কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর উপজেলার গাজীরচর ইউনিয়নের ঘাগুটিয়া গ্রামে হারুন-উর রশিদ বীর প্রতীকের বাড়ি। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি গ্রামের যুবকদের নিয়ে সরাসরি যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। মুক্তিযুদ্ধে তিনি বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য অপারেশনে অংশ নেন।
১৯৭১ সালের ২০ অক্টোবর। মধ্যরাত। গণবাহিনীর দেড় শত মুক্তিযোদ্ধা তিনটি দলে বিভক্ত হয়ে রাতের অন্ধকারে নিঃশব্দে এগিয়ে চলেছেন। তাঁরা ঘড়ির কাঁটায় রাত সাড়ে তিনটা বাজার সঙ্গে সঙ্গে সরারচর রেল স্টেশন ও পার্শ্ববর্তী পাকিস্তানি অবস্থানে আক্রমণ করবেন। মুক্তিযোদ্ধ হারুন-উর-রশিদও একটি দলের সঙ্গে রয়েছেন। সরারচরের অবস্থান কিশোরগঞ্জ জেলার বাজিতপুর উপজেলায়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এই রেলস্টেশনের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। পরিকল্পনামতো মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল মাইনের সাহায্যে নিকটবর্তী ঝুমাপুর রেলসেতু ধ্বংস করে। দ্বিতীয় দল বিস্ফোরণের শব্দ শোনার সঙ্গে সঙ্গে সরারচর রেলস্টেশনে অবস্থানরত রাজাকারদের ওপর আক্রমণ করে। তৃতীয় দল একই সময়ে পার্শ্ববর্তী শিবনাথ স্কুলে অবস্থানরত পাকিস্তানি ৭০ উইং রেঞ্জার্স ফোর্সের ওপর আক্রমণ করে। সে সময় রেঞ্জার্স ফোর্স পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। সরারচর রেলস্টেশনে দুজন রাজাকার নিহত হয়। অন্যরা আহত অবস্থায় পালিয়ে যায়। শিবনাথ স্কুলে কয়েকজন রাজাকার ও রেঞ্জার্স ফোর্সের একজন নিহত হয়। পরের দিন ও সারারাত সব মুক্তিযোদ্ধা মিলে শিবনাথ স্কুলে অবস্থানরত পাকিস্তানি রেঞ্জার্স ও রাজাকারদের অবরোধ করে রাখেন। তখন এখানে তুমুল যুদ্ধ হয়। শেষ রাতে পাকিস্তানি রেঞ্জার্স ও রাজাকাররা সরারচর থেকে পালিয়ে যায়। এই যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর ছয়জন শহীদ ও কয়েকজন আহত হন। সরারচরের যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা হারুন-উর-রশিদ যথেষ্ট সাহস ও বীরত্ব প্রদর্শন করেন।
হারুন-উর-রশিদ ১৯৭১ সালে টাঙ্গাইলের মির্জাপুর সংলগ্ন গড়াইয়ে একটি বস্ত্র কারখানায় চাকরি করতেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি নিজ এলাকা বাজিতপুরে চলে যান। ভারতে ইকো ওয়ান ট্রেনিং সেন্টারে প্রশিক্ষণ নেন। এরপর হাবিলদার মেজবাহ উদ্দিন খানের নেতৃত্বে দেশে আসেন। তাঁর দলনেতা ছিলেন মুজিবুর রহমান মাস্টার। হারুন-উর-রশিদ কিশোরগঞ্জ জেলার ছয়ছটি (ভৈরব উপজেলার অন্তর্গত), কুলিয়ারচর, নরসিংদী জেলার হাঁটুভাঙ্গা ও বেলাবসহ আরো কয়েকটি স্থানে যুদ্ধ করেন। বেলাব যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এই যুদ্ধে তিনি যথেষ্ট কৃতিত্ব দেখান।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য গণবাহিনীর সদস্য হারুন-উর-রশিদ বীর প্রতীক খেতাব পেয়েছেন।
বর্তমানে তিনি ঢাকার দক্ষিনখানে ভাড়া বাড়িতে বসবাস করছেন। তাঁর বাবার নাম সুলতান ভুঁইয়া, মায়ের নাম উমরিচান বেগম। তাঁর তিন ছেলে ও এক মেয়ে।
আলাপকালে হারুন-উর-রশিদ বলেন, বাঙালি জাতি হিসেবে আমরা আলাদা সত্তা ও সার্বভৌমত্ব পেয়েছি। কিন্তু অর্থনৈতিক মুক্তি পাইনি। যার জন্য দেশের মানুষ আজও নিষ্পেষিত। মুক্তিযোদ্ধারাও পায়নি সমাজে প্রকৃত মর্যাদা।
লেখক: সাইফুল হক মোল্লা দুলু, সাংবাদিক