আজ সকাল থেকেই বৃষ্টি। জানালার গা বেয়ে মোমের মত গলে বৃষ্টি নেমে আসছে। নিস্তব্ধ সকালের ঝাপসা আলোয় রাস্তার দু’ধারে সারি সারি সাজানো গাড়ি। নিরব সকাল। চায়ের কাপে আঙ্গুল জড়িয়ে জানালার ওপাশের দৃশ্যটা একটু উদাসিনভাবেই চোখে পড়ল আজ। বেশ কিছুদিন থেকে আমাদের শহরে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে। খাবার আর ঔষধের দোকান ছাড়া মোটামুটি সব কিছুই বন্ধ। রাস্তায় মানুষের চলাচল খুব একটা চোখে পড়ে না। অনেকক্ষণ পর পর একটা দুটো গাড়ি পাশের রাস্তা দিয়ে ধীর গতিতে চলে যাচ্ছে।
আমরা আমাদের এতদিনের অভ্যস্ত পৃথিবী থেকে আচমকা এক অনভ্যস্ত পৃথিবীতে চলে এসেছি, যেখানে মানুষ তার প্রতিদিনকার কাজ-কর্ম ফেলে নিজেদের ঘরে আটকে রাখার এক নিরন্তন চেষ্টা চালাচ্ছে। অজানা , নতুন এক ভাইরাস সেই সদূর চীন থেকে এসে, সারা পৃথিবীকে আতংকে নাড়িয়ে দিয়েছে। তবে আমাদের ভাইরাসে আক্রান্ত হবার চাইতে, আক্রান্ত হয়ে মারা যাবার ভয়টা বেশী তীব্র হয়ে উঠেছে, যদিও অনেকেই সুস্থ হয়েও উঠছেন। ঘরবন্দী অবস্থায় আমরা মানসিক নানাবিধ অসুবিধায় পড়েছি বটে তবে চারপাশের গাছ-পালা যেন আজ বড্ড স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে বরকে যথারীতি আজ কাজে বের হতে হচ্ছে। এ বের হওয়া যতখানি প্রয়োজন তার চেয়ে টের বেশী দায়িত্বের।। এমন নিরব, জনমানবহীন সকালে জানালার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছে, আমার হাতের আঙ্গুলে জড়ানো চায়ের কাপে ডুবানো চায়ের ছোট ব্যাগটা হয়ত ডুববে না যদি এই মানুষটা এত ঝুঁকির মাঝেও কাজে বের না হয়।
দুই সপ্তাহের বেশি হয়ে গেল বাচ্চাদের নিয়ে আমরা ঘরবন্দী। প্রতিদিন লাফিয়ে লাফিয়ে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ভয় আর দুশ্চিন্তা! মৃত্যুর সংখ্যাও নেহাত কম নয়! টিভি খুললেই পর্দায় ভেসে উঠে মৃত্যুর মিছিল, বাতাসে ও ভাইরাসের উপস্থিতি! বাইরে বের হওয়া বারণ , প্রয়োজন ছাড়া। সবার চোখে ভয় আর আতংকের নিয়মিত যাতায়াত। কেউ অসুস্থ হয়ে মারা যাচ্ছে , কেউবা সুস্থ হয়ে উঠছে আবার কেউবা দিনরাত মানসিক অশান্তিতে ভুগছে। এমন অবস্থায় এর আগে আমরা কখনও পড়িনি। ‘মহামারী’ শব্দটা এর আগে বইয়ের ছাপা অক্ষরেই সীমাবদ্ধ ছিল। এই পৃথিবী আমাদের ভীষণ প্রিয়। মানুষ যদি হাজার হাজার বছর আয়ু পেত তবে মানুষ হয়ত জীবনকে এতখানি তীব্রভাবে ভালবাসতে পারত না। জীবন ছোট , অস্থায়ী আর অনিশ্চিত বলেই, এটা আমাদের কাছে এতখানি উপভোগের!
