঙ্গে পাল্লা দিতে সক্ষম ছিলাম না। বেশিরভাগ ছবির পরিচালকরা হলিউডের ছবির ব্যর্থ অনুকরণের চেষ্টা করতেন। কদাচিৎ হয়তো বা উৎকৃষ্ট সাহিত্যের উপর নির্ভরশীল ছবি নির্মাণ হতো। বেশিরভাগ ছবি ছিল ব্যক্তিকেন্দ্রিক। কোনো সামাজিক বা অর্থনৈতিক সমস্যার কথা থাকতো না। বারে বারে সেদিনের সিনেমা বিষয়ক পত্রিকাগুলো তাঁদের নিবন্ধে এ ব্যাপারে সতর্ক করে দিলেও সেদিনের পরিচালকরা ওইসব নিবন্ধ লেখকদের উপেক্ষাই করতেন। বাংলা সিনেমার প্রদর্শনক্ষেত্র সিনেমা হাউসগুলোতে দর্শকের সংখ্যা কমতে লাগলো। সারা ভারতের এই করুণ অবস্থা। এই হালকে উন্নত করার জন্য ১২ জন প্রযোজক-পরিচালক তদানীন্তন ব্রিটিশ সরকারকে একটি ফিল্ম স্কুল করার জন্য অনুমতি চেয়ে আবেদন করেন কিন্তু সরকার সে অনুমতি দেওয়া থেকে বিরত হন।
যুদ্ধের সময় সারা ভারতে কালো টাকার ছড়াছড়ি। এই কালো টাকাকে সাদা করতে অনেকে চলচ্চিত্র শিল্পকে বেছে নিয়েছিল। চলচ্চিত্র সামগ্রিকভাবে খানিকটা চাঙ্গা হয়েছিল। কিন্তু বেনোজলের অর্থ ঢুকলেও সাথে সাথে অর্ধশিক্ষিত মানুষও ঢুকে পড়েছিল। সিনেমার মান কিন্তু এতটুকুও উন্নত হয়নি। এইটেই ছিল সামগ্রিকভাবে সিনেমার চেহারা। এর ওপর বাংলায় দাঙ্গা, দুর্ভিক্ষ ও দেশভাগ বাংলা চলচ্চিত্র শিল্পকে পঙ্গু করে দিয়েছিল। ২২টি স্টুডিওর জায়গায় কলকাতায় রইলো মাত্র পাঁচটি স্টুডিও। এর ফলে বাংলা ছবির মান খুবই খারাপ ছিল। যদিও একটা জিনিস লক্ষ্য করার বিষয় যে বাংলা সিনেমার ধারক ও বাহকদের সেদিন সিনেমা সম্পর্কে শিক্ষা গ্রহণের কোনোরকম আগ্রহ ছিল না। শুধু তাই নয়, আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র আন্দোলন সম্পর্কে কোনো ধারণাই ভারতীয় সিনেমা নির্মাতাদের ছিল না। তখন ফিল্ম সোসাইটি সবে শুরু হয়েছে। মুষ্টিমেয় কয়েকজন চলচ্চিত্রপ্রেমী এখানে ফিল্ম সোসাইটি আন্দোলনের সূত্রপাত করেন। তাঁরা রবিবার বা ছুটির দিনে বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহে সকালবেলা হলিউডের ধ্রুপদী ছবিগুলি এবং বিভিন্ন দেশের বিশেষ করে ফরাসি, জার্মান, পূর্ব ইউরোপের ধ্রুপদী ও হালফিলের নির্মিত ছবিগুলির দেখাবার আয়োজন করে থাকতো। মৃণালদা, ঋত্বিক এই ছবিগুলো দেখতেন। আমিও মাঝে মাঝে যেতাম। এই ছবিগুলোর ওপর আলোচনা হতো প্যারাডাইস কাফেতে। প্রয়াত তপন সিংহ তাঁর আত্মজীবনী ‘মনে পড়ে’-তে লিখেছেন, ‘‘মৃণাল সেন সোভিয়েত ইউনিয়ন, পূর্ব ইউরোপের ছবি এবং ধ্রুপদী ফরাসি চিত্রগুলি আমাদের কলাকুশলীদের স্টুডিওতে দেখাতেন।’’ সেদিন প্যারাডাইস কাফে আড্ডা ও আলোচনায় জমজমাট থাকতো। প্যারাডাইস কাফেটা ছিল জমজমাট শুধু চলচ্চিত্র নয় সংগীত, নাটক এবং বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হতো এই আড্ডায়। প্যারাডাইস কাফেটা ছিল ক্ষীরোদ ঘোষের বাজারের উলটোদিকে একটা গ্যারেজ ঘর। মালিক ছিলেন হেমবাবু। পদবিটা জানি না। বাইরে দেওয়ালে একটা পানের দোকান ছিল। মালিক কালীবাবু। একটা ছেলে কাজ করতো। যাঁরা ওখানে আসতেন, অর্থাৎ প্যারাডাইস কাফেতে তাঁদের অনেকে ধূমপান করতেন। মাঝে মধ্যে দাম বাকিও রাখতো। ঋত্বিক ওই দোকানের নিয়মিত খদ্দের ছিলেন। বিড়ি কিনতেন, বাকিও রাখতেন। দোকানে আড্ডা দিতে যাঁরা আসতেন পরবর্তীকালে তাঁরা নিজেরাই স্বনামধন্য ও কীর্তিমান রূপে সারা ভারতবর্ষে নিজ নিজ বিভাগে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। নিয়মিত যাঁরা আসতেন, তাঁরা হলেন হৃষিকেশ মুখার্জি, ঋত্বিক ঘটক, তাপস সেন, মৃণালদা, সলিল চৌধুরি। ক্রমে আরও ভিড় বাড়তে থাকে আসতে শুরু করেন অনেকে। বংশী চন্দ্রগুপ্ত, আমি, কালী ব্যানার্জি, বিজন ভট্টাচার্য, উৎপল দত্ত প্রমুখ। এর মধ্যে আই পি টি এ-র শিল্পীরাও ছিলেন। যদিও আই পি টি এ-র জন্ম ব্রিটিশ রাজত্বে, কিন্তু কংগ্রেস ভারতের শাসনভার গ্রহণ করলেও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে আই পি টি এ-র প্রগতিশীল ভূমিকাকে উপেক্ষা করতে পারেনি। আই পি টি এ শুধু নবান্নই সৃষ্টি করে নি, Sprit of India-র মতো নৃত্যনাট্যও প্রযোজনা করেছিল। এই নৃত্যনাট্যর সুরকার ছিলেন রবিশঙ্কর। নৃত্য পরিচালনা ও ভাবনা ছিল শান্তি বর্ধনের।
বিশ্বব্যাপী শান্তি আন্দোলন চলছে সেই সময়ে। ভারতবর্ষের বিভিন্ন শহরে শান্তি সমাবেশ অনুষ্ঠিত হচ্ছে। আমাদের কলকাতায়ও শান্তি সমাবেশ হয়েছিল। পার্ক সার্কাস ময়দান আর স্মার্টা গ্রাউন্ডের সমাবেশে প্যারাডাইস কাফেতে যাঁরা বসতেন তাঁরা অংশগ্রহণ করেছিলেন। ঋত্বিকদা, মৃণালদা আই পি টি এ-র সভ্য ছিলেন কিন্তু মৃণালদা কমিউনিস্ট পার্টির সভ্য ছিলেন না। ঋত্বিক কমিউনিস্ট পার্টির সভ্য ছিলেন। আমিও কমিউনিস্ট পার্টির সভ্য ছিলাম। আমি সিনে টেকনিসিয়ান্স অ্যাসোসিয়েশন অব বেঙ্গলের কার্যকরী সমিতির সভ্য ছিলাম, তাছাড়া কলাকুশলীদের মধ্যে জনপ্রিয় ছিলাম। সেই সুবাদে, মৃণালদা, ঋত্বিক, তাপস সেনকে নিয়ে বিভিন্ন স্টুডিওতে নিয়ে যেতাম। স্টুডিও’র কর্মীরা অসম্ভব কম মাইনে পেতেন। আমরা কর্মীদের বেতন বৃদ্ধি দাবিদাওয়া স্টুডিও মালিকদের কাছে পেশ করার জন্য সঙ্ঘবদ্ধ হওয়ার উপযোগিতা বোঝাতে আরম্ভ করলাম। এইভাবে মৃণালদাদের প্রতিটি স্টুডিওতে নিয়ে গিয়েছিলাম। আর এইভাবেই চলচ্চিত্র শিল্পে ওঁরা হয়ে গেলেন পরিচিত মুখ। ওঁদের আমি সি টি এ বি’র কার্যকরী সমিতির বর্ধিত সভায়ও নিয়ে গিয়েছিলাম। সেখানে সেই সময়ের নামী কলাকুশলী ও পরিচালকদের মধ্যে ওঁদের পরিচিতি যাতে হয় সেই কারণে। ক্রমে ক্রমে মৃণালদারা স্টুডিও মহলে পরিচিত মুখ হয়ে উঠছিলেন।
