ফিচার

কোথায় গেল কবিগুরুর শিক্ষাদর্শে গড়ে ওঠা বিশ্বভারতীর সেই অনন্যতার প্রতিশ্রুতি?

নরসুন্দা ডটকম   ডিসেম্বর ২৩, ২০১৭

ব্রহ্মচর্য বিদ্যালয় থেকে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে ওঠার পেছনে অনেক ইতিহাস জড়িয়ে৷ জড়িয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো নামও৷ শতবর্ষের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে বিশ্বভারতী কি শুধু সেই নামের ওজনই বহন করছে? তারই অনুসন্ধান করল ডয়চে ভেলে৷

এখন শান্তিনিকেতনে ঢুকে পড়েছে শহর৷ ছায়াঘেরা বনবীথিতে পড়েছে ভোগবাদের ছায়া৷ বিশ্বভারতী প্রাঙ্গণ তো এখন রীতিমতো পর্যটন কেন্দ্র৷ পর্যটকদের ইতিউতি উঁকিঝুঁকি পাঠভবনের গাছের তলার ক্লাসে পড়ুয়াদের মনোসংযোগে ব্যাঘাত ঘটায়৷ সে জন্য নানা জায়গায় দেওয়াল তুলতে হচ্ছে৷ হুজুগে আসা পর্যটকদের ভিড় বিশ্বভারতী প্রাঙ্গণের পবিত্রতা নষ্ট করেছে৷ গাড়ির ছুটোছুটি, সেল্ফির হিড়িক, প্লাস্টিকের বোতল, হকারের সঙ্গে দরাদরি — সব মিলিয়ে জায়গাটা উইকএন্ডের ছোট্ট ছুটির আদর্শ স্থান হয়ে দাঁড়িয়েছে৷

এভাবেই বদলে গিয়েছে বিশ্বভারতী৷ পরীক্ষামূলকভাবে ১৯০১ সালে গুটিকয় হাতে গোনা ছাত্র নিয়ে কবিগুরু যে যাত্রা শুরু করেছিলেন, সেখানে শিক্ষার শুদ্ধতাই ছিল সবকিছুর ঊর্ধ্বে৷ পুঁথিগত বিদ্যা আয়ত্ত করিয়ে ‘তোতাকাহিনি’-র তোতা তৈরির কারখানা তিনি চাননি বলেই সেই জ্ঞানের বদলে চেয়েছিলেন অন্তরের শিক্ষা৷ কিন্তু সময় বদলের সঙ্গে সঙ্গে ফলসর্বস্ব সমাজের তাড়নায় বিশ্বভারতীতেও এসে পড়েছে ডিগ্রি আর পরীক্ষার ঢেউ৷ ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কও আর সেই জায়গায় নেই৷ কোথায় গেল কবিগুরুর শিক্ষাদর্শে গড়ে ওঠা বিশ্বভারতীর সেই অনন্যতার প্রতিশ্রুতি? কী বলছেন শিক্ষাবিদরা?

এর জবাব খুঁজতে ডয়চে ভেলে পৌঁছে গিয়েছিল পাঠভবনের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সুপ্রিয় ঠাকুরের কাছে৷ শান্তিনিকেতনেই কর্মজীবন অতিবাহিত করার পর সেখানেই কাটাচ্ছেন অবসর জীবন৷ গত কয়েক দশকে তাঁর চোখের সামনেই আস্তে আস্তে বদলে গিয়েছে রবি ঠাকুরের ব্রহ্মচর্য আশ্রম৷ সুপ্রিয় ঠাকুর অকপটে বললেন, ‘‘রবীন্দ্রনাথের দেখানো পথে বিশ্বভারতী এগোতে পারেনি৷ এখন শান্তিনিকেতন একটা শহর হয়ে উঠেছে৷ তার দোষগুণ সবই গ্রাস করেছে আশ্রমকে৷”

