এমনটা কী কখনও শুনেছেন কেউ? হোটেলে রান্না করা সুস্বাদু খাবার খাচ্ছেন, কিন্ত তার জন্য দিতে হবে না কোনও টাকা! শুনতে কেমন অবিশ্বাস্য শোনাচ্ছে তাই না? আশ্চর্যজনক হলেও সত্য প্রতিদিন একেবারেই বিনামুল্যে শত শত মানুষ খেয়ে যাচ্ছে এই হোটেলে।
এই ব্যতিক্রমী হোটেলটির নাম আকবরিয়া গ্র্যান্ড হোটেল এন্ড রেস্টুরেন্ট। বগুড়া শহরের কবি কাজী নজরুল ইসলাম সড়কে কোতোয়ালী থানার দক্ষিন পাশে বগুড়া নিউ মার্কেটের মেইন গেট এর বিপরিতে এ হোটেল অবস্থিত। হোটেল কর্তৃপক্ষ গত ৯৭ বছর ধরে শহরের ভিক্ষুক, গরিব, ভাসমান, ছিন্নমূল ও অভাবী মানুষকে বিনামূল্যে খাবার বিতরণ করে আসছে। প্রতিদিন রাত ১১টা থেকে ১২টার মধ্যে শহরে অবস্থানরত নাম–পরিচয়হীন এ মানুষদের এক বেলা ভাল মানের খাবারের ব্যবস্থা করে থাকে হোটেল কর্তৃপক্ষ। বিনিময়ে কোনও প্রকারের শ্রম বা দাম নেয়া হয় না। হোটেলে সারা দিনের কোনো বাসি–পচা বা উচ্ছিষ্ট খাবার নয়, একেবারে আলাদা রান্না করে খাবার বিতরণ করা হয়। এ খাবারের জন্য প্রতিদিন শহরের অভাবী মানুষের ভিড় লেগে থাকে হোটেলে।
আকবরিয়া গ্র্যান্ড হোটেলের প্রতিষ্ঠাতা মরহুম আকবর আলী মিঞা তৎকালীন অবিভক্ত ভারতের মুর্শিদাবাদ জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। ভাগ্য অন্বেষণে সপরিবারে বাংলাদেশে আসার পর আকবর আলী মিঞা প্রথমে ভাইয়ের সাথে মেকানিকের কাজ শুরু করলেও এক পর্যায়ে নিজের তৈরি মিষ্টি ফেরি করে বিক্রি শুরু করেন। মিষ্টি বিক্রির কিছু পুঁজি নিয়ে বর্তমান বগুড়া শহরের চক যাদু রোডের মুখে মাসিক ৮ টাকা ভাড়ায় হোটেল ব্যবসা শুরু করেন। খুব দ্রুত হোটেলের নাম–ডাক ছড়িয়ে যায়।
চল্লিশ থেকে ষাটের দশক পর্যন্ত তিনি তার হোটেলে মাসিক ১৫–২০ টাকায় তিন বেলা খাবারের ব্যবস্থা করে দিতেন। সে সময় ঘি দিয়ে রান্না করা বিরিয়ানির দাম ছিল ১ টাকা প্লেট। ব্রিটিশ আমলে শহরে বিদ্যুৎ না থাকলেও তিনি নিজস্ব জেনারেটরে বিদ্যুতের ব্যবস্থা করেছিলেন। এসব কারণে হোটেলটির নাম–ডাক ছড়িয়ে পড়ে। ধর্মভীরু মানুষ আকবর আলী আয়ের একটা অংশ দিয়ে প্রতিদিন রাতে ফকির–মিসকিনদের খাওয়াতেন। তিনি সেটা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত করে গিয়েছেন।
১৯৭৫ সালে তিনি মৃত্যুর আগে তার ছেলেদের হোটেলের আয় থেকে ফকির, মিসকিন, গরিবদের খাওয়ানোর নির্দেশ দিয়ে যান। সে কথার এতটুকু নড়চড় হয়নি আজও। পিতার শুরু করা নিয়ম মেনে তার ছেলেরা আজ পর্যন্ত তা পালন করে যাচ্ছেন। আকবরিয়া গ্র্যান্ড হোটেলের এখন শহরেই চারটি শাখা। এসব শাখায় সংযোজন করা হয়েছে—আবাসিক, বেকারি, চাইনিজ, থাই ও ফাস্টফুড, লাচ্ছা–সেমাই, দই ইত্যাদি। কর্মচারী রয়েছেন সহস্রাধিক। আকবর আলীর সেই লাচ্ছা–সেমাই এখন বিদেশের বাজারেও রপ্তানি হয়।
প্রায় শত বছর ধরে মানুষের কল্যাণে নিরলস কাজ করে যাওয়া আকবরিয়া হোটেল আরও সমৃদ্ধ হোক, অভাবী দুস্থ মানুষেরা অন্তত এক বেলা শান্তিমতো পেট ভরে খেতে পাক আকবরিয়া হোটেলের মানবপ্রেমী মালিক পক্ষের মমতায়। মানবতার উৎকৃষ্ট উদাহরণ এর চেয়ে বেশি আর কি হতে পারে। অসহায় ছিন্নমূল মানুষের আশ্রয়স্থল আকবরিয়া হোটেল চিরজীবি হোক।