ফিরে আসি গণনাট্য সংঘের কথায়। এই সময় ভারতীয় গণনাট্য সংঘকে বিকেন্দ্রীকরণের প্রস্তাব আসে। এবং গৃহীতও হয়। এই প্রস্তাবের বিপক্ষে যাঁরা ছিলেন তাঁরা গণনাট্য সংঘ ছেড়ে এসে নতুন দল করেন। বহুরূপী ও ক্যালকাটা থিয়েটার্স-এর জন্ম সূচিত হয়। গণনাট্য সংঘ এবং তাঁদের বিভিন্ন শাখা সংগঠন তখন নিজেরাই নাটক, গান ও নৃত্যানুষ্ঠান শুরু করলেন। ঋত্বিক ‘দলিল’, ‘সেতু’ নাটক এই সময়ই রচনা করেন এবং নাটক দুটি অভিনীতও হয়। এই সময় নিউ এজ বা পিপলস্ এজ পত্রিকায় সাতটি আত্মহত্যা নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল, সেই প্রতিবেদন অবলম্বনে ঋত্বিক একটা নাটক লেখেন, ‘জ্বালা’। এই নাটকে কালী ব্যানার্জি, গীতা সেন প্রমুখ অভিনয় করেছিলেন। এই নাটক ব্যতীত আরও কয়েকটি নাটকে গীতাদির অভিনয় আমি দেখেছি। নাটকগুলি যথাক্রমে জ্বালা, মরাচাঁদ, নীল দর্পণ এবং বিসর্জন। গীতাদি ছিলেন অসামান্য অভিনেত্রী। সিনেমায়ও তিনি অভিনয় করেছেন, তবে সেগুলো হলো ঋত্বিক আর মৃণালদার ছবিগুলিতে। এখানেও তিনি সফল অভিনেত্রী।
প্যারাডাইস কাফেতে যে তিনজন সফল ও জনপ্রিয় পরিচালক হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন, তাঁরা মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটক এবং রাজেন তরফদার। এঁরা সবাই প্যারাডাইস কাফেতে আড্ডা দিতেন। প্যারাডাইস কাফের আড্ডার যুগে ওঁদের পকেটে সব সময় সিনেমা তৈরির বাজেট থাকতো। কিন্তু কোন প্রযোজক ছিল না। অনেক মজার মজার ঘটনা ঘটতো। তার মধ্যে একটি ঘটনার উল্লেখ করছি। পানু পাল ইনিও প্যারাডাইস কাফেতে নিয়মিত আড্ডা দিতেন, মৃণালদাদের বন্ধু ছিলেন। পানু পাল তাঁর এক বন্ধু ছবিতে অর্থ লগ্নি করবে শুনে সেই বন্ধুর কাছে গিয়ে মৃণালদাকে বা ঋত্বিককে দিয়ে ছবি করাবার জন্য অনুরোধ করেন। ওদিকে সেই ব্যবসাদার বন্ধুটি সত্যজিৎ রায়ের প্রোডাকশন কন্ট্রোলার অনিল চৌধুরিরও পরিচিত। অনিলবাবু তাঁকে সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালীতে অর্থ লগ্নি করতে অনুরোধ করেন। সেই বন্ধুটি ধুরন্ধর ব্যবসাদার হলেও অর্থ বিনিয়োগ করলেন বিধায়ক ভট্টাচার্যের ‘কা তব কান্তা’ ছবিতে। মৃণালদা অবশ্য সেই সময় বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় যেমন ‘পরিচয়’, ‘নতুন সাহিত্য’ প্রভৃতি পত্রিকায় সিনেমা বিষয়ক প্রবন্ধ লিখতেন। সেই সময় উনি কি না করেছেন! লেখা ছাড়া প্রেসে প্রুফ দেখা, ছাত্র পড়ানো এবং অপর পরিচালকদের জন্য চিত্রনাট্য লেখা— সবই।
