গত শতকের শেষ দশক। সারা বাংলাদেশ রুখে দাড়িয়েছে যুদ্ধপরাধীদের বিচারের দাবিতে। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আন্দোলন দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ছে। সেই সময়েই তিনি পাবনায় এলেন। সাথে অনান্য নেতারা। জনসভা হলো অন্নদাগোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরির সামনে বিশাল মন্চে। আমার দেখা পাবনার সবচেয়ে বড় জমায়েত ছিলো সেটি। জনসভা শেষ হলো- তিনি সহ সবাই আমাদের বাড়ীতে এলেন।
মা একদিকে তখন সাংস্কৃতিক জোট আর মহিলা পরিষদের মূল দায়িত্বের কারনে ব্যাস্ত- অন্যদিকে পাবনায় এমন ধরনের আয়োজন শেষে অতিথিরা প্রসাদ রায়ের বাড়ীতে খাবেন এমনটাই রীতি। মা দুদিনের দ্রুত প্রস্তুতিতে অনেকগুলো পদ রান্না করেছিলেন।
জননেতা আব্দুর রাজ্জাক, সৈয়দ হাসান ইমাম, অধ্যাপক আব্দুল মান্নান সহ তিনি খেতে বসলেন। তার অসুস্থতার কথা সবার জানা- সে কারনেই তার জন্য আলাদা করে কম মসলা দেয়া পাবদা মাছ আর মুরগী। সেই আলাদা আয়োজন দেখে তিনি হাসলেন- বললেন, মীরা বৌদি আজ আমি সবগুলো খাবার একটু একটু করে হলেও খাব। পরম তৃপ্তির সাথে খেয়ে উঠলেন। শরীরে ক্যানসারের বসতি, তবু সেই রাতেই রওনা হলেন আরেক জনপদের দিকে।
তারপর ঢাকাতে বহু মিছিলে তার পেছনে হেঁটেছি। কাজ করতাম আজকের কাগজে। এসাইনমেন্ট কাভার করা মানে দূরে দাড়িয়ে নোট নেয়া না, শহীদুজ্জামান ভাই মূল স্টোরি কাভার করতেন, আমরা সাইড স্টোরি।
এর মধ্যেই তার শরীরের অবনতি হতে থাকলো- সেই সময়েই একদিন শহীদ মিনারে মোম প্রজ্বলনের একটা কর্মসূচি ছিলো। তার কাছে থেকে কয়েকহাত দূরে আমি। হঠাৎ তিনি ডাক দিলেন- এলাম সামনে। আমার হাতের মোমটি তখনও জ্বালানো হয়নি। তিনি নিজের হাতের মোমটি এগিয়ে দিলেন। বললেন- এটা নাও। নিলাম। আমার হাত কাঁপছে। শহীদজননী জাহানরা ইমামের হাতের আগুন আমার হাতে- আমি কাঁপছি। এক প্রথম তারুন্যের ঘোরে তাকিয়ে আছি আম্মার মুখের দিকে। তিনি হাসলেন। হাতটা বাড়িয়ে স্পর্শ করলেন আমাকে। বললেন- দেখো এই দেশে রাজাকারদের বিচার হবেই।
অনেক বছর চলে গিয়েছে- আম্মা চলে গিয়েছেন। আমরা সন্তানরা আছি- আমরা দেখেছি ইতিহাসের দায় শোধের ইতিহাস। শহীদজননী যে দাবিতে শরীরে ক্যানসার নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন বাংলাদেশে সেই দাবী বাস্তবায়ন হয়েছে। মহাজোট সরকার নির্বাচনী ইশতেহারে যুদ্ধপরাধের বিচারের কথা বলেছিলো- সেই প্রতিশ্রুতি তারা রক্ষা করেছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলমান। এর মধ্যেই সর্বোচ্চ বিচার শেষে ম্যানিলা রোপ স্পর্শ করেছে যুদ্ধপরাধীদের গলা। যে গলাতে তারা বলতো- ‘একাত্তরে তারা ভুল করেনি, বাংলাদেশে কোনও যুদ্ধপরাধী নাই।’ সেই ঐধত্যের বিচার হয়েছে- হচ্ছে।
সেই বিচারের পথ মসৃন ছিলো না। এই এক পক্ষের দুনিয়ার অনেক ক্ষমতাধর যুদ্ধপরাধীদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন- দন্ড কার্যকর করার সময়েও ক্ষমতাধরদের ফোন এসেছে এই মানবতা বিরোধীদের রক্ষার জন্য- নিজ অবস্থান থেকে একটুও নড়েননি সেই ফোনে শেখ হাসিনা। যার পথে পথে গ্রেনেড বিছানো- তার তোয়াক্কা কিসের ঐসব মোড়লদের? তিনি অনড় ছিলেন- অনড় ছিলো বিচার ব্যাবস্থা, সেই কারনেই আমাদের প্রজন্ম একটি ইতিহাসের স্বাক্ষী হতে পেরেছি।
আমরা মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি, ৭৫ পরবর্তী সময়ে ঘাতক দালাল আর তাদের ছানাপোনাদের ঐধত্য দেখেছি। নিজে হাতে সহযোদ্ধার লাশের শেষকৃত্য করেছি। সহযোদ্ধার রগকাটা শরীরের ফিনকি দেয়া রক্ত দেখেছি। নিজামী আর মুজাহিদের গাড়িতে লাল সবুজ পতাকা দেখে অপমানিত হয়েছি। ভাবিনি- এই মাটিতে তাদের বিচার ও দন্ড কার্যকর হতে দেখবো!
কিন্তু সেই আশা পূর্ণ হয়েছে। দেখেছি উদ্ধতদের চুড়ান্ত পরিনতি। দেখেছি- ইতিহাস কিভাবে যার যা প্রাপ্য সেটা তাকে বুঝিয়ে দেয়। সেই দিক দিয়ে অবশ্যই আমরা ভাগ্যবান- ইতিহাসের শোধবোধের ঘটনা দেখাটা অবশ্যই আমাদের প্রজন্মের শ্রেষ্ঠ ঘটনা। আর সেই ঘটনার ক্রেডিট অবশ্যই শেখ হাসিনার সরকারের। অভিনন্দন জানাই বঙ্গবন্ধুর সন্তানের প্রতি আমাদের প্রজন্মের পক্ষ থেকে।
ইতিহাস নির্মোহ- ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করেনা- সেই সত্যিটা দেখার জন্যই হয়তো বেঁচেছিলাম- একটা স্বপ্ন নিয়েই বেঁচে আছি। থাকতে চাই শেষ দেখা পর্যন্ত। খুব তো বেশি নয় চাওয়া। এমন একটা বাংলাদেশ দেখতে চাই- যেখানে সরকার এবং বিরোধীদলে থাকবেন মুক্তিযুদ্ধকে ধারণ করা রাজনৈতিক দল। এদেশে রাজনীতি করার অধিকার থাকবে না তাদের- যারা বাংলাদেশের জন্মের বিরোধিতা করেছে। যারা গণহত্যার সহায়তা করেছে আমার আপনার স্বজনদের। এটা কি খুব বড় চাওয়া? আমাদের বেঁচে থাকাটাও তো এই একটা স্বপ্ন নিয়ে।
আমি আরো লাখো সম্তানের মতোই তাকে আম্মা ডাকতাম। আজ তার জন্মদিন- শুভ জন্মদিন আম্মা জাহানারা ইমাম। আমরা এখনও জেগে আছি।
সূত্র: অঞ্জন রায় এর ফেসবুক ওয়াল থেকে।