হঠাৎ করেই কেমন যেন আমাদের চেনা পৃথিবীটা হারিয়ে গেল। প্রতিদিনকার সুখ গুলোকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বাতাসে কল- কারখানার ধোঁয়া নেই, দোকান-পাটে মানুষের তেমন ভিড় নেই , ফাঁকা রাস্তা। সকাল সকাল উঠে কারো কাজে বের হবার তাড়াও নেই। এ যেন এক নতুন পৃথিবী। এত দিন ধরে পৃথিবীকে আমরা আমাদের প্রয়োজনে যেভাবে ব্যবহার করেছি, তার বিপরীতে আমাদের প্রতি পৃথিবীর এমন বৈরী আচরণ খুব অস্বাভাবিক নয় বোধ হয়। আমাদের জ্ঞান সীমার ভিতর বিজ্ঞানের চোখ দিয়ে দেখা, এমন দারুণ আর দুর্লভ পৃথিবী আর একটিও এখন পর্যন্ত কেউ খুঁজে পাইনি। আমাদের সৌর জগতে চোখ রাখলে দেখা যায় ,আমাদের ঘিরে থাকা সব মৃত , প্রাণহীন গ্রহদের মাঝে কি দারুন বায়ু মণ্ডল দিয়ে এই সুন্দর মুখের গ্রহকে সাজানো হয়েছে। যার কোথাও কোন অসঙ্গতি ছিল না। হাজার হাজার বছর ধরে নিরলস ভাবে আমাদের সুখ – দুঃখ , ব্যথা বেদনা, অন্যায় -অবিচার টেনে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
আজ বাইরে নিস্তব্ধ নতুন পৃথিবী, ফাঁকা রাস্তা, খসে পড়েছে এতদিনের ফুলে -ফেঁপে উঠা পুঁজিবাদের শরীর যা আমাদেরকে এতদিন ভোগবাদের কেবল দাস বানাতেই শিখিয়েছে। কান পেতে ধরলে শুনা যায় নিশুত রাতে কুকুরের কান্না , ঘোলাটে আকাশে মন খারাপ করা ধোঁয়াটে চাঁদ। প্রতিদিন বইয়ের পাতায় যে শান্ত , হলুদরাঙা দুপুর নেমে আসত, সে দুপুর আজ হারিয়ে গেছে। চাঁদের আলো আর যেন জানালার কাঁচ বেয়ে গলে পড়ে না। এক অদৃশ্য ভাইরাস আমাদের অসহায়ত্বকে দিন দিন স্পষ্ট করে তুলছে। আমাদের রোজগার করে যাওয়া বিরামহীন অন্যায় , অবিচার আর বুঝি প্রকৃতির সইছে না। বোমায় বিধ্বস্ত এক একটা শহর, আর তার ধ্বংসস্তূপের উপর বসে, কোন এক শিশু আকাশের দিকে তাকিয়ে যখন রুটির জন্য কাঁদে কিংবা মারা যাবার আগে যে শিশু এই পৃথিবীর সব অন্যায়ের সাক্ষী দিবে বলে, বলে যায় , তার কথা শোনবার মত নিশ্চয়ই কেউ রয়েছেন!