এই সময় অর্থাৎ ১৯৫০ সালে, সিনেমার মান উন্নয়নের জন্য, সিনেমাকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার জন্য তদানীন্তন কেন্দ্রীয় সরকার এস কে পাতিলের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করেন। এই কমিটি সি টি এ বি কে এই চলচ্চিত্র শিল্পের উন্নয়নের জন্য বক্তব্য রাখার অনুরোধ করেন। আমি যদিও কার্যকরী সমিতির সভ্য ছিলাম তবু যে স্মারকলিপি ঐ পাতিল কমিটির কাছে প্রদান করা হবে, সেটি মৃণালদা, ঋত্বিককে দেখাবার জন্য সুধী প্রধানকে অনুরোধ করি। প্যারাডাইস কাফেতে সুধীদা উক্ত স্মারকলিপির অনুলিপিটি আমাদের পড়তে দেয় ও আমাদের মতামতকেও গুরুত্ব দেয়। একথা প্রয়াত সুধী প্রধান তাঁর চলচ্চিত্রায়ন পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে উল্লেখও করেছেন। দুঃখের বিষয় ক্রমশ প্যারাডাইস কাফের আড্ডাটা কমে আসে। পরে আড্ডা একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়। কমিউনিস্ট পার্টির ওপর নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার ফলে গণনাট্য সংঘের সভ্যরা ৪৬ ধর্মতলায় ফিরে গেলেন। মৃণালদা মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টিভের চাকরি নিয়ে উত্তর প্রদেশে চলে গিয়েছিলেন এবং ঋত্বিকও ফিল্মস্তানের চাকরি নিয়ে বোম্বেতে চলে গেলেন। পরে দুজনেই কলকাতায় ফিরে এলেও প্যারাডাইস কাফে-মুখো হলেন না। মৃণালদা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন ‘রাতভোর’ ছবি নির্মাণের কাজে। ঋত্বিক ব্যস্ত হয়ে পড়লেন, তার নাগরিক ছবি নির্মাণের কাজে। তিনিও প্যারাডাইস-মুখো হলেন না। তাপস সেন বহুরূপী আর বিজন ভট্টাচার্যর মঞ্চে আলো করার কাজে সাথে সাথে অন্যদলের মঞ্চে আলোর দায়িত্ব নেওয়ার ফলে প্যারাডাইস কাফেতে আর আসার সময় পেতেন না। দুঃখের আর যন্ত্রণার বিষয় হলো, যখন ওঁরা সবাই পায়ের তলায় মাটি পেলেন তখন যে বন্ধুত্ব ওঁদের নিজেদের মধ্যে গড়ে ওঠেছিল তা আস্তে আস্তে ভেঙে গেল। এইভাবে প্যারাডাইস কাফের আড্ডা ভেঙে যেতে থাকে।
(২)
মৃণালদার জন্মস্থান অধুনা বাংলাদেশের ফরিদপুর। উনি কলকাতায় চলে আসেন। বয়স তখন সবে ১৭ বছর। কলকাতায় পড়তে আসেন। স্কটিশচার্চ কলেজের বিজ্ঞান বিভাগ। ফিজিক্সে ছিল অনার্স। কলেজে ঢোকার কিছুদিনের মধ্যেই রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু হয়। ওই বছরেই সুভাষচন্দ্র ব্রিটিশ সরকারের চোখে ধুলো দিয়ে ভারত থেকে