মানুষ- সমাজ

কমরেড ফিদেল কাস্ত্রো

নরসুন্দা ডটকম   নভেম্বর ২৮, ২০১৬

বিশের দশকে স্পেন থেকে কিউবায় আসা অভিবাসী আখচাষি আনহেল কাস্ত্রো ই আর্গিস-এর পুত্র যখন জন্মাচ্ছেন, রুশ বিপ্লবের বয়স এক দশকও হয়নি। চিনে ৩৩ বছরের কমিউনিস্ট নেতা মাও জে দং জাতীয়তাবাদী চিয়াং কাই শেকের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন এবং চাষিদের খাজনা না দিতে আবেদন করছেন। এশিয়া, আফ্রিকার বেশির ভাগ দেশই তখন বিদেশি শাসকের অধীনে।

শনিবার নব্বই বছরের ফিদেল আলেহান্দ্রো কাস্ত্রো যখন মারা গেলেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন অস্তিত্বহীন। চিন দুনিয়ার অন্যতম ক্ষমতাশালী দেশ, মাওয়ের বিপ্লবী নীতি যে দেশে হাজার টাকার অচল নোট। টুইটার, ফেসবুকে ভাসছে একের পর এক মন্তব্য, ‘বিরোধীদের জেলে পোরার যে সব হুমকি ট্রাম্প দিয়েছিলেন, কিউবার ফিদেল কাস্ত্রোই তার স্রষ্টা।’ ফিদেল ১৯৫৯ সাল থেকে ১৯৭৬ অবধি কিউবার প্রধানমন্ত্রী, ১৯৭৬ থেকে ২০০৮ অবধি সে দেশের প্রেসিডেন্ট, ১৯৬১ থেকে টানা ২০১১ অবধি কিউবার কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক। সালতামামিই একনায়ককে নির্ভুল চিনিয়ে দেয়। কিন্তু ফিদেল কাস্ত্রোর সঙ্গে ডোনাল্ড ট্রাম্পের তুলনাটাই জানিয়ে দেয়, এই দুনিয়ার বোধ থেকে রাজনীতি উচ্ছেদ হয়ে গেছে।

১৯৪৭। তখন তিনি হাভানা বিশ্ববিদ্যালয়ে তরুণ ছাত্রনেতা, পানামার সামরিক শাসক রাফায়েল ট্রুসিলো-র বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন। হাভানা ছেড়ে কলম্বিয়ার রাজধানী বোগোটা। সেখানে হুয়ান পেরন-এর বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলন। ‘এর সঙ্গে মার্ক্সবাদের কোনও সম্পর্ক ছিল না। আমরা তরুণরা সবাই তখন উপনিবেশ, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে। গণতন্ত্রের পক্ষে।’ পরে জানিয়েছিলেন কাস্ত্রো। বোগোটার এক কলেজছাত্রও সে দিনের মারদাঙ্গায় অংশ নিয়েছিল। তার নাম গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস। সারা জীবন যিনি ফিদেলের পরম বন্ধু।

১৯৫২। হাভানার সেনা-ব্যারাকে আক্রমণ। সেনা-আক্রমণে কাস্ত্রোর সঙ্গীরা কেউ মারা গেলেন, কেউ বা আহত। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিপ্লবের অভিযোগে কাস্ত্রোর বিচার শুরু হল। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে মেক্সিকো, ১৯৫৬ সালে সঙ্গী গেরিলাদের নিয়ে গামা নামে এক ইয়টে গেরিলা সঙ্গীদের নিয়ে ভেসে পড়লেন কিউবার উদ্দেশে। তত দিনে ভাই রাউল-এর সূত্রে কাস্ত্রোর সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছে আর্জেন্টিনার এক তরুণ ডাক্তারের। তাঁর নাম চে গেভারা। শুরু হল কিউবায় গেরিলা যুদ্ধের নতুন পর্ব।