কোনো কোনো দিক থেকে নগর সভতার ছোঁয়া দূষিত করেছে বিশ্বভারতীকে? রবীন্দ্রনাথ তো চেয়েছিলেন শিক্ষা নিছক তথ্য আহরণে সীমাবদ্ধ হয়ে না থাকুক, এটা প্রকৃতির সান্নিধ্যে জীবনের অনাবিল আনন্দের পথপ্রদর্শক হয়ে উঠুক৷ এক্ষেত্রে আশ্রম বিদ্যালয়ের পরিবেশের একটা বড় ভূমিকা ছিল৷ সেই পরিবেশ সময়ের নিয়মেই অনেকটা বদলে গেছে৷ সুপ্রিয় ঠাকুরের ভাষায়, ‘‘এখন পড়াশোনা, পরীক্ষা, ফল নিয়েই যাবতীয় আগ্রহ৷ বিশ্বভারতী মানে ছিল একটা ভিন্ন জীবনচর্যা৷ একটা আলাদা জীবনবোধ তৈরির কেন্দ্র৷ অর্থাৎ শিক্ষা শুধু জ্ঞান জোগায় না, ব্যক্তিত্ব তৈরি করে৷ সেই বোধের জায়গায় ভাটা পড়েছে৷ সেই অর্থে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে এখানকার ছেলে-মেয়েদের কোনো পার্থক্য নেই৷ সবাই এখানে আসছে একটা ডিগ্রি পেতে৷”

আরো পড়ুন……

অপারেশন থিয়েটারে বসে সন্তানের জন্ম দেওয়ার আগে পরীক্ষা দিতে ব্যস্ত তিনি !

শান্তিনিকেতনে শ্যামবাটির বাসিন্দা শ্রীকুমার দীক্ষিত প্রাক্তনী হিসেবে বিশ্বভারতীর এই অবক্ষয় দেখে সত্যিই খুব দুঃখিত৷ তাঁরও মতে, প্রথামাফিক পড়াশুনো আর পরীক্ষার বিধিবদ্ধ বেড়াজালে জর্জরিত বিশ্বভারতী এখন আর পাঁচটা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতোই৷ তাছাড়া আশ্রমজীবন পরিণত হয়েছে নাগরিক জীবনে৷ ছাত্র-শিক্ষকের সেই সম্পর্কও এখন আর আগের জায়গায় নেই৷

শান্তিদেব ঘোষের স্নেহধন্য বিশ্বভারতীর এই প্রাক্তনীর অভিযোগ যে অমূলক নয়, তার ব্যাখ্যা মিলেছে সুপ্রিয় ঠাকুরের বক্তব্যে৷ তাঁর কথায়, ‘‘রবীন্দ্রনাথ যেভাবে বিশ্বভারতীকে দেখতে চেয়েছেন, তার প্রতিফলন আজকের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নেই৷ এখানে জ্ঞানচর্চার সঙ্গে সংস্কৃতির একটা নিবিড় যোগ ছিল৷ সেই যোগ আস্তে আস্তে কমে আসছে৷ এখনও প্রতি বছর বিশ্বভারতীর নিজস্ব অনুষ্ঠান হয়৷ কিন্তু তার সঙ্গে ছাত্রছাত্রীদের প্রাণের যোগ কমে গেছে৷”

বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়

রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাদর্শ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ক্ষিতিমোহন সেন, হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, জগদানন্দ রায়, নন্দলাল বসু প্রমুখরা শান্তিনিকেতনে শিক্ষকতা করেছেন৷ সেই বিশ্বভারতীর বর্তমান চিত্রকে এতটা হতাশাজনক হিসেবে দেখছেন না বাংলা বিভাগের শিক্ষক বিশ্বজিৎ রায়৷ তিনি বলেন, ‘‘অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যে বিশ্বভারতীর বিরাট কোনো ফারাক আজ আছে, তা বলব না৷ তবুও বিশ্বভারতীর স্বাতন্ত্র্য কিছুটা হলেও এখনও অটুট আছে৷ বিশেষত কলাভবন, সংগীতভবনে সেটা বুঝতে পারা যায়৷ সেখানে অতীতের ধারা অনেকটাই অক্ষুণ্ণ রয়েছে৷ ভাষাভবন, বিদ্যাভবনের ক্ষেত্রে বলতে পারি, অনেক শিক্ষক এখনও বিশ্বভারতীর পরম্পরা আত্মস্থ করে সেই অনুযায়ী এখানে কাজ করেন৷”