নিরুদ্দেশ হন। সুভাষচন্দ্র বসুকে মৃণালদা খুব কাছ থেকেই দেখেছেন। মৃণালদাদের বাড়িতে সুভাষচন্দ্র বসু আত্মগোপন করে থেকেছেন। বলা যেতে পারে মৃণালদা শৈশব থেকেই রাজনীতির সঙ্গে পরিচিত। দেশের স্বাধীনতার জন্য সারা বাংলা কেন সারা ভারতে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন চলেছে এবং মৃণালদার পরিবারও সেদিন স্বাধীনতা, বিপ্লবের পক্ষে ছিলেন। তখনকার দিনে বাবা প্রয়াত দীনেশচন্দ্র সেন ছিলেন একজন লব্ধপ্রতিষ্ঠ আইনজীবী। বহু স্বাধীনতা সংগ্রামীর হয়ে উনি আইনি লড়াইয়ে অংশ নিয়েছিলেন। এছাড়াও ত্রিশের দশকে গান্ধীজীর আমরণ অনশনের সময় প্রয়াত দীনেশচন্দ্র সেন ফরিদপুরের আইনজীবীদের নিয়ে আদালত বয়কট করেন। তারজন্য তাঁকে অন্যায়ভাবে ব্রিটিশ সরকারের প্রতিনিধিরা শাস্তি দেয় সেখানেও এই অযৌক্তিক শাস্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান, আইনি লড়াই লড়েন এবং জয়লাভ করেন। মৃণালদার বাবার মৃত্যুর পর প্রয়াত স্বনামধন্য সাংবাদিক, যুগান্তরের প্রাক্তন সম্পাদক শ্রদ্ধেয় বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায় যুগান্তর পত্রিকায় সম্পাদকীয়তে ওঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে স্মৃতিকথা লিখেছিলেন। ওই প্রবন্ধে তিনি প্রয়াত দীনেশ সেন যে কত বড় মাপের মানুষ ছিলেন সেটি বিশদভাবে উল্লেখ করেছিলেন। মৃণালদা বামপন্থী, আজও তিনি মার্কসীয় দর্শনে বিশ্বাসী। সেই কারণে তাঁর ছবি রাজনৈতিক হয়ে ওঠে।
স্কটিশচার্চ কলেজে পড়তেন। সেই সময় নিয়মিত ইম্পেরিয়াল লাইব্রেরিতে (বর্তমানে ন্যাশনাল লাইব্রেরি) নিয়মিত পড়াশুনা করার জন্য যেতেন। নানা ধরনের বই পড়ার অভ্যাস ছিল। এই বই পড়তে পড়তেই রুডলঙ আর্নেমের ‘ফিল্ম অ্যান্ড আর্ট’ বইটা পড়ে এতটাই ভালো লেগেছিল যে ফিল্মে র নন্দনতত্ত্বের ওপর প্রাথমিক ধারণা জন্মালো তখনই। এরপর ওঁর হাতে এলো ভ্লাদিমির নিলসনের ‘সিনেমা ইজ এ গ্রাফিক আর্ট’। সেই বইটি পড়ে আইজেনস্টাইনের মন্তাজতত্ত্বের ওপর জ্ঞান অর্জন করলেন। আরও জানার জন্য আইজেনস্টাইনের লেখা ‘ফিল্ম ফর্ম’ এবং ‘ফিল্ম সেন্স’ বই দুটি পড়লেন। এই বইগুলি পড়ার পর ওঁর সিনেমা দেখার আগ্রহ তৈরি হয়। সিনেমা দেখতে শুরু করেন। বাংলা, হিন্দি, ইংরেজি সব ছবি। ফিল্ম সোসাইটি আন্দোলন সবে শুরু হয়েছে। ফিল্ম সোসাইটি বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহ ভাড়া করে হলিউডের ব্রিটেনের নির্মিত ছবি ছাড়াও ইউরোপ ও সোভিয়েতে নির্মিত ছবিগুলো দেখাতো। সেই সব ছবিগুলিও দেখতে লাগলেন। এই ছবিগুলির সবই ছিল ধ্রুপদী। এর মধ্যে ছিল আইজেনস্টাইনের ‘ব্যাটেল সিপ পোটেমকিন’, ‘অক্টোবর’, পুডভকিনের ‘মাদার’, ডভজেনকোর ‘আর্থ’, কার্ল ডায়ার্সের ‘প্যাসন অব জোয়ান অব আর্ট’ ইত্যাদি। এইসব ছবি উনি স্টুডিওর কলাকুশলীদেরও স্টুডিওতে দেখাতেন। এছাড়াও পূর্ব ইউরোপ ও ফরাসি ছবির প্রতিও ওঁর আগ্রহ ছিল।