ওই ১৯৫৬ সালটাই কিউবার বিপ্লবের জলবিভাজিকা। বাতিস্তা সরকার জঙ্গলে বিমানহানা চালাচ্ছে, কাস্ত্রো ও তাঁর সঙ্গীরা জঙ্গলে পালিয়ে গিয়েছেন। শিখছেন গেরিলা যুদ্ধের কলাকৌশল। সরকারও থেমে নেই। ৪১ জন সহযোদ্ধার মধ্যে বেঁচে আছেন মাত্র ১৯ জন। এই ১৯ জনই রাতের অন্ধকারে সেনাছাউনিতে হামলা চালায়, অস্ত্র লুঠ করে, আক্রমণ করে ভূস্বামীদেরও। স্থানীয় লোকেরা এর পরই গেরিলাদের সমর্থক হয়ে উঠলেন, গেরিলাদের সংখ্যা এক লপ্তে ২০০ ছাড়িয়ে গেল।

এবং অন্য বিপ্লবী দলগুলির সঙ্গে সংযোগ গড়ে তুললেন কাস্ত্রো। গেরিলারাই তখন কিউবার বিশাল এলাকার হাসপাতাল, স্কুল, চিনির কারখানা নিয়ন্ত্রণ করে। ফিদেল এক দিকে গেরিলা সেনাধ্যক্ষ, অন্য দিকে হাসপাতাল, কারখানার নেতা। কাস্ত্রো, চে গেভারার ভারতীয় শিষ্যদের এই মাস্টার স্ট্র্যাটেজি ছিল না, তাঁদের বিপ্লবও তাই সফল হয়নি। কাস্ত্রো এক বার ভারতে এসে অবাক হয়েছিলেন, ‘সে কি! এতগুলি কমিউনিস্ট পার্টি।’

১ জানুয়ারি, ১৯৫৯। হাভানার রাস্তায় ফিদেল কাস্ত্রো এবং তাঁর বিজয়ী গেরিলা বাহিনী। শাসক ফুলহেনসিয়ো বাতিস্তা দেশ ছেড়ে পালালেন। কিন্তু আমেরিকা ছাড়বে কেন? টানাপড়েন ক্রমশ বাড়তে থাকল। এপ্রিল ১৯৬১। হাভানার কাছে ‘বে অব পিগস’-এ উড়ে এল ৮টি মার্কিন বোমারু বিমান। সিআইএ-কে তখন ১ কোটি ৩০ লক্ষ ডলার বাজেট দেওয়া হয়েছে, কাস্ত্রো হঠাও! ব্যর্থ হল সেই অভিযান। ঠিক যেমন ভাবে বার বার ব্যর্থ হবে কাস্ত্রোকে হত্যা করার সিআইএ-প্রকল্পগুলি।

ঠান্ডা যুদ্ধে পাল্টা চাল দিল সোভিয়েত রাশিয়া। ক্রুশ্চেভ  হাভানায় ক্ষেপণাস্ত্র বসানোর প্রস্তাব দিলেন। আমেরিকা প্রমাদ গুনল। কিউবার প্রতিটি জাহাজ খতিয়ে দেখার নির্দেশ দেয় সে। কিউবান মিসাইল ক্রাইসিস। দুই পারমাণবিক মহাশক্তি ছোট্ট একটি দ্বীপকে কেন্দ্র করে পরস্পর মুখোমুখি। দুনিয়ার শিরদাঁড়ায় তৃতীয় মহাযুদ্ধের ঠান্ডা স্রোত বইছে। তেরো দিনের সেই তীব্র উত্তেজনাপর্বের অবসান হল অক্টোবরের ২৮ তারিখে, দুই পক্ষের একটা বোঝাপড়া হল। কিন্তু ওই ছোট্ট দেশটির ভূমিকা স্থির হয়ে গেল সেই দিনই।

তার পরের তিন দশক সেই ভূমিকা পালনের ধারাবাহিক ইতিহাস, যে ইতিহাস ঠান্ডা লড়াইয়ের এক অনন্য অধ্যায়। দুই মহাশক্তির সেই দ্বৈরথে কিউবার অবস্থান শত্রুপক্ষের— মানচিত্রের আক্ষরিক অর্থে— পায়ের কাছে। আয়তনে সে মার্কিন দেশের ১ শতাংশ, জনসংখ্যায় ৩ শতাংশ। ওয়াশিংটনের কর্তারা তাকে লাগাতার বিপর্যস্ত করে নিজের প্রভাববলয়ে আনতে চেয়েছেন, অর্থনৈতিক অবরোধ জারি রেখেছে কার্যত গোটা ‘মুক্ত দুনিয়া’। মস্কোর সাহায্যে ফিদেলের কিউবা স্বতন্ত্র থেকেছে। প্রতিরোধে স্বতন্ত্র।

নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন। কিউবার অর্থনীতি তছনছ হল, দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার তাড়না বেড়ে গেল বহুগুণ। ফিদেল জানালেন, আটকাবেন না কাউকে আর। পাশাপাশি, দেশে প্রতিবাদীদের উপর দমন নীতি আরও জোরদার হল। মার্কিন শাসকরা দেখছিলেন। কিউবার অর্থনীতির সঙ্গে সঙ্গে তার প্রেসিডেন্টের স্বাস্থ্যও ভেঙে পড়ছিল দ্রুত। অবশেষে, ২০০৮ সালে তিনি সরে দাঁড়ালেন, ক্ষমতার উত্তরাধিকার তুলে দিলেন ভাই রাউলের হাতে। সেই বছরই হোয়াইট হাউসে প্রবেশ করলেন বারাক ওবামা। তিনি তাঁর দ্বিতীয় দফায় যখন কিউবার সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করলেন, তত দিনে দু’দেশের যোগাযোগ অনেক বেড়ে গেছে। ফিদেল তা দেখেছেন, তাঁর শীর্ণ থেকে শীর্ণতর হতে থাকা সায়াহ্নে। এ বার তার অবসান হল।

%e0%a6%95%e0%a6%bf%e0%a6%89%e0%a6%ac%e0%a6%be-%e0%a6%ac%e0%a6%bf%e0%a6%aa%e0%a7%8d%e0%a6%b2%e0%a6%ac

(বন্ধু- চে’র সাথে ফিদেল)

নরেন্দ্র মোদীর ভারতের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের অবশ্য অবসান হওয়ার বিশেষ কিছু নেই। অথচ ১৯৫৯ সালে বিপ্লবের পর শুরুতেই যে দেশটা কিউবাকে স্বীকৃতি দেয়, তার নাম ভারত। তার পর কাস্ত্রো ভারতে এসেছেন, ১৯৮৩ সালে নির্জোট আন্দোলনের মঞ্চে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধীকে সেই ঐতিহাসিক আলিঙ্গন। ইন্দিরা হ্যান্ডশেকের জন্য হাত বাড়িয়েছিলেন, ফিদেল হাত বাড়াননি। পরপর দু’বার একই ঘটনা, মঞ্চে অপ্রস্তুত ইন্দিরা। তৃতীয় বারে আবার হাত বাড়িয়েছেন, কাস্ত্রোর ‘বেয়ার হাগ’। ১৯৯২, কিউবায় ঘোর দুর্ভিক্ষ। ভারত দশ হাজার টন চাল ও গম পাঠাল কিউবায়। কাস্ত্রো বললেন, ‘ব্রেড অব ইন্ডিয়া।’ ওই গমে ১ কোটি কিউবান মানুষ প্রত্যেকে অন্তত একটি রুটি খেতে পারবেন।

ফিদেল কাস্ত্রো স্তালিনের মতো লৌহমানব নন, মাওয়ের মতো শুধুই চেয়ারম্যান নন। তিনি খণ্ডিত এক মানুষ। কখনও কিউবার মতো ছোট্ট দেশকে নিয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্রকে প্রতিরোধ করেন, আবার কখনও মেয়ে-বউ তাঁকে ছেড়ে চলে যায়। দ্বিতীয় স্ত্রী ছাড়াও দুই বান্ধবীর সঙ্গে ওয়ান নাইট স্ট্যান্ডে কন্যার জন্মদান। লাতিন আমেরিকার মাচিসমো! পৌরুষ তার আবেদনে, আবার ভাইকে ক্ষমতায় বসানোর জেদি অঙ্গীকারেও। রোমান্টিক, বিপ্লবী, বিশ্বনাগরিক এবং জেদি স্বৈরাচারের এই মিশ্রণ একুশ শতকের দুনিয়ায় আর এক বার তৈরি হওয়া সম্ভব নয়। তৈরি হওয়ার প্রয়োজনও নেই।

নোট: লেখাটি আনন্দবাজার থেকে নেয়া।

About the author

নরসুন্দা ডটকম

Leave a Comment