ইতিহাসস্রষ্টা বঙ্গবন্ধু : আমাদের প্রজন্ম, যারা বাংলাদেশকে স্বাধীনভাবে আবির্ভূত হতে দেখেছে এবং তার পেছনে বঙ্গবন্ধুর যে অসামান্য অবদান তা প্রত্যক্ষ করেছে, তাদের পক্ষে বঙ্গবন্ধুর কর্মকাণ্ডের মূল্যায়ন সহজ ভাষায় ব্যক্ত করা অত্যন্ত কঠিন। আমি নিজে যখনই বঙ্গবন্ধুর কথা ভাবি তখনই আমার প্রথমে মনে পড়ে ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের সেই উত্তাল দিনগুলোর কথা। আমি তখন ঢাকাতেই ছিলাম। ১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনের পর থেকেই আমরা বিপুল আশা-উদ্দীপনার মধ্যে ছিলাম। বাংলাদেশ যে সৃষ্টি হতে যাচ্ছে তা নিয়ে আমাদের মনে আর কোনো সন্দেহ ছিল না। তখন একমাত্র প্রশ্ন ছিল আমরা কি শান্তিপূর্ণভাবে আলোচনার মাধ্যমে এই স্বাধীন দেশ সৃষ্টি করতে পারব নাকি আমাদের একটা বিরাট রক্তাক্ত সংঘাতের পথে যেতে হবে। আমার মনে পড়ে ১ মার্চ যখন জেনারেল ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের বৈঠক স্থগিত করলেন এবং তারপর যখন বঙ্গবন্ধু ৩ মার্চ থেকে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিলেন, বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষই তখন স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল। প্রশাসন, বিচার বিভাগ, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যবর্গ, ব্যবসায়ী সম্প্রদায় সবাই পাকিস্তান সরকারের পক্ষ ত্যাগ করে বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাদের আনুগত্য প্রকাশ করল। পৃথিবীর আর কোনো দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনেই সংশ্লিষ্ট দেশটির জাতীয় স্বাধীনতা স্বীকৃতি না পাওয়া পর্যন্ত প্রশাসনকে এভাবে তাদের আনুগত্য পরিবর্তন করতে দেখা যায়নি। এর একটি প্রধান কারণ, বঙ্গবন্ধু আহূত অসহযোগ আন্দোলন এমনই ব্যাপক ও সর্বজনগ্রাহ্য ব্যাপার হয়ে পড়েছিল যে, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সচল রাখার প্রয়োজনে অসহযোগ আন্দোলন চলাকালেই বঙ্গবন্ধুকে সারাদেশের শাসনভার পরিচালনার দায়িত্ব নিতে হয়। আমাদের দেশে স্বাধীনতার ঘোষণার দিনক্ষণ নিয়ে যে বিতর্ক চলে তা একান্তই অবান্তর।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে আমার কাছে ফরাসি দার্শনিক রুশোর ‘সামাজিক চুক্তি’ (social contract) বইটি খুব প্রিয় ছিল, বিশেষ করে রুশোর একটি তাত্তি্বক ধারণা ‘general will। যখন ক্লাসে আমি এটা পড়াতাম, তখন ভাবতাম general will কেমন হতে পারে। ১৯৭১ সালের ২ মার্চের পর যখন আমি অসহযোগ আন্দোলনে হাজার হাজার মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ দেখলাম এবং সবার মুখে শুধু স্বাধীনতার কথা শুনতাম তখন বুঝতে পারলাম রুশোর general will কথাটির অর্থ কী। আমি স্পষ্টই দেখতে পেলাম আমাদের স্বাধীনতার পক্ষে general will সৃষ্টি হয়েছে। সারাদেশের মানুষ তখন ঐক্যবদ্ধ স্বাধীনতার দাবির ডাকে। এই general will এই ঐক্যবদ্ধ জনমত গঠিত হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর বহু বছরের সাধনা, ত্যাগ এবং কর্মকাণ্ডের ফলে।
