মিসরকে এক সময় বলা হত মধ্যপ্রাচ্যের হলিউড। দেশটিতে এমনকি সত্তরের দশকে নির্মিত সাদাকালো সিনেমাতেও সমাজ এবং মানব সম্পর্কের উপস্থাপন অনেক প্রগতিশীল ছিল। কিন্তু দেশটির এখনকার অনেক চলচ্চিত্র নির্মাতারা বলছেন সিনেমায় প্রেমের দৃশ্য দেখানোর সময় অনেক নিয়ম মেনে করতে হয়। এক সময় পর্দায় যা দেখানো হত স্বাভাবিকভাবে, আজ তা নিয়েই উঠছে নানা বিতর্ক। যেমন ১৯৭১ সালে নির্মিত মাই ওয়াইফ অ্যান্ড দ্য ডগ সিনেমায় প্রেমের সিকোয়েন্সে নায়ক-নায়িকাকে বেশ ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখা যায়। কিন্তু আজ সেটা প্রায় অসম্ভব।
হানা খলিল, মিসরের একজন নামী চলচ্চিত্র নির্মাতা। বাস্তব-ধর্মী সিনেমা নির্মাণের জন্য বেশ সমাদৃত। সেন্সরশিপের কারণে মিশরের আরও অনেক পরিচালকের মত তাকেও সিনেমা থেকে প্রেমের দৃশ্য বাদ দিতে হয়েছে। তিনি বলেন, তার দ্বিতীয় চলচ্চিত্রে, তিনি একটি প্রেমের দৃশ্য লিখেছিলেন। কিন্তু সেটা নিয়ে সমস্যা হয়েছিল। “আমি তখন জানতে পারি যে, কাহিনী বর্ণনায় প্রেমের দৃশ্যকে আমার অত গুরুত্ব দেয়া উচিত হয়নি। কারণ দেখা যাবে, সেন্সরবোর্ড তাতে আপত্তি করবে, আর সেটা মেনে ঐ নির্দিষ্ট দৃশ্য কেটে ফেললে পরে গল্পের গতি নষ্ট হয়ে যাবে।”
হানা বলছেন, মিশরের সমাজ এখনকার চাইতে আগে অনেক মুক্তমনা ছিল। নারীপুরুষ নিয়ে সমাজের যেকোনো ক্ষেত্রে আলোচনা স্বাভাবিক ছিল। এনিয়ে সাহিত্য, চিত্রকর্ম যেমন ছিল, তেমনি সিনেমা বা নাটকেও এর উপস্থাপন ছিল সহজ আর স্বাভাবিক। এখন সে চরিত্র একেবারেই বদলে গেছে। “মিশরীয়দের কাছে, জীবন এবং প্রেম অনেক বড় একটি ব্যপার ছিল। বাস্তবের টানাপড়েন নিয়ে এই সমাজ লজ্জিত ছিল না। যৌনতা যেমন জীবনের অংশ, তেমনি সিনেমারও অংশ ছিল।” ১৯৬০ এর দশকে মিশরীয় চলচ্চিত্র যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় নির্মাতাদের দ্বারা অনেক প্রভাবিত ছিল। ফলে স্বাভাবিকভাবেই সিনেমায় নারী-পুরুষ সম্পর্কের উপস্থাপনও ছিল উদার এবং মানবিক।
কিন্তু ১৯৭০ এর দশকে দেশটির অনেক নির্মাতা অর্থের খোঁজে মধ্যপ্রাচ্যের বাজার ধরার জন্য, সেখানকার মানুষের রুচি ও চাহিদা অনুযায়ী সিনেমা বানাতে শুরু করেন। ফলে পাশ্চাত্যের উদার সংস্কৃতির বদলে, সেখানে তাদের সিনেমায় প্রাচ্যের রক্ষণশীলতাই বেশি ফুটে উঠে। কিন্তু এখন এ ধারার ছাপ পড়েছে মিশরীয় চলচ্চিত্রে। “আগে হিজাব পড়া বা নারীদের সাথে হাত মেলানো নিয়ে কোন প্রশ্ন ওঠেনি। এখন গালফ দেশগুলোতে আমাদের সিনেমার ব্যপারে বলা হয় যেন আমরা পরিচ্ছন্ন সিনেমা বানাই। ক্যামেরার সামনে চুম্বন বা ‘হট’ সিন থাকবে না। গল্পের উপস্থাপনের নৈতিক এবং ধর্মীয় ব্যপার মাথায় রাখার কথা বলা হয়। কিন্তু শিল্পমানের কথা বলা হয় না।”
আর দেশটির সমাজের এই চরিত্রগত পরিবর্তন সাম্প্রতিক সময়ে আরো বেড়েছে। আরব বসন্তের পরে রাজনীতিসহ দেশটির নানা ক্ষেত্রে যে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে বলে ধারণা করা হয়েছিল, তা হয়নি। বরং দেশটিতে ইসলামপন্থীদের উত্থানের ফলাফল ভোগ করতে হচ্ছে এখন সিনেমা সংশ্লিষ্টদেরও, এমনটাই মনে করেন হানা। তিনি বলছেন, তার প্রজন্মের প্রায় সব নির্মাতাকে এখন এই সরকারী খবরদারীর শিকার হতে হচ্ছে। সেন্সরবোর্ডের আপত্তি থাকলে দৃশ্য কেটে ফেলার ঘটনা যেমন প্রায়ই ঘটে, তেমনি পরিচালকদের ব্যক্তিগতভাবে জবাবদিহিতাও করতে হয়।