জাঁ রেনোয়া কলকাতা এলেন তাঁর নতুন ছবি ‘রিভার’-র শুটিং করতে। মৃণালদা কিছু বন্ধু-বান্ধব রেনোয়ার সঙ্গে সহকারী হিসাবে কাজে যুক্ত ছিলেন। মৃণালদা দলবদ্ধ হয়ে রেনোয়ার কাজের ধ্যান ধারণা বুঝতে, ছবি নির্মাণের পদ্ধতি সম্বন্ধে প্রত্যক্ষভাবে জ্ঞান অর্জনের জন্য শ্যুট দেখতে যেতেন। ক্রমে চলচ্চিত্র সম্পর্কে ধারণা, অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে নিজেই চলচ্চিত্র নির্মাণে উৎসাহী হলেন। প্রথমে সহকারী পরিচালক হিসাবে কাজ করেন ‘দুধারা’ ছবিতে। ‘দুধারা’ ওঁরই গল্প ‘আজবনগরের রূপকথা’র চিত্ররূপ। চিত্রনাট্য সম্ভবত ওঁরই ছিল। প্রায় একই সময় ঋত্বিক ঘটকও বিমল রায়ের সহকারী পরিচালক হয়ে কাজ করেন ‘তথাপি’ ছবিতে। এছাড়াও ওই সময় চলচ্চিত্র বিষয়ক প্রবন্ধ পরিচয় ও নতুন সাহিত্যে লিখতে শুরু করেন। সুনন্দা বন্দ্যোপাধ্যায় মৃণালদাকে তাঁর প্রযোজনায় ছবি নির্মাণ করার প্রস্তাব দেন। মৃণালদাও তৎক্ষণাৎ সম্মতি দেন। ছবিটির নাম ‘রাতভোর’, কাহিনী স্বরাজ বন্দ্যোপাধ্যায়ের। যদিও মৃণালদা ‘রাতভোর’ ছবির কথা কোথাও উল্লেখ করেন না। উনি মনে করেন ‘রাতভোর’ ছবিটা অত্যন্ত বাজে ছবি। মৃণালদা বলতেন ‘‘সত্যজিৎ রায়ের প্রথম ছবি পথের পাঁচালী দারুণ ছবি, পৃথিবী কাঁপানো ছবি আর প্রথম ছবি আমাকেই কাঁপিয়ে দিয়েছে।’’ মৃণালদা দমার পাত্র নন। তিনি আবার চলচ্চিত্র বিষয়ক প্রবন্ধ বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখা শুরু করলেন। এছাড়াও চিত্রনাট্যও লিখলেন। নির্মল মিত্র ‘রাজধানী থেকে’ ছবিটির চিত্রনাট্য লিখলেন। এটি ওঁর কাহিনী। নিকোলাই গোগলের ‘ইন্সপেক্টর জেনারেল’র ভাষান্তর। এটা কিন্তু একটি সফল চিত্র। নির্মল মিত্রকে এই ছবির পর বসে থাকতে হয়নি। মৃণালদাও এর কিছুদিন পর ওর দ্বিতীয় ছবির প্রযোজক পেয়ে যান। এই ছবির প্রযোজক হলেন প্রখ্যাত গায়ক ও সুরকার হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। ছবির নাম ‘নীল আকাশের নিচে’। পরবর্তীকালে মৃণালদার ছবিতে যে রাজনৈতিক বক্তব্যে ভরপুর থেকেছে তারই শুরু হয়েছিল এই ছবি দিয়ে। যদি মৃণালদা রাজনৈতিক ব্যাপারটার সঙ্গে সহমত হলেও এই ছবির নির্মাণের সম্পর্কে সন্তুষ্ট ছিলেন না। তবে একটা কথা মানতেই হবে এই ছবিটি বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। যেটা