আমি নিজেকে খুবই ভাগ্যবান মনে করি যে, আমি নিজের চোখে ১৯৭১ সালের মার্চ মাস এবং বঙ্গবন্ধুর সেদিনের ভূমিকাকে প্রত্যক্ষ করেছি। খুব কম লোকেরই ভাগ্য হয় ইতিহাস সৃষ্টি হতে দেখা। আমি ইতিহাস সৃষ্টি হতে দেখেছি। স্বাধিকার আন্দোলনকে স্বাধীনতার আন্দোলনে রূপান্তরিত হতে দেখেছি। এসব ঐতিহাসিক ঘটনার মূল নায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অসম্ভব সম্ভব করতে দেখেছি। পৃথিবীর অনেক দেশেই অনেক সময়ে অনেক নেতা নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন। দেশ পরিচালনা করতে পারেন। কিন্তু খুব অল্পসংখ্যক নেতাই ইতিহাস রচনা করতে পেরেছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন তেমনই একজন অনন্য কালজয়ী ইতিহাসের মহানায়ক।
আত্মপরিচিতি ও মূল্যবোধ : তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বইটির প্রথমেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিগত নোট বইয়ের একটি উদ্ধৃতি রয়েছে, যা তিনি ১৯৭৩ সালের ৩০ মে লিখেছিলেন। উদৃব্দতিটি আমাদের সবারই দৃষ্টি আকর্ষণ করার মতো; কারণ মাত্র তিনটি বাক্যে ওই উদৃব্দতি দিয়ে তিনি তার আত্মপরিচিতি ও মূল্যবোধ অতি পরিষ্কার করেছেন। তিনি লিখেছেন :
‘একজন মানুষ হিসেবে সমগ্র মানবজাতি নিয়েই আমি ভাবি। একজন বাঙালি হিসেবে যা কিছু বাঙালিদের সঙ্গে সম্পর্কিত তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এই নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস ভালোবাসা, অক্ষয় ভালোবাসা, যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি এবং অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে।’
বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণের জন্য তার যে ভালোবাসা এবং প্রতিদানে জনগণের যে ভালোবাসা তিনি পেয়েছেন তার কথা তিনি নানা ভাষণে বারবার ব্যক্ত করেছেন। যেমন ১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনের পরে ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি জনপ্রতিনিধিদের শপথবাক্য পাঠ অনুষ্ঠানে তিনি বলেন :
‘প্রধানমন্ত্রী হবার কোনো ইচ্ছা আমার নেই। প্রধানমন্ত্রী আসে এবং যায়। কিন্তু যে ভালোবাসা ও সম্মান দেশবাসী আমাকে দিয়েছেন, তা আমি সারাজীবন মনে রাখব। অত্যাচার, নিপীড়ন এবং কারাগারের নির্জন প্রকোষ্ঠকেও আমি ভয় করি না। কিন্তু জনগণের ভালোবাসা যেন আমাকে দুর্বল করে ফেলেছে।’
পৃথিবীর অন্য নেতাদের ভাষণ আমি যখন পড়ি এবং তাদের ভাষণের সঙ্গে যখন বঙ্গবন্ধুর ভাষণের তুলনা করি তখন আমার কাছে তার এই অভিব্যক্তিটি ‘জনগণের প্রতি ভালোবাসা’ তা অনন্য বলে মনে হয়।
অনেক সময়ই যারা বড়মাপের নেতা হন তারা জনগণের সঙ্গে তেমন সম্পৃক্ত হন না। তারা জনগণকে কোনো মহৎ উদ্দেশ্যে পরিচালনার কথা বলেন। তারা অনেক সময়েই থেকে যান জনগণের ঊধর্ে্ব। তাই জনগণকে ভালোবাসার কথা তারা বলেন না। বঙ্গবন্ধু এর ব্যতিক্রম। তিনি সমসময়ই বাংলাদেশের জনসাধারণের সঙ্গে নিজেকে এক করে দেখতেন। এবং তাই তিনি বারে বারে একদিকে তার জনগণের জন্য ভালোবাসা এবং অন্যদিকে জনগণের তার জন্য ভালোবাসার কথা উল্লেখ করতেন।
বঙ্গবন্ধু রাজনীতিবিদ ছিলেন, তিনি আজীবন রাজনীতি করেছেন। আমরা প্রায়ই বলে থাকি রাজনীতি করতে হলে অনেক সময় নীতির কথা ভাবা যায় না। অনেক সময় আপস করতে হয়। বঙ্গবন্ধুকেও রাজনীতির পথ পরিক্রম করতে হয়েছে নানা প্রতিকূলতার মধ্যে এবং কখনও কখনও বাস্তবতার সঙ্গে মিলিয়ে সাময়িকভাবে আপসও করতে হয়েছে। কিন্তু মূল বিষয়গুলোতে তিনি কখনও নীতিবিচ্যুত হননি। জনগণের যে ভালোবাসা তিনি পেয়েছেন তার পেছনে ছিল জনগণের এই অগাধ বিশ্বাস যে, তিনি কখনও তার প্রতিশ্রুতির খেলাপ করবেন না। বাঙালি জাতির স্বার্থ তিনি কোনো অবস্থাতেই বিকিয়ে দেবেন না। তার প্রতি জনগণের এই বিশ্বাস ছিল বলেই তিনি হতে পেরেছিলেন জনগণের অবিসংবাদিত নেতা।
বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির কেন্দ্র ছিল জনগণ। জনগণের জন্য ভালোবাসা ছিল তার সব কর্মকাণ্ডের প্রেরণা, জনগণের ওপর বিশ্বাস ছিল তার কর্মকাণ্ডের ভিত্তি এবং জনগণের কল্যাণই ছিল তার সব কর্মকাণ্ডের লক্ষ্য। তার কর্মকাণ্ডের লক্ষ্য তিনি খুব সহজ দুটি ভাষায় প্রায়ই ব্যক্ত করতেন। তিনি প্রায়ই বলতেন, তার লক্ষ্য হচ্ছে ‘সোনার বাংলা গড়ে তোলা’, কিংবা তিনি বলতেন ‘দুঃখী মানুষের মুখে তিনি হাসি ফোটাতে চান’। বঙ্গবন্ধু তার জনসভায় খুবই সহজ-সরল ভাষায় বক্তৃতা করতেন। তাই তার বক্তব্য ছিল সুস্পষ্ট। যেমন বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর পরই ১৯৭২ সালে এক জনসভায় তিনি বলেন :
‘আমি কী চাই? আমি চাই বাংলার মানুষ পেটভরে ভাত খাক। আমি কী চাই? আমার বাংলার মানুষ সুখী হোক। আমি কী চাই? আমার বাংলার মানুষ হেসে-খেলে বেড়াক। আমি কী চাই? আমার সোনার বাংলার মানুষ আবার প্রাণভরে হাসুক।’
রাজনৈতিক সূচনা : ছাত্ররাজনীতির মাধ্যমে শেখ মুজিবের রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়। তিনি প্রথমে গোপালগঞ্জ ও পরবর্তীকালে কলকাতায় ছাত্রদের সংগঠিত করতে শুরু করেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মাধ্যমে তার রাজনীতির হাতেখড়ি, যার সঙ্গে তার প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল ১৯৩৮ সালে। ১৯৪২-৪৭ সাল পর্যন্ত শেখ মুজিব পাকিস্তান আন্দোলনে এবং মুসলিম ছাত্রলীগকে সংগঠিত করার কাজে নিয়োজিত ছিলেন কিন্তু তিনি কখনও সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন ছিলেন না। তিনি সবসময় সাম্প্রদায়িক সহিংসতাবিরোধী ছিলেন। তিনি মুসলিম লীগের প্রগতিশীল সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিম জোটের সঙ্গে সংযুক্ত ছিলেন এবং তার লক্ষ্য ছিল মুসলিম লীগকে সামন্তবাদীদের হাত থেকে উদ্ধার করা।
১৯৪৭ সালের পূর্বে শেখ মুজিব যদিও পাকিস্তানের একজন সমর্থক ছিলেন কিন্তু এই নতুন রাষ্ট্রটির জন্মের শুরু থেকে তার রাজনীতির যে ধরন তা দেখে মুজিব ক্রমেই তার প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েন। পাকিস্তানের জন্মলগ্নে তার রাজনৈতিক গুরু শহীদ সোহরাওয়ার্দী মুসলিম লীগের দলীয় কোন্দলে হেরে যান এবং মুসলিম লীগের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় নাজিমুদ্দীনের নেতৃত্বাধীন জোটের হাতে। যারা ছিলেন জমিদার শ্রেণীর। তিনি উল্লেখ করেন, নতুন পাকিস্তান রাষ্ট্রের রাজনীতি শুরু হয় ষড়যন্ত্রের হাত ধরে।
১৯৪৯ থেকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত শেখ মুজিবের রাজনৈতিক জীবনের বিবর্তন যদি আমরা দেখি তাহলে এটা স্পষ্ট হয় যে, তিনি এই দীর্ঘ সময় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কাজে যুক্ত ছিলেন। তিনি ছিলেন প্রথমে দলটির যুক্ত সম্পাদক এবং পরে সাধারণ সম্পাদক। ১৯৬৩ সালে সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর শেখ মুজিব আওয়ামী লীগে শীর্ষ নেতৃত্বের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং তার পরই তিনি শুরু করেন বাঙালি জাতীয়তাবাদের সুস্পষ্ট আন্দোলন। তিনি ‘বাংলা’ শব্দটি পুনরায় ব্যবহার করতে শুরু করেন। ১৯৬৪ সালে যখন তিনি জনগণকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ করতে শুরু করেন তখন তার স্লোগান ছিল ‘পূর্ববাংলা রুখিয়া দাঁড়াও’। ১৯৬৬ সালে তিনি ছয় দফা দাবি উত্থাপন করেন, যা ছিল মূলত পাকিস্তানকে একটি কনফেডারেশন করার দাবি। এরপর তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন এবং সারাদেশে ছয় দফা আন্দোলন শুরু করেন। এরপর থেকে তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের এজেন্ডাকে একমাত্র দাবি হিসেবে উপস্থাপন করেন। এরপর শেখ মুজিব পুনরায় কারাবরণ করেন এবং কারাগারে থাকা অবস্থায় পাকিস্তান সরকার তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করে (আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা)।
ছয় দফা দাবি ও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা শেখ মুজিবের খ্যাতিকে আরও বাড়িয়ে তোলে এবং ১৯৬৯ সালে প্রচণ্ড ছাত্র আন্দোলনের মুখে আইয়ুব সরকারের পতন হয় এবং শেখ মুজিব কারামুক্ত হন। কারামুক্তির পর ছাত্র সমাজ তাকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করে।
১৯৭০ সালের নির্বাচনী প্রচারণায় বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের ছয় দফা এবং ছাত্র সমাজের ১১ দফার দাবিতে জনগণের ভোট চান। এই সময় তিনি ‘বাংলাদেশ’ ও ‘জয় বাংলা’ এ দুটি স্লোগান ব্যবহার করতে আরম্ভ করেন। জনগণ তার প্রতি বিপুল সমর্থন দেয় এবং আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অসামান্য জয়লাভ করে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদে ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭ আসনে জয়লাভ করে। ১৯৬৬ থেকে ১৯৭০_ মাত্র চার বছরের মধ্যে বঙ্গবন্ধু একটি জাতিসত্তার পক্ষে দেশে ঐকমত্য গড়ে তুলতে পারেন। এত অল্পসময়ের মধ্যে পৃথিবীতে অন্য কোনো স্থানে জনগণকে এমন সংঘবদ্ধ করা সম্ভব হয়েছে বলে আমার জানা নেই।
বাংলাদেশের জন্ম : প্রথমেই আমি বলেছি, পাকিস্তানের শাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সালের মার্চে গণপরিষদের পূর্বনির্ধারিত বৈঠক স্থগিত করেন, যা বাংলাদেশে অভূতপূর্ব গণআন্দোলনের জন্ম দেয়। বঙ্গবন্ধু শান্তিপূর্ণ অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন, যার ফলে অভূতপূর্বভাবে বঙ্গবন্ধুর হাতে প্রশাসনিক ক্ষমতার হস্তান্তর ঘটে। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে তিনি তার বিখ্যাত ভাষণ ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ প্রদান করেন। যদিও তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে সেদিন স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি তবুও তার এ ভাষণে পরিষ্কারভাবে স্বাধীনতা সংগ্রামের দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন :
‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে।’
১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ তিনি তার ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করেন। এরপর ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর নির্মমভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি সেনাবাহিনী দ্বারা গ্রেফতার হন। এর পরদিন ২৬ মার্চ চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে আওয়ামী লীগ নেতা এমএ হান্নান বঙ্গবন্ধুর নামে একটি স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। অবশ্য আমি আগেই বলেছি এ ধরনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণার বহু পূর্বেই ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের প্রথম থেকেই বাংলাদেশের জনগণ নিজেদের এক স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে ভাবতে আরম্ভ করেছিল।