শান্তিনিকেতনের পথে ট্রাফিক, দূষণের এই ভিড়েই চোখে পড়ে বনবীথির পড়ুয়ারা মোবাইল মাধ্যমে সংগীতে মত্ত অথবা বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে উন্মুখ৷ এই ছবিতে কলকাতা বা শহরতলির আর পাঁচটা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে খুব একটা ফারাক মোটেই পাওয়া যাবে না৷ ফেসবুক-হোয়াটসঅ্যাপ দিয়ে বহির্দুনিয়ায় যোগাযোগ রাখা আজকাল সামাজিক মাধ্যম বলেই স্বীকৃত৷ কিন্তু এর অনেক আগেই ‘দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে, যাবে না ফিরে — এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে’-র কবি এই শিক্ষাঙ্গেন প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের মেলবন্ধন ঘটাতে চেয়েছিলেন৷ রবীন্দ্রনাথের আহ্বান ও আকর্ষণেই দেশ-বিদেশের কত পণ্ডিত বিশ্বভারতীতে এসেছেন৷ বিশ্বভারতীর রূপকার হিসেবে তিনি যা চেয়েছিলেন, সেটা কি আর বজায় রাখা সম্ভব হচ্ছে?

এই প্রশ্নে প্রাক্তনীদের একাংশের বক্তব্য, সেই ধারা অনুসরণ করা হলে এই সময়ের সঙ্গে পড়ুয়ারা তাল মেলাতে পারবে না৷ সে জন্যই বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ পরিবর্তন আনছেন৷ ডিগ্রি দেওয়া হচ্ছে, যে ডিগ্রির টানে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আসছেন পড়ুয়ারা৷

ছাত্র-শি্ক্ষক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিশ্বভারতী যে মহতী উত্তরাধিকার পেয়েছে, তা পুরোপুরি বিলীন হয়ে গেছে বলে মনে করেন না বিশ্বজিৎ৷ তাঁর ভাষায়, ‘‘যাদবপুর থেকে বিশ্বভারতীতে এসে বুঝেছি এখানে একটা আলাদা পরম্পরা বহমান৷ যে কোনো শিক্ষকই সেটা অনুসরণ করতে পারেন৷ সেই অনুযায়ী ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক গড়ে তোলা যায়৷ বোলপুরের গ্রামীণ এলাকা থেকে আসা পড়ুয়ারা কিন্তু শহরের মধ্যবিত্ত বা উত্ত মধ্যবিত্ত পরিবারের পড়ুয়াদের মতো নয়, তাদের মধ্যে শিক্ষকের প্রতি একটা আলাদা দৃষ্টিভঙ্গি থাকে৷” কিন্তু কত জন শিক্ষক শিক্ষাসত্রের পরম্পরা অনুসরণ করেন? কতজনই বা বিশ্বভারতীর অধ্যাপনাকে আর পাঁচটা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চাকরির থেকে আলাদা বলে অনুভব করেন? সুপ্রিয় ঠাকুরের দাবিতে কার্যত সীলমোহর লাগিয়ে বিশ্বজিৎ রায় বলেন, ‘‘১০-১৫ শতাংশ শিক্ষক অবশ্যই এখনও বিশ্বভারতীর ঐতিহ্য অনুযায়ী কাজ করার চেষ্টা করেন৷”

About the author

নরসুন্দা ডটকম