আমার সামনে কারো বিবস্ত্র শরীর আর তার বিপরীতে আমার শরীর মোড়ানো দামি পোশাক। নিজেকে ভাল রাখার জন্য কত কিছুই না করি আমি কিন্তু দিন শেষে আমি এক অসুখী মানুষ। কোথায় লুকিয়ে থাকে সত্যিকারের আনন্দ , কিসে বাড়ে জীবনের স্বাদ তা আমার কখনও ই জানা হয় না। প্রতিদিন হাজার রকম অন্যায়ে যেন পৃথিবীর শ্বাস আটকে আসে। আমাদের লাগামহীন চাহিদা মেটাতে প্রতিদিন বাড়ছে কল কারখানার ধোঁয়া। বায়ু মণ্ডলের ওজোন স্তরের গায়ে গর্ত হওয়াই প্রতিদিন বাড়ছে পৃথিবীর জ্বর। এ জ্বর মেপে দেখার যেন কেউ নেই। প্রতিদিন বিভিন্ন ভাবে আমরা পৃথিবীর ভারসাম্য নষ্ট করছি। আকাশ পথে সিগারেটের মত ধোঁয়া ছেড়ে প্রতিদিন উড়োজাহাজ নষ্ট করছে আকাশের ফুসফুস ! মাটিতে কীটনাশক , বাজারে সুসজ্জিত প্লাস্টিকে মোড়ানো খাবার কতখানি শরীরের জন্য ভাল, তা বিভিন্ন রোগ বালাই বলে দিচ্ছে।
এই নীল , স্নিগ্ধ আকাশের নিচে আমাদের দৃশ্যমান জমকালো পৃথিবীর চেহারাটা আরও সুখী আর সুন্দর হতে পারত। এই অনন্য আর মহার্ঘ্য জীবন আরও সুবিন্যস্ত হতে পারত। এখন আর কিছুতেই আগের মত সেই ধীর গতির পৃথিবীর কথা ভাবা যায় না ,যেখানে আমাদের পূর্ব-পুরুষেরা এক সুখী জীবন যাপনে অভ্যস্ত ছিল। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে সব কিছু ধীরে ধীরে পাল্টে গেল। মানুষ দিন দিন তার মৌলিক চিন্তা ভেঙ্গে আরও বুদ্ধিমান হল। মানুষ জানল গাছের প্রাণ আছে, তার অক্সিজেন নিয়ে আমরা বেঁচে থাকি , অন্যদিকে বিলাসী জীবন যাপনের আশায়, আমরাই গাছ কেটে উজার করি , ঘরের দামি আসবাব বানাই যার নিখুঁত নকশায় গোপনে পৃথিবীর আয়ু ফুরায় আর তা প্রতিবার এড়িয়ে গিয়ে আমরা এক ভয়ংকর সুখী জীবনের স্বপ্ন দেখি।
যে শিশুর চোখ তুলে শরতের নীল আকাশ দেখার কথা ছিল , প্রযুক্তি তার দেখার ইচ্ছে কেড়ে নিচ্ছে। যে শিশু ঘাসে পা ডুবিয়ে তার নরম আঙ্গুলে সুতো পেঁচিয়ে নীল , স্বচ্ছ আকাশের চোখে চোখ রেখে ঘুড়ি উড়ানোর কথা , এর বিপরীতে আজ মোবাইল কিংবা ট্যাবের পর্দায় তার আটকানো নতমুখ!
পৃথিবী প্রতিনিয়ত অস্থিরভেবে এগুচ্ছে! মানুষ চিরকালেই বুদ্ধিমান ছিল তবে আধুনিক মানুষদের জানার আগ্রহ বেড়েছে। মানুষের ক্ষুধা -তৃষ্ণা আর রুগ্ন শরীরের চাহিদা না মিটিয়ে, আমরা অন্ধ চোখে ভিন গ্রহের মানুষ খুঁজে বেড়াচ্ছি। যে নভোযান বিফল হয়ে মহাকাশে ধ্বংস হয় অথবা যে যুদ্ধ হাজারো শিশুর সোনালি শৈশব কেড়ে নেয়, তার খরচে ঠিক কতগুলো শিশুর একবেলার রুটি কেনা যেত , তার হিসেব বোধ করি এই গাণিতিক পৃথিবীর মানুষের জানা নেই। আমাদের প্রাকৃতিক আর মানসিক দূষণে পৃথিবীর শ্বাস যেন বন্ধ হয়ে আসে। তার বগলের নিচে জ্বরের লাল পারদ লাফিয়ে বেড়ায়। প্রতিনিয়ত গাছ-পালা নিধন হওয়ায়,পৃথিবীর গালের ছোপ ছোপ দাড়ি , রুক্ষ চুল আর রক্তাক্ত চোখে তাকে কখনও উদভ্রান্তের মত দেখায়। আকাশপানে আমাদের কল-কারখানার ঊর্ধ্ব মুখী ধোঁয়া , আমাদের মত আকাশের ফুসফুসেও বুনে দেয় যক্ষ্মার ছোট বীজ!
