লিঙ্গ পরিচয়ের ভিত্তিতে মানবজাতি প্রধানত নারী ও পুরুষ- এই দুই শ্রেণিতে বিভক্ত। আর যেসব মানুষের লিঙ্গ পরিচয় সুনির্দিষ্টভাবে শনাক্ত করা যায় না, অর্থাৎ যাদের জনন অঙ্গ ও অপরাপর বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে সম্পূর্ণ পুরুষ বা নারী হিসেবে চিহ্নিত করা যায় না, তারাই বাংলাদেশের সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ নামে অভিহিত।
মানব সন্তানের জন্মের সূচনালগ্নে ক্রোমোজমজনিত ত্রুটির কারণে ভূমিষ্ঠ শিশুর মধ্যে লিঙ্গ-প্রজনন ইন্দ্রিয় সংক্রান্ত সমস্যা পরিলক্ষিত হয়। প্রকৃতপক্ষে অন্যান্য শারীরিক প্রতিবন্ধিত্বের শিকার শিশুর মতো তৃতীয় লিঙ্গ শিশুরাও এক ধরনের প্রতিবন্ধী।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় অন্যান্য প্রতিবন্ধী মানুষের প্রতি সমব্যথী দৃষ্টিভঙ্গি বিদ্যমান থাকলেও তৃতীয় লিঙ্গদের বেলায় তার উল্টো চিত্র পরিলক্ষিত হয়। তৃতীয় লিঙ্গ শিশুদের তাদের বাবা-মায়ের পাপের ফসল হিসেবে গণ্য করার মতো বহুবিধ মারাত্মক কুসংস্কারে আচ্ছন্ন আমাদের সমাজ ব্যবস্থা।
ফলে রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের শিক্ষা গ্রহণের আইনি সুবিধা বিদ্যমান থাকলেও সমাজের সামগ্রিক নেতিবাচক আচরণের তীব্রতা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। সামাজিক অনুষ্ঠানে তৃতীয় লিঙ্গদের উপস্থিতি নেহাতই অপ্রত্যাশিত। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন কুরুচিপূর্ণ অঙ্গভঙ্গি এবং তাচ্ছিল্যপূর্ণ আচরণ তৃতীয় লিঙ্গ সম্প্রদায়ের সব বয়সী মানুষের অবধারিত নিয়তি। তবে আমাদের সমাজ কেবল তৃতীয় লিঙ্গ শিশুর প্রতি নেতিবাচক আচরণ করেই ক্ষান্ত হয় না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সংশ্নিষ্ট পরিবারকেও বয়ে বেড়াতে হয় এর প্রভাব।
সামাজিক কুসংস্কারের তীব্রতা তৃতীয় লিঙ্গ শিশুদের পারিবারিক জীবনও কেড়ে নেয়। বেশিরভাগ তৃতীয় লিঙ্গ শিশুই পরিণত বয়সে উপনীত হওয়ার আগেই তার নিজ পরিবার থেকে বিতাড়িত বা স্বেচ্ছায় নির্বাসিত হয়ে আমাদের তথাকথিত সভ্য সমাজ ছেড়ে ছিন্নমূল তৃতীয় লিঙ্গদের সঙ্গে বসবাস করতে শুরু করে। ফলে আমাদের সভ্য সমাজের বৃত্তের ভেতর তৈরি হয় বঞ্চিত তৃতীয় লিঙ্গ জনগোষ্ঠীর আরও একটি বৃত্ত। এই অদৃশ্য বৃত্তের দুর্ভেদ্য দেয়াল অতিক্রম করে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং অন্যান্য মানবিক সুবিধা প্রায় পৌঁছে না বললেই চলে। ফলে আমাদের তথাকথিত সভ্য সংস্কৃতির সঙ্গে তৃতীয় লিঙ্গ সম্প্রদায়ের সংস্কৃতির পথচলাটা কখনও সমান্তরাল হয় না। বরং শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার অনুপস্থিতি, কর্মসংস্থানের অনিশ্চয়তা এবং সর্বোপরি সামাজিক অবহেলা তাদের মানবিক সংস্কৃতির বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করায় তৃতীয় লিঙ্গ সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে এক ধরনের বিকলাঙ্গ মানসিকতার জন্ম নেয়। যার প্রতিফলন ঘটে তাদের আচার-আচরণে। যে কোনো স্বাভাবিক মানুষের মতোই তৃতীয় লিঙ্গদের