যদিও স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে বঙ্গবন্ধু ছিলেন পাকিস্তানে কারাবন্দি অবস্থায় তবুও স্বাধীনতা সংগ্রামের অনুপ্রেরণা ছিলেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৯৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যে অভূতপূূর্ব জয়লাভ করে তা আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণাকে বৈধতা প্রদান করে। এই নির্বাচনের পর বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসংবাদিত ও একক নেতারূপে বঙ্গবন্ধুর পরিচিতি সারাবিশ্বে প্রতিষ্ঠিত হয়। বস্তুত ১৯৭১ সালে জনগণের ওপর বঙ্গবন্ধুর যেমন প্রশ্নাতীত এবং একক কর্তৃত্ব ছিল তেমন ম্যান্ডেট (mandate) পৃথিবীর অন্য কোনো নেতা এমনকি মহাত্মা গান্ধী, নেহেরু, মাও, হো চি মিন, ম্যান্ডেলাও অর্জন করতে পারেননি। তারা সবাই নির্বাচনী বৈধতা পান স্বাধীনতার পর। এ কথা অনস্বীকার্য যে, বঙ্গবন্ধু যদি মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে বাঙালিদের মধ্যে জাতীয় আত্মসচেতনতা গড়ে না তুলতেন, তাদের ঐক্যবদ্ধ না করতেন এবং তাদের প্রদত্ত ম্যান্ডেটের বলে তাদের হয়ে বিশ্ববাসীর সামনে কথা না বলতেন তাহলে আমাদের মুক্তি সংগ্রামের ভবিষ্যৎ একটি অনিশ্চিত প্রক্রিয়ার বেড়াজালে আটকে পড়ত।
এখন প্রশ্ন হতে পারে, বঙ্গবন্ধুর সব কাজই কি বিতর্কের ঊধর্ে্ব ছিল? তিনি কি মাঝে মাঝে ভুল করেননি? প্রত্যেক মানুষ, এমনকি ঐতিহাসিক নেতাদের কাজ নিয়েও পরে নানা বিতর্কের সৃষ্টি হয়। বঙ্গবন্ধুর কর্মকাণ্ড নিয়েও বিতর্ক হয়েছে। কাজের ভুল সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর নিজের জীবনীতে লেখা একটি কথা আমি উদৃব্দত করতে চাই। তিনি লিখেছেন :
‘আমি অনেকের মধ্যে একটা জিনিস দেখেছি, কোনো কাজ করতে গেলে শুধু চিন্তাই করে। চিন্তা করতে করতে সময় পার হয়ে যায়, কাজ আর হয়ে ওঠে না। আমি চিন্তাভাবনা করে যে কাজটা করব তা করেই ফেলি। যদি ভুল হয়, সংশোধন করে নেই। কারণ যারা কাজ করে তাদেরই ভুল হতে পারে, যারা কাজ করে না তাদের ভুলও হয় না।’
বঙ্গবন্ধু তার স্বপ্নের সোনার বাংলায় কোনো বৈষম্য দেখতে চাননি। ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ জাতির উদ্দেশে দেওয়া এক ভাষণে তিনি বলেন :
‘বাংলাদেশে মানুষে মানুষে, ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে বৈষম্য থাকবে না। সম্পদের বণ্টন ব্যবস্থায় সমতা আনতে হবে এবং উচ্চতর আয় ও নিম্নতম উপার্জনের ক্ষেত্রে যে আকাশচুম্বী বৈষম্য এতদিন ধরে বিরাজ করছিল সেটা দূর করতে হবে।’
আজ ৪৩ বছর পর যখন আমি বঙ্গবন্ধুর কথা ভাবি তখন আমার প্রথমেই মনে হয়, আমরা কি তার স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তুলতে পেরেছি?
* ২০১৩ সালের ২০ আগস্ট যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান : জীবন ও কর্ম শীর্ষক একটি বক্তৃতা দেই। তারই আলোকে এ লেখাটি তৈরি হয়েছে।
লেখক: প্রফেসর রওনক জাহান -ষসম্মানিত ফেলো, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি), ঢাকা, বাংলাদেশ।