মনের ভিতর কখনও গভীর অনুসন্ধান চলে , মস্তিষ্কের কোষে কোষে চিন্তা আর হতাশারা ঘুরে ফিরে। যত দূর চোখ যায় , ধোঁয়া ধোঁয়া লাগে চারপাশ ,তবুও এই সভ্য , বস্তুবাদ জগতের হিসেব মিলে না। অনেক দিন হল আমার বাড়ি ফেরা হয় না। আমার প্রাণের শহর ‘কিশোরগঞ্জ’ যেখানে আমার প্রাণ ভোমরা লুকিয়ে থাকে , যার চেনা-অচেনা প্রতিটি মানুষের সঙ্গে রয়েছে আমার অদৃশ্য, অনাত্মীয় সম্পর্কের টান! যে শহরে কোন এক অন্ধকার রাতে, আমি দেখেছিলাম আমার চোখের উপর ভেসে থাকা প্রথম ছায়াপথ! যে শহরের কোন এক বাড়ির উঠোনে আমাকে না পেয়ে মেঘেদের অভিমান পুঞ্জিভূত হয় অথবা কোন এক বিকেলে শীতের নরম রোদে গা ডুবিয়ে, মা হয়ত আমার প্রিয় নারিকেলের চিড়া বানায় আর দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে কৌটোর মুখ আটকায়। যে শহরে আজও ঝুম বৃষ্টি নামে, যেখানে নারিকেল গাছের শ্যাওলা ধরা গা বেয়ে, বৃষ্টি মাটির দিকে নেমে আসে। যে শহরের বাতাসে ভেসে বেড়ায় আমার সব প্রিয় মানুষদের গায়ের গন্ধ , বাতাসে গভীর শ্বাস টেনে যে গন্ধ আমি আমার ফুসফুসের প্রতিটি বায়ুথলি ভরে রাখি! আমার আজকাল অনেক কিছুই দেখা হয় না।
মনের অলিগলি আর মেঠো পথে হাঁটার সময় স্বপ্নরা কেন যেন কারণে- অকারণে পিছু নেয়। বহুদিনের ধরে চোখের তারার আড়ালে একটা পুরনো স্বপ্ন জমা পড়েছে। একদিন এই পৃথিবী শিশুদের জন্য এক দারুন পৃথিবী হবে! আমাদের জীর্ণ মতবাদ সব ভেঙ্গে যাবে। আমরা বস্তুবাদের পৃথিবী চাই না, আমরা দূষণ মুক্ত পৃথিবী চাই। আমাদের হারানো অরণ্য ফিরিয়ে নেবার সময় এসেছে! আমাদের সব শিশুদের জন্য হলেও ,আমরা অরণ্য ফিরে পেতে চাই যে অরণ্যে ঝুম বৃষ্টি নামবে , বৃষ্টি থামার পর পৃথিবী যখন রংধনুর সাত রঙের ফিতাতে মোড়াবে তা দেখে যেন শিশুরা শিখে নিতে পারে ,রঙধনুর সব ক’টা রঙ অথবা কোন এক শান্ত বিকেলে বৃষ্টির পর, মায়ের হাত ধরে , গ্রিলে ঝুলে থাকা বৃষ্টির ফোঁটা গুনে গুনে কোন শিশু যেন শিখে নিতে পারে তার প্রথম গণিত পাঠ। আমরা এমন পৃথিবী চাই।