শারীরিক-মানসিক সামর্থ্য থাকার পরও তাদের সহজে কেউ কর্মে নিয়োগ দিতে চায় না। কর্মসংস্থানের সুযোগ না থাকায় বেঁচে থাকার তাগিদে তারা পথে-ঘাটে, যানবাহনে মানুষের কাছে হাত পেতে বা হাটে-বাজারে তোলা তুলে জীবিকা নির্বাহ করে। আবার এটাও সত্য যে, পারিবারিক পরিবেশ এবং শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত তৃতীয় লিঙ্গ সম্প্রদায়ের অধিকাংশ সদস্যই রাষ্ট্র, সমাজ এমনকি নিজেদের ভালোমন্দ সম্পর্কেও সচেতন হওয়ার সুযোগ পান না। এই অসচেতনতা ও অজ্ঞতা একদিকে তাদের আচরণকে যেমন অসংলগ্ন কর তোলে, অন্যদিকে এই অজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে কোনো কোনো অপরাধী গোষ্ঠী তৃতীয় লিঙ্গদের বিভিন্ন সমাজবিরোধী কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করার সুযোগ পায়। ফলে তৃতীয় লিঙ্গ সম্প্রদায়ের কর্মকাণ্ড প্রায়ই নাগরিক জীবনে প্রকট সংকট হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। সাধারণ মানুষ এই অবহেলিত আর বঞ্চিত মানব সম্প্রদায়ের কর্মকাণ্ডে এতটাই বিক্ষুব্ধ ও বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠেছেন যে, তাদের আচরণ দৃষ্টে মনে হয় তাদের কাছে তৃতীয় লিঙ্গরা ইতর প্রাণীর চেয়েও নিকৃষ্ট।
তৃতীয় লিঙ্গ সম্প্রদায়ের লোকদের বঞ্চিত বলছি; কারণ, সামাজের বৈষম্যমূলক আচরণ ও কুসংস্কার তাদের স্বাভাবিক জীবন থেকে দূরে থাকতে বাধ্য করছে। আর এসব কুসংস্কারের কবল থেকে মুক্ত হয়ে মানুষ হিসেবে স্বাভাবিক মানবিক মূল্যবোধ বিকাশের সুযোগ লাভ তাদের সাংবিধানিক অধিকার। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে বর্ণিত ‘আইনের দৃষ্টিতে সকল নাগরিকের সমান অধিকার’ নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সরকার ২০১৩ সালের ১১ নভেম্বর তৃতীয় লিঙ্গ জনগোষ্ঠীকে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি প্রদান করেছে। ফলে এখন তারা জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট ও অন্য সব সরকারি-বেসরকারি নথিপত্রে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ হিসেবে পরিচিত হচ্ছে। এ ছাড়াও সংবিধানের ১৫ (ঘ) অনুচ্ছেদে বর্ণিত রাষ্ট্রীয় আকাঙ্ক্ষা মোতাবেক তৃতীয় লিঙ্গ জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নকল্পে সরকার সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ৫০ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সী অক্ষম ও অসচ্ছল তৃতীয় লিঙ্গদের জন্য মাসিক ৬০০ টাকা করে বিশেষ ভাতা এবং শিক্ষাক্ষেত্রে তৃতীয় লিঙ্গ শিশুদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে তাদের মানবসম্পদে পরিণত করার লক্ষ্যে প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক এবং উচ্চশিক্ষা পর্যায়ে যথাক্রমে ৭০০, ৮০০, ১০০০ ও ১২০০ টাকা করে উপবৃত্তি প্রদানের ব্যবস্থা করেছে। এ ছাড়াও সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে তৃতীয় লিঙ্গদের জন্য বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের আয়োজনের মাধ্যমে তাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা হচ্ছে।
শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের এ জাতীয় উদ্যোগ তৃতীয় লিঙ্গ সম্প্রদায়ের জীবনমান উন্নয়নে নিঃসন্দেহে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করবে। কিন্তু তৃতীয় লিঙ্গ সম্প্রদায়ের মানুষদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে এনে সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদে বর্ণিত ‘জনগণের জীবনযাত্রার বস্তুগত ও সংস্কৃতিগত মানের দৃঢ় উন্নতি সাধন’ সংক্রান্ত রাষ্ট্রীয় আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের মাধ্যমে তাদের মানবিক মর্যাদা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে উল্লিখিত পদক্ষেপগুলো আমাদের বিবেচনায় মোটেও যথেষ্ট নয়। কারণ সরকারিভাবে স্বীকৃত ‘হিজড়া’ শব্দটি আবহমানকাল ধরে আমাদের সমাজে একটি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশক শব্দ হিসেবে ব্যবহূত হয়ে আসছে। শব্দটি বলা বা শোনার ক্ষেত্রে তৃতীয় লিঙ্গ সম্প্রদায়ের মানুষ নিজেরাই বিব্রতবোধ করে।
এ ক্ষেত্রে আইনে হিজড়া শব্দটির পরিবর্তে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ শব্দটি ব্যবহার করা যেতে পারে। এ ছাড়াও তৃতীয় লিঙ্গ সম্প্রদায়ের পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে কেবল অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান আর কর্মসংস্থানের বিষয়াদি নিশ্চিত করলেই চলবে না। যে নেতিবাচক পারিবারিক দৃষ্টিভঙ্গি আর সামাজিক কুসংস্কার এই আশরাফুল মাখলুকাত আদম সন্তানদের সভ্য সমাজের বাইরে ঠেলে দিয়ে তাদের সাংস্কৃতিকভাবে বিকলাঙ্গ করে তুলেছে, তা দূরীভূত করতে হবে।
এ ক্ষেত্রে তাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পুনর্বাসনের বিষয়কে অগ্রাধিকার প্রদান করতে হবে। সাধারণত দেখা যায়, তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে জন্ম নেওয়া শিশুকে সংশ্নিষ্ট পরিবার-সমাজ থেকে আড়াল করে রাখে। এমনকি অনেকে আত্মীয়-পরিজনের সামনেও শিশুর লিঙ্গ পরিচয় প্রকাশে কুণ্ঠিতবোধ করেন। ফলে তৃতীয় লিঙ্গ শিশুরা প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা থেকেও বঞ্চিত হয়। অথচ আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের বদৌলতে পৃথিবীর বহু দেশে তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে জন্ম নেওয়া অনেক শিশু পূর্ণাঙ্গ পুরুষ বা নারী হিসেবে রূপান্তরিত হয়ে স্বাভাবিক জীবন ফিরে পেয়েছে। তাই তৃতীয় লিঙ্গদের সম্পর্কে পারিবারিক ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে হবে। তৃতীয় লিঙ্গদের তাদের নিজ নিজ পরিবার ও সমাজের সংস্কৃতির মধ্যে বেড়ে ওঠার সুযোগ করে দিতে হবে। আর এ জন্য প্রয়োজনীয় সচেতনতামূলক কর্মসূচি রাষ্ট্রকেই নিতে হবে। কারণ রাষ্ট্রব্যবস্থাই জনআচরণ তথা জনসংস্কৃতি বিবর্তনের মূল নিয়ামক।
সহকারী অধ্যাপক (হিসাববিজ্ঞান) ময়মনসিংহ সরকারি কলেজ, ময়মনসিংহ । সূত্র: সমকাল,প্রকাশ: ০৪ অক্টোবর ২০১৮।।