পরবর্তী ছবি এবং মৃণালদার অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছবি ‘বাইশে শ্রাবণ’ করার সুযোগ করে দিয়েছিল। এই ছবিটি নির্মাণ করতে অর্থাৎ এই ছবির প্রযোজক পেতে কোনো অসুবিধে হয়নি। ‘বাইশে শ্রাবণ’কে ভারতবর্ষের অন্যতম একটি আধুনিক ছবি হিসাবে চিহ্নিত করছি। এই প্রসঙ্গে মৃণালদার একটি সাক্ষাৎকারে তিনি যে উক্তি করেছিলেন সেটা এই রকম, ‘‘সামাজিক জীব হিসাবে সামাজিক ঘটনা আমাকে বিশেষভাবে নাড়া দিয়েছে, …. আন্তনিয়নি আমাকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছে, যেখানে স্ত্রী-পুরুষের সম্পর্ক এবং অ্যালিনিয়শেনের ব্যাপারে রয়েছে তা আমাকে মুগ্ধ করেছে, এটাকে রাজনৈতিকভাবেও ব্যাখ্যা করা যায়। আমি সেই পিরিয়ডের ছবিতে (অর্থাৎ বাইশে শ্রাবণ, পুনশ্চ, প্রতিনিধি ইত্যাদি ছবি নির্মাণকালে) সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে পুরুষ ও নারীর সম্পর্ক ধরার চেষ্টা করেছি।’’
যুদ্ধে শুধু মানুষই মারেনি, লোকালয় ধ্বংস করেনি, সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে দেশের পর দেশকে বিপর্যস্ত করেছে। তার ফলে সাবেকি মূল্যবোধেও পরিবর্তন ঘটতে বাধ্য। পুরুষদের মতো মেয়েরাও ঘরের বাইরে বেরোতে শুরু করলো, নানা ধরনের কাজে লিপ্ত হতে আরম্ভ করলো। নারী মুক্তি সংগঠিত হলো। মৃণালদার মতে এই সময়টা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। এবং এই কারণেই মৃণালদা তার ছবিতে যুদ্ধ নিয়ে এসেছেন। যুদ্ধের ফলে এদেশে অর্থাৎ বাংলায় দুর্ভিক্ষের সৃষ্টি হয়েছে এবং এরই পটভূমিতে ‘বাইশে শ্রাবণ’ তৈরি হলো। মৃণালদা জনমনোরঞ্জনের জন্য কখনো ছবি করেননি। তিনি ছবি করেছেন জনমনে ধাক্কা দেওয়ার জন্য। দুর্ভিক্ষের ভয়াল চেহারা সর্বপ্রথম বাংলা ছবির জগতে মৃণালদাই নিয়ে আসেন। সেটা এই ছবির মাধ্যমেই।
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে মৃণালদার পরিচিত এই ছবির মাধ্যমেই ঘটেছিল। মৃণালদা এই ছবিটা গ্রেট ছবি বলে মনে করেন না, কিন্তু আমি ভিন্নমত পোষণ করি। আমি এই ছবিটাকে আন্তর্জাতিক সিনেমা আন্দোলনে একটি বড়মাপের প্রতিবাদী ছবি বলে উল্লেখ করছি। পুরুষদের বিরুদ্ধে স্ত্রীর প্রতিবাদ বলে মনে করছি। এই ছবিটিকে মৃণালদা মহৎ ছবি বলে মনে না করলেও ছবিটি নির্মাণ করে খুশি হয়েছেন। এই ছবিটির পর মৃণালদাকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। পরপর বিরামহীনভাবেই ছবি করে গেছেন।
নোট: লেখাটির গুরুত্ব বিবেচনা করে নরসুন্দার পাঠকদের জন্য “গণশক্তি” থেকে সংগ্রহ করে প্রকাশ করা হলো- সম্পাদক।