মানুষ- সমাজ

শহীদ লে. আবু মঈন মো. আশফাকুস সামাদ, বীর উত্তম

নরসুন্দা ডটকম   ডিসেম্বর ১০, ২০১৬

শহীদ আবু মঈন মো. আশফাকুস সামাদের পৈতৃক বাড়ি কিশোরগঞ্জ জেলার করিমগঞ্জ উপজেলার সতেরো দড়িয়া গ্রামে।

আজীবন অকৃতদার এই বীর সেনানী আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সাহসিকতার এক অনন্য ইতিহাস রেখে গেছেন। তাঁর আত্মত্যাগের কথা বাঙালি জাতির ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মেধা, দক্ষতা,শারিরীক যোগ্যতা ও যুদ্ধে সাহসিকতাকে বিবেচনায় নিয়ে কিছু সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধাকে সামরিক বাহিনীতে অন্তভূর্ত করা হয়। আবু মঈন মো. আশফাকুস সামাদ তারই ধারাবাহিকতায় ৯ অক্টোবর ১৯৭১ সালে লে. হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন।

গভীর রাত। মুক্তিযোদ্ধারা নিঃশব্দে এগিয়ে যেতে থাকলেন। তাঁরা দুটি দলে বিভক্ত। একটি দলের নেতৃত্বে আবু মঈন মো. আশফাকুস সামাদ। তাঁদের লক্ষ্য পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্যাম্প। কিন্তু যাওয়ার পথে তাঁরা নিজেরাই পাকিস্তানি সেনাদের হাতে ধরা পড়ার মতো অবস্থা। আকস্মিক বিপর্যয়ে বিচলিত হলেন না তিনি। সাহসিকতার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করে বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করতে থাকলেন। কিন্তু বেশিক্ষণ পারলেন না। যুদ্ধে শহীদ হলেন তিনিসহ তাঁর অনেক সহযোদ্ধা। এ ঘটনা রায়গঞ্জে। ১৯৭১ সালের ১৯ অক্টোবর মধ্যরাতে। তখন ঘড়ির কাঁটা অনুসারে ২০ অক্টোবর।

রায়গঞ্জ কুড়িগ্রাম জেলার নাগেশ্বরী উপজেলার অন্তর্গত। উপজেলা সদর থেকে উত্তর দিকে। এই ঘটনার বিবরণ আছে মুসা সাদিকের লেখায়। তিনি লিখেছেন : ‘লে. সামাদ আর লে. আবদুল্লাহ ২৫ মাইল রেঞ্জের ওয়্যারলেস হাতে দুই গ্রুপ কমান্ডো নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন পাকিস্তানিদের শক্ত ঘাঁটি দখলের জন্য। সবার হাতে একটা করে স্টেন আর কিছু গ্রেনেড। রায়গঞ্জে অবস্থিত ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্টকে লক্ষ করে দুই গ্র“প দুই দিক থেকে যাত্রা করে। ‘জাঙ্গল শু পায়ে, চাদর গায়ে জড়িয়ে মুক্তিযোদ্ধারা রাত নয়টায় নিঃশব্দে বেরিয়ে পড়েন। সোয়া ঘণ্টা যাত্রার পর রায়গঞ্জ ব্রিজের সন্নিকটে পৌঁছে লে. সামাদ সহসা দেখলেন তাঁর গ্রুপের সবাই ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ট্র্যাপে পড়ে গেছেন। তিনি বুঝলেন ভুল রেকি হয়েছে। রায়গঞ্জ ব্রিজের নিচে ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের এলএমজি বাঙ্কার রয়েছে এ খবর তিনি পাননি। সংকেত দিয়ে তিনি সবাইকে শুয়ে পড়তে বললেন। শুরু হয়ে গেল ক্রস ফায়ারিং। সেই সঙ্গে পাকিস্তানি সেনারা তাদের ওপর আর্টিলারি ও ৩ ইঞ্চি মর্টার চালাতে লাগল।

বীর সামাদ বললেন, “কেউ এক ইঞ্চি পিছু হটবে না। মরলে সবাই মরব। বাঁচলে একসঙ্গেই বাঁচব।”

‘শুরু হয়ে গেল মুক্তিযোদ্ধাদের জীবন-মৃত্যুর লড়াই। অনেক শক্তিশালী ও দক্ষ এবং অনেক ভারী অস্ত্রে সজ্জিত ২৫ পাঞ্জাব বাহিনীর ঘেরাওয়ের মধ্যে পড়ে বাংলার তরুণ বীরেরা ফুলের মতো ঝরে পড়তে লাগলেন। কিন্তু কেউ সামাদের আদেশ অমান্য করেননি।
‘নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে থেকে মুহুর্মুহু মর্টার শেল ও বুলেটের মুখে মুক্তিযোদ্ধারা কেউ এতটুকু দমেননি। নিজের শেষ বুলেটটি শত্রুর প্রতি নিক্ষেপ করে নিজে শহীদ হয়েছেন। আমাদের ১৫-২০ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা সেদিন ২৫ পাঞ্জাবের বিরুদ্ধে যে অসম সাহস ও বীরত্ব নিয়ে লড়াই করেছে, পৃথিবীর যে কোনো বীরত্বব্যঞ্জক লড়াইয়ের সঙ্গে তার তুলনা হতে পারে। এ ঘটনা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সম্মুখযুদ্ধের এক অনন্য দলিল হয়ে জাতির সামনে থাকবে।’

আবু মঈন মোঃ আশফাকুস সামাদ ও অন্যান্য শহীদ মুক্তিযোদ্ধাকে পরে উদ্ধার করে সমাহিত করা হয় পার্শ্ববর্তী জয়মনিরহাট মসজিদের পাশে। তাঁদের সমাধি সংরক্ষিত।

আবু মঈন মোঃ আশফাকুস সামাদ ১৯৭১ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগে সম্মান শ্রেণীতে পড়তেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রতিরোধ যুদ্ধ শেষে ভারত যাওয়ার পর তিনি প্রথম বাংলাদেশ ওয়ার কোর্সে যোগ দেন। প্রশিক্ষণ শেষে ৬ নম্বর সেক্টরের সাহেবগঞ্জ সাবসেক্টরে যুদ্ধ করেন। তিনি একটি কোম্পানির নেতৃত্বে ছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধে অসাধারণ সাহস ও বীরত্বের জন্য শহীদ আবু মঈন মো.আশফাকুস সামাদকে মরণোত্তর বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত করা হয়। গেজেটে তাঁর নাম আবু মঈন মো. আশফাকুস সামাদ।

১৯৭১ সালে তাঁর বাবা-মা বসবাস করতেন ঢাকার ৭৯ নয়াপল্টনে। তিনি চিরকুমার ছিলেন। তাঁর বাবার নাম আ ম আজিমুস সামাদ, মা সাদেকা সামাদ।

 

0022

লেখক: সাইফুল হক মোল্লা দুলু, সাংবাদিক।

About the author

নরসুন্দা ডটকম

Leave a Comment