কিশোরগঞ্জের নিকলী উপজেলা সদরের বানিয়াহাটি গ্রামে মতিউর রহমান জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম কিনু মিয়া, মায়ের নাম হীরা বানু। স্ত্রীর নাম রাবেয়া রহমান। তিনি এক ছেলে ও এক মেয়ে সন্তানের জনক।
অকুতোভয় এই মুক্তিযুদ্ধা নিকলী গোড়াচাঁদ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ার সময় বাম রাজনীতির দীক্ষা নেন। সমাজের অর্থনৈতিক বৈষম্য ও সর্বক্ষেত্রে পাকিস্তানিদের দাপট তাকে ভাবিয়ে তোলে। নিকলী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাস করার পর তিনি ময়মনসিংহ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ভর্তি হন। শ্রেণিবৈষম্য ও পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে তিনি সবসময় সোচ্চার ছিলেন। ষাটের দশকের শেষ দিকের প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় থেকে জনগণকে সচেতন করার কাজটি দৃঢ়তার সাথে করে গেছেন। সুঠাম দেহের অধিকারী মতিউর রহমান একাত্তরের ২৬ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পরই তিনি সশস্ত্র যুদ্ধের জন্য নিকলীতে যুবকদের সংগঠিত করেন। পরে ভারতে প্রশিক্ষণের পর সুদেহী মতিউর রহমান একটি কোম্পানির কমান্ডার নিযুক্ত হন। তাঁর কোম্পানির নাম ছিল ‘কোবরা’। সাচনাবাজারের যুদ্ধ ছিল তাঁর প্রথম যুদ্ধ। সুনামগঞ্জ জেলার জামালগঞ্জ উপজেলার একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান সাচনাবাজার।
এরপর সুরমা নদী, তাহিরপুর উপজেলার কাউকান্দি বাজারে যুদ্ধ করেন। ১৯৭১ সালের ৮ আগস্ট সেখানে পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের বড় রকমের সংঘর্ষ হয়। সেখানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর শক্ত একটি ঘাঁটি ছিল। সেদিন মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানিদের ওই অবস্থানে আক্রমণ করেন। এই দলে মতিউর রহমানও ছিলেন। সহযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম ও আরেকজন যোদ্ধা বাংকারে গ্রেনেড চার্জ করেছিলেন। মতিউর রহমান বাংকারের মুখ বরাবর এলএমজির গুলি চালিয়ে তাঁদের কভার দিচ্ছিলেন। সেদিন এই যুদ্ধে সিরাজুল ইসলামসহ ছয়জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
মতিউর রহমান ১৯৭১ সালে ময়মনসিংহ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শেষ বর্ষের ছাত্র ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি নিজ এলাকায় গিয়ে ছাত্র-যুবকদের সংগঠিত করতে থাকেন। পরে তিনি ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ নেন। প্রশিক্ষণ শেষে তাঁকে ৫ নম্বর সেক্টরের অধীনে বড়ছড়া সাব সেক্টরে পাঠানো হয়। পরে তিনি কোবরা কোম্পানির যোদ্ধাদের নিয়ে ৩ নম্বর সেক্টরের অধীন কিশোরগঞ্জ এলাকায় আসেন। ২০ অক্টোবর কিশোরগঞ্জ জেলার নিকলী ও ৯ নভেম্বর করিমগঞ্জের ইটনায় তিনি যুদ্ধ করেন। ২৭ নভেম্বর তাঁর কোবরা কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধারা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে অষ্টগ্রাম মুক্ত করে কিশোরগঞ্জের ভাটি এলাকায় এক বিরাট মুক্তাঞ্চল গঠন করেন। গচিহাটাতেও তাঁর কোবরা কোম্পানি যুদ্ধ করে।
মুক্তিযুদ্ধে সাহসিকতা প্রদর্শনের জন্য গণবাহিনীর যোদ্ধা মতিউর রহমান স্বাধীনতার পর বীর বিক্রম খেতাব পান।
মৃত্যুর কিছুকাল আগে আলাপকালে তিনি বলেন, ‘১৯৭১ সালে অস্ত্র হাতে নিয়ে পাকিস্তানিদের হটিয়ে দেশমাতৃকাকে স্বাধীন করেছি। এখন সেই হাতে কৃষিকাজ করে এ দেশের মানুষের মুখে অন্ন জুগিয়ে খাদ্য নিরাপত্তায় ভূমিকা রাখছি। আমার জন্য এটিও এক যুদ্ধ।’
এই বীর যোদ্ধা হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ২০১২ সালের ৬ অক্টোবর মারা যান।
বন্ধুবৎসল ও অতিথিপরায়ণ এই বীরকে সর্বস্তরের মানুষ মনে রাখবে। জীবনের শেষ সময়ে তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। রাজনীতি করলেও তিনি সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে দল-মত নির্বিশেষে সবার জন্য ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতেন। বিশেষ করে সাধারণ মানুষের পাশে থাকতেন।
লেখক: সাইফুল হক মোল্লা দুলু, সাংবাদিক।