তাপস দাস >>
অনেক ঘটনা প্রবাহের সাক্ষী ঝিটকা -ধানশোল। মেদিনীপুর -লালগড় রাজ্যসড়কের পিড়াকাটা পার করে লালগড়ের ৬কিমি আগে। শাল পিয়ালের ৩৯৫ হেক্টর জঙ্গলে ঘেরা ছোট্ট গ্রাম। শবর, লোধা, সাওতাল, মাহাতোরা যুগ যুগ ধরে বসবাস করছেন। শুড়ি (সাহা) তারাও আছেন গ্রামের জীবন প্রবাহে। ১৩-১৪ জুলাই “নদী বাঁচাও জীবন বাঁচাও আন্দোলন “গড়ে তোলার চেষ্টায় আয়োজিত ‘কলকাতা নদী কনভেনশনে’ বন বৃদ্ধি, সংরক্ষণ ও বন অধিকার আইন ছত্রে চন্দন মাহাতোর আবেগ তাড়িত বক্তব্য শুনে অনেকেই জল -জঙ্গল- মানুষের নিবিড় যোগাযোগ এর বাস্তবতা অনুধাবন করেছিলেন।
অনিরুদ্ধ ভট্টাচার্য দা আর আমি “বিজ্ঞান বার্তা”তে চন্দনের একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশ করার আগ্রহ নিয়ে পৌঁছালাম ঝিটকা। চন্দনের মাটির দোতলা বাড়ী তে ক্ষণিক বিশ্রাম নিয়ে চললাম রাণীর নামে পরিচিত পুকুরে। লাল গড়ের রাজা এই অঞ্চলে এসে জলের অভাব দেখে তৈরি করলেন এই পুকুর যদিও শুড়িরাই এখন এই জলের মালিক। উঁচু বাঁধ নিয়ে বিঘা দুয়েকের পুকুর। সাধারণের জন্য এখনো মুক্ত।
স্নান সেরে ভোজন সেরে পৌঁছালাম শবর উপজাতি দের পাড়ায়। মহিলা-বয়স্কসহ জনা দশেক আবহমান ধরে নিজেদের জীবন যাত্রাকে বাঁচিয়ে রাখা মানুষের সঙ্গে কথোপকথন শুরু হলো। এর মধ্যে খবর এলো চন্দনের ঘরে সাপ ঢুকেছে সে ফিরে গেলো। জঙ্গলে পাওয়া বিভিন্ন বৈচিত্রময় খাদ্য ভান্ডার সহ জঙ্গল নির্ভর জীবন-জীবিকার। জানলাম বছর দশেক ধরে চলা এক নতুন জীবিকার। কলমির ডালে পাওয়া এক বিশেষ ধরণের গুবরে পোঁকা ধরেন তাঁরা। গ্রামেরই এক ব্যাপারি ওজন হিসাবে কিনে নিয়ে যান সেই পোঁকা মেদিনীপুরে। তবে ঐ পোঁকার ব্যবহার জানা গেল না ওনাদের কাছে।
আমরা আরো কিছুক্ষন আলোচনা চালিয়ে বিদায় নিলাম। সঙ্গে নিলাম প্রকৃতির সন্তানদের জীবন জ্ঞান। প্রকৃতি নির্ভর আত্মশাসিত সামাজবদ্ধ মানুষদের আমাদের বেশী কিছু বলার ছিল না শুধু কিছু সময় গেলো সরকারের আয় বৃদ্ধির বিরুদ্ধে অর্থাৎ ‘বাংলা মদ’ শরীর মন সব কিছুর জন্যই ক্ষতিকারক সেই বিষয় সরকারের বিরোধিতা করে। শবর পাড়া থেকে বিদায় নিয়ে চললাম শাল জঙ্গলে পথে সেই পোকার কারবারী সঙ্গে আলাপ করলাম এর মধ্যে খবর এলো জঙ্গলে ঠাকুর বেড়িয়েছেন।
সেই পথে কিছু পথ হাঁটলাম সঙ্গে এসো পড়লো এই অঞ্চলের আন্দোলনের সাক্ষী কার্তিক মাহাত। পৌঁছালাম একটি সেচ খালের পাড়ে। জঙ্গলের মধ্য দিয়ে বয়ে গিয়েছে খাল, মুকুট মণিপুর থেকে কংসাবতীর জল এই খাল বয়ে চাষের ক্ষেতে পৌঁছানোর কথা ছিল। আসেও জল, কিন্তু জল কখন আসবে তখন ঐ জলের আদোও দরকার কি না চাষের কাজে, সেই খবর যাঁরা ছাড়েন তাদের কাছে থাকে না বা তাঁরা রাখেন না। দেশের নীতি তৈরির সংখ্যা তত্বে বড় বাঁধের মহিমা প্রচারে এই অঞ্চল সরকারের দ্বারা জলসেচ পরিকল্পনার অন্তর্গত। অথচ এই বছর বৃষ্টি কম হওয়ায় বেশীর ভাগ জমিতে চাষ হয়নি। কার্তিক আর চন্দনের সঙ্গে কিছু কথা চললো বন অধিকার আইন ও সেই বিষয় এই অঞ্চলের পরিপেক্ষিতে ।
বৃষ্টি ভেজা শাল জঙ্গলে হাঁটতে হাঁটতে চন্দন বুনো শুয়োরের কীর্তি কালাপের চিহ্ন চেনালো, মজা করে বললো “হাতি আসলে ছুটতে পারবেতো? “আমি বললাম “তুই আছিসতো”।গ্রাম-শহর হাতে হাত ধরে পরিবেশ-প্রকৃতির যে বিপদ আজ আমাদের সামনে এসেছে তাঁর থেকে উদ্ধার পেতে হবে সে কথা আর উচ্চারণ করা হলো না। এরমধ্যে দীর্ঘ দিনের বন অধিকার আইন লাগু করতে সক্রিয় আন্দোলনকারী পীতাম্বর মন্ডল এসে পড়লেন, আরো কিছু আলোচনা শেষে ফেরার পথ নেওয়া হলো। রূপসী বাংলার রূপ দেখে মেদিনীপুর স্টেশন থেকে ‘রূপসী বাংলা’ ট্রেন ধরলাম।
তাপস দাস : লেখক ও সংগঠক- নদী বাঁচাও জীবন বাঁচাও আন্দোলন, কলকাতা, ভারত।
আরো পড়তে পারেন….