২৬ নভেম্বর ছিল পাক হানাদার বাহিনীর সঙ্গে কিশোরগঞ্জ এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের সরাসরি শেষ যুদ্ধ। এ যুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা খায়রুল জাহান বীর প্রতীক। একাত্তরে ২০ বছরের যুবক খায়রুল জাহান পড়াশোনা করতেন ময়মনসিংহ কারিগরি মহাবিদ্যালয়ে। পাকিস্তান বিমান বাহিনীর পরীক্ষায় মনোনীতও হয়েছিলেন। পশ্চিম পাকিস্তানে গিয়ে প্রশিক্ষণ নেবার জন্য চিঠি আসে মার্চ মাসের ২৭ তারিখে। কিন্তু তখন পাকিস্তান সেনাবাহিনী মেতে উঠেছে বাঙালি হত্যাযজ্ঞে। পাকিস্তান বিমান বাহিনীর অফিসার হওয়ার চেয়ে যুদ্ধ করে মাতৃভূমিকে মুক্ত করা সঠিক মনে করলেন খায়রুল জাহান।
কিশোরগঞ্জের মুক্তিকামী তরুণ-যুবকদের সংগঠিত করতে খায়রুল জাহান বাড়ি থেকে বের হয়ে পড়েন জুন মাসের ৭ তারিখ। ভারতের মেঘালয়ে সামরিক প্রশিক্ষণ নিয়ে মেজর খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে ২ নম্বর সেক্টরের গ্রুপ কমান্ডার হিসেবে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে একাধিক সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নেন। নভেম্বরে তাঁর বিশ্বস্ত ও সাহসী কয়েকজন সহযোদ্ধাদের নিয়ে চলে আসেন গ্রামের বাড়ি লতিবপুরে। এসেই মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কিশোরগঞ্জ শহরে অপারেশন চালানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করেন ।
পরিকল্পনা অনুযায়ী ২৬ নভেম্বর সকালে তাঁরা শহরের উপকণ্ঠে রাজাকারদের একটি ক্যাম্প দখল করার সিদ্ধান্ত নেন। চরপুমদী বাজার থেকে এক রাজাকার শহরের ডাকবাংলায় আর্মি ক্যাম্পে এ খবর পৌঁছে দেয়। খবর পেয়ে শত শত পাক আর্মি আর রাজাকাররা মিলে ঘিরে ফেলে প্যারাভাঙ্গায় অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের ছোট দলটিকে। ভোরবেলায় তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়। বিপুলসংখ্যক শত্রুবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে জয়ের সম্ভাবনা নেই বুঝে খায়রুল মুক্তিযোদ্ধা দলটিকে রক্ষা করার জন্য শত্রুদের ঠেকিয়ে রাখার লক্ষ্যে মেশিনগান দিয়ে গুলি করতে থাকেন এবং সহযোদ্ধাদের সরে পড়ার সুযোগ করে দেন।
তাঁর এই অসীম সাহসিকতা ও আত্মত্যাগে মুক্তিযোদ্ধাদের দলটি সেদিন রক্ষা পায়। কিন্তু পাক হানাদার আর রাজাকারদের বৃষ্টির মতো নিক্ষিপ্ত মেশিনগানের গুলিতে এই বীর মুক্তিযোদ্ধা গুরুতর আহত হন। রাজাকারদের হাতে ধরা পড়ার পূর্ব মুহূর্তে গ্রেনেড চার্জ করে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন।
এতে ক্ষান্ত হয়নি নরপিচাশের দল। তারা ছুটে এসে শকুনের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল খায়রুলের লাশের ওপর। বেয়নেটের খোঁচায় খোঁচায় দেহটা ক্ষত-বিক্ষত হলো। তারপরও আক্রোশ মিটল না। মৃতদেহ রিকশায় করে পায়ের তলায় চেপে সেদিন সারা শহর ঘুরিয়েছিল।
পরে রাজাকার-আলবদররা খায়রুল জাহান বীর প্রতীকের শহরের শোলাকিয়ার বাসায় গিয়ে বলে, ‘তোর ছেলেকে আমরা জবাই করে এসেছি! কী, বিশ্বাস হচ্ছে না? এই দেখ খায়রুলের রক্ত! এবার বিশ্বাস হচ্ছে তো! দে, এবার ঘরে কোথায় কী আছে, বের করে দে! নইলে..’
একাত্তরের ওই দিন বিকেলে তালুকদার লজে দাঁড়িয়ে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা স্কট কমান্ডার খায়রুল জাহানের মাকে কথাগুলো বলছিল স্থানীয় রাজাকার প্রধান ও তৎকালীন কিশোরগঞ্জের কিং-হোছন। নরপশুদের মুখে পুত্রের মৃত্যু সংবাদ ও সদ্য শহীদ ছেলের রক্ত দেখে সেদিন মায়ের হৃদয় আরো পাষাণ হয়ে গিয়েছিল। বিস্ময়-বেদনা আর ঘটনার আকস্মিকতায় তিনি বোবা হয়ে গিয়েছিলেন। বোবা দৃষ্টিতে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে দেখছিলেন নরপশুর জামা-কাপড়ে তাঁরই আদরের দুলাল খায়রুলের ছোপ ছোপ রক্ত।
স্বাধীনতার পর খায়রুল জাহান মরণোত্তর বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত হন। তাঁর স্মরণে রণাঙ্গনস্থলে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়েছে। ময়মনসিংহ কারিগরি মহাবিদ্যালয়ের একটি ছাত্রাবাসের নামকরণ করা হয়েছে ‘শহীদ খায়রুল ছাত্রাবাস’ নামে।
প্রতি বছর খায়রুল জাহান বীর প্রতীকের শাহাদাত বার্ষিকীতে কিশোরগঞ্জে শহীদ খায়রুল স্মৃতি সংসদ ও পরিবারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়ে আসছে।
বীর প্রতীক খায়রুল জাহানের বাবার নাম আবদুল হাই তালুকদার, তিনি ২০০০ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি মারা যান। মা বেগম শামসুন্নাহার বড় ছেলেকে হারানোর শোক কখনো ভুলতে না পেরে ১৯৯৭ সালের ২২ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন। তাদের ভাই-বোনদের মধ্যে কামরুন্নাহার বেগম ও লুৎফুন্নাহার গৃহিণী। ভাই তাওয়াজ্জল জাহান কাজল যুক্তরাষ্ট্রের লস এঞ্জেলসে প্রবাসী জীবনযাপন করছেন। সেখানে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে যুক্ত রয়েছেন। অপর ভাই সাদেকুজ্জামান নয়ন ও ফখরুজ্জাহান লেনিন কিশোরগঞ্জ শহরের শোলাকিয়ার বাসায় বসবাস করছেন। তাদের গ্রামের বাড়ি সদর উপজেলার লতিবপুরে।
লেখক: সাইফুল হক মোল্লা দুলু, সাংবাদিক।