মেজর জেনারেল (অব.) এম এ মতিন বীর প্রতীক পিএসসি আমাদের মুক্তিযুদ্ধ এবং দেশের সশস্ত্র বাহিনীর ইতিহাসে একটি গৌরবোজ্জ্বল নাম। ১৯৪৩ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি কিশোরগঞ্জ জেলার তাড়াইল উপজেলার কাজলা গ্রামে তাঁর জন্ম। তাঁর পিতা মরহুম এম এ গনি।
১৯৬৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক সম্পন্ন করার পর তিনি ১৯৬৪ সালে ৫ জুন তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কমিশনপ্রাপ্ত হন। ক্যাপ্টেন ও মেজর পদমর্যাদায় অধিষ্ঠিত থাকাকালে তিনি ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ থেকে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ৩ নম্বর সেক্টরে বিভিন্ন পর্যায়ের সাব-সেক্টর, কোম্পানি কমান্ডার ও ব্যাটলিয়ন কমান্ডার হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত হন।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে সুদীর্ঘ চাকরি জীবনে তিনি নানাবিধ গুরুত্বপূর্ণ কমান্ড ও স্টাফ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ব্রিগেডিয়ার পদমর্যাদায় সামরিক প্রশিক্ষণ পরিচালক ও স্কুল অব ইনফেন্ট্রি অ্যান্ড ট্যাকটিক্স-এ কমান্ড্যান্ট এবং মেজর জেনারেল পদমর্যাদায় সেনাসদরে অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল ছিলেন। তাছাড়া তিনি তিনটি পদাতিক ডিভিশনের জিওসি এবং ডিজি, ডিজিএফআই হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
একাত্তরে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কমিশন অফিসার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ডাকে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি দেশমাতৃকার টানে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে চলে যান। তাঁর নেতৃত্বে কয়েকটি যুদ্ধ ইতিহাস হয়ে আছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সদর থেকে সিলেটমুখী সড়কের ১৮ মাইল পরই মাধবপুর, হবিগঞ্জ জেলার (১৯৭১ সালে মহকুমা) অন্তর্গত। মুক্তিযুদ্ধকালে ২৮ এপ্রিল এখানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর এক যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর একটি দলের নেতৃত্ব দেন এম এ মতিন।
মাধবপুর এলাকাকে তিতাস নদী ও এর শাখা সোনাই নদী দুই ভাগে বিভক্ত করেছে। এর পূর্ব পাশে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পতন হলে মেজর কে এম সফিউল্লাহর (পরে মেজর জেনারেল ও সেনাপ্রধান) নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধারা সমবেত হন মাধবপুরে। তাঁর দলে ছিলেন আবদুল মতিন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া দখলের পর পাকিস্তান সেনাবাহিনী ২১ এপ্রিল শাহবাজপুরের দিকে অগ্রসর হয়। জঙ্গি বিমানের অব্যাহত আক্রমণ এবং অবিরাম কামানের গোলাবর্ষণের মাধ্যমে পাকিস্তানিরা নদীর তীর ধরে শাহবাজপুরে চলে আসে। তিনি সহযোদ্ধাদের নিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অগ্রযাত্রা প্রতিরোধের চেষ্টা করেন।
রক্তক্ষয়ী এক যুদ্ধের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী শাহবাজপুর দখল করে। তবে এম এ মতিনের নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানিদের যথেষ্ট দেরি করিয়ে দিতে সক্ষম হন। তাঁরা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বেশ ক্ষয়ক্ষতিও করেন।
আবদুল মতিন যখন বুঝতে পারেন যে তাঁদের পক্ষে আর প্রতিরক্ষা অবস্থান ধরে রাখা সম্ভব নয়, তখন তিনি সহযোদ্ধাদের নিয়ে পশ্চাদপসরণ করেন। এরপর পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী তিনি প্রথমে জগদীশপুর-ইটখোলা সড়কে নতুন করে প্রতিরক্ষা গড়ে তোলেন। পরে কৈতরা গ্রামে প্রতিরক্ষা অবস্থান নেন।
২৮ এপ্রিল সকালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী এম এ মতিনের প্রতিরক্ষা অবস্থানে ব্যাপক গোলাবর্ষণ শুরু করে। তারা নির্বিচারে গোলাবর্ষণ করছিল। প্রাথমিক আক্রমণের পর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অগ্রগামী দল দুপুর ১২টার মধ্যে মাধবপুরে মুক্তিযোদ্ধাদের সব প্রতিরক্ষার সামনে পৌঁছে যায়।
প্রথমে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রায় এক ব্যাটালিয়ন সেনা তিন দিক থেকে আক্রমণ চালায়। বাঁ পাশের দল মুক্তিযোদ্ধাদের অগ্রবর্তী দক্ষিণ ভাগের অবস্থান অর্থাৎ আবদুল মতিনের প্রতিরক্ষায় আক্রমণ করে। দ্বিতীয় দল মুক্তিবাহিনীর দুই প্রতিরক্ষার মাঝ দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ে। তৃতীয় দল মুক্তিবাহিনীর অপর প্রতিরক্ষায় আক্রমণ করে। মুক্তিযোদ্ধাদের ওই দলের নেতৃত্বে ছিলেন এ এস এম নাসিম (বীর বিক্রম, পরে লেফটেন্যান্ট জেনারেল ও সেনাপ্রধান)।
এরপর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আরেকটি ব্যাটালিয়ন এসে যুদ্ধে যোগ দেয়। বিকেল চারটা পর্যন্ত দুই পক্ষে তুমুল যুদ্ধ হয়। সংকটময় এমন মুহূর্তে এম এ মতিন বিচলিত হননি। সহযোদ্ধাদের নিয়ে পাকিস্তানি আক্রমণের যথোপযুক্ত জবাব দেন। এই যুদ্ধে তিনি অপরিসীম সাহস ও দৃঢ়তার পরিচয় দেন।
এম এ মতিন চাকরি করতেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে। ১৯৭১ সালের মার্চে ছুটিতে পৈতৃক বাড়িতে ছিলেন। তখন তাঁর পদবি ছিল ক্যাপ্টেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ময়মনসিংহে সমবেত দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে ভারতে যান। মুক্তিযুদ্ধ আনুষ্ঠানিক রূপ পেলে ৩ নম্বর সেক্টরের সিমলা সাবসেক্টরের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে ‘এস’ ফোর্সের অধীন ১১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ব্রাভো (বি) কোম্পানির অধিনায়ক নিযুক্ত হন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য এম এ মতিনকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়।
এম এ মতিন স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের পর ১৯৯৮ সালে সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করেন। ২০০৮-০৯ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে তিনি চট্টগ্রাম মহানগরে বসবাস করেন। তাঁর মা রওশন আরা বেগম। স্ত্রী শওকত আরা বেগম। তাঁদের একজন কন্যাসন্তান রয়েছে।
লেখক: সাইফুল হক মোল্লা দুলু, সাংবাদিক।