সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক আপনি কোন চোখে দেখেন? উত্তর আসবে ভালোই তো অথবা সমাজকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। আমি কিন্তু দেখি অনেক ভালো ভাবেই দু একটা তিক্ত অভিজ্ঞতা ছাড়া অনেক ভালো কাজের স্বাক্ষী আমার নিকট এই ফেসবুক। আমার বন্ধু তালিকায় প্রায় তিন হাজার বন্ধু নিয়ে আমার এই ডিজিটাল দুনিয়া। সেখানে সৈনিক এর সংখ্যাই বেশি হবে যারা প্রতিনিয়ত জীবনের সাথে যুদ্ধ করে যাচ্ছে। যারা যুদ্ধ করছেন না তারা যোদ্ধাদের সাহস যুগিয়ে যাচ্ছেন। আমি ধন্য ফেসবুকের জন্য। যেখানে মনিরা জাহান নামে একজন বন্ধু আমার বন্ধু তালিকায় রয়েছেন। একজন পোষাক শ্রমিক একজন জীবন সৈনিক মনিরা জাহান। বাগেরহাট জেলার রামপাল থানার পেড়িখালী গ্রামে তার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা।জন্মের পর পাঁচ থেকে ছয় মাস বয়স পর্যন্ত মায়ের কোলে থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল তার।তারপরই মায়ের স্নেহ থেকে বঞ্চিত। তার মা থাকতেন দাদার বাড়ি আর মনিরা বড় হতে থাকেন নানা নানীর নিকট। সংসার জীবনে প্রচন্ড অসুখী ছিলেন তার মা। তাই তিনি চেয়েছিলেন মেয়ের জীবনটা যেন তার মতো না হয়। নানা নানীর হাতে তুলে দিয়েছিলেন বুকের ধন আদরের ছয়মাস বয়সী মনিরাকে লেখাপড়া শিখে মানুষের মত মানুষ হতে । লেখা পড়া করে শিক্ষিত হলে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে, মায়ের মত জীবনটা দুঃখের হবে না। বেশি সুখী না হলেও আয় – রোজগার থাকায় জীবনটা মায়ের জীবনের মতো দুর্বিষহ হবে না।
নানা নানীর সাথে সবকিছু চলছিল ঠিকঠাক।বছর দুয়েক পর ছোট বোনের জন্ম।দুই দুইটা কন্যা সন্তান জন্ম দেয়ার অপরাধে অপরাধী হলেন মনিরার মা। মনিরার বাবা এক অথর্ব মানুষ কোন কাজ না করলেও টাকার প্রতি ছিল লোভ অনেক । নিজের সংসারের প্রয়োজনীয় ব্যয় তার দ্বারা সম্ভব ছিল না। মনিরার মা সংসার টিকিয়ে রাখার জন্য দুই মেয়েকে বাবার বাড়ি রেখে দিতে বাধ্য হন। স্বামীর সংসারে আশ্রয়ের আশায় টাকা নিতে আসতেন বাবা মায়ের নিকট। মনিরা তারা বাবার কথা বলতে চায়নি যখন আমার সাথে কথা হচ্ছিল। এমনকি অনেক অনুরোধেও তারা বাবার নামটি জানতে পারিনি। কতটা কষ্ট পেলে সন্তান তার বাবার নাম উচ্চারণ করতে ঘৃণাবোধ করেন।
যাহোক নানা বাড়িতেই মনিরাদের দুই বোনের লেখাপড়া শুরু। ডিগ্রী পরীক্ষা শুরু করলেও শেষ করা হয়নি।মায়ের সংসার ততদিনে দুর্বিষহ অবস্থা। অতপর স্বামীর সংসার ছেড়ে বাবার বাড়িতে আশ্রয়। ইতোমধ্যে নানার মৃত্যু তাদের আরও সঙ্কিত করে তোলে । মামা মামীদের সংসারে মোটামুটি ভালোই ছিলো তারা। মামা মামী সাধ্যমত চেষ্টা করেছেন যেন মনিরারা কোন কষ্ট না পায়। স্বামীর সংসার থেকে মনিরার মায়ের চলে সবকিছু যেন তাদের এলোমেলা করে দিলো। মায়ের চোখে অসহায় ভাব,চোখে জল দেখতে দেখতে শুধু ভাবতে লাগলো মনিরা আমি তো মেয়ে।ছেলে হলে কাজ করে মায়ের দায়িত্ব নিতে পারতাম। তখন মা র এত কষ্ট থাকত না। কোন কিছু না ভেবে ঝোকের মাথায় দূর সম্পর্কের এক ফুফুর হাত ধরে পালিয়ে এসেছিলো মনিরা ঢাকায় । সিদ্ধান্তটা সঠিক ছিল নাকি ভুল ছিল সে বিষয়ে সরাসরি কিছু না বলে ডিগ্রী পরীক্ষাটা শেষ করা উচিত ছিল বলে জানিয়েছিল সে। এইচ. এস. সির সার্টিফিকেট দিয়ে ইট পাথরের এই শহরে মনিরাদের চাকরি নির্ধারিত হবার নয়। সেই দুর সম্পর্কের ফুফুর হাত ধরে একটি গার্মেন্টসে পোষাক শ্রমিক হিসেবে যোগদান করে। যা এখনো অব্যহত।
লেখালেখি প্রসঙ্গে মনিরা জানান।রুদ্র মোহাম্মাদ শহীদুল্লাহ ছিলেন তার দুর সম্পর্কের মামা।রুদ্রের বাবা আর তার নানা ছিলেন আপন মামাতো ফুফাত ভাই।নানাদের বাড়িতে উনাদের আসা যাওয়া ছিল।নানা বাড়িতে থাকার সুবাদে এই সম্পর্কটা মনিরাকেও স্পর্শ করেছিল। মামার গান- ভালো আছি ভালো থেকো শুনে প্রথম ভাবনা মাথায় আসে গান লেখার। এই ভাবনাটা শুরু হয় কলেজে যাওয়ার পর।চেষ্টা করে গান লিখতে ব্যর্থ হয় বার বার।গান আর লেখা হয়নি। লেখার শুরুটা হলো বেতারের মাধ্যমে। ঢাকা বেতারের এক কালের জনপ্রিয় উপস্থাপক নাজমুল হুসাইনের গানের আসরে লেখা শুরু মনিারার। বেতারে নিজের নাম শুনে শুনে খুশির সাগরে ভাসতে থাকে সে। এই গানের আসরে লেখার সুবাদে কিশোরগঞ্জের এক শ্রোতা রাব্বীর সাথে তার পত্রমিতালী শুরু হয়। পত্রমিতা থেকে প্রেম। বাবার সংসার থেকে মায়ের চলে আসা আর মায়ের কাছ থেকে বাড়ি ছেড়ে আসার কারনে প্রেমটা আর এগুতে পারলো না। যোগাযোগ বন্ধ হলো রাব্বীর সাথে। প্রায় এক বছর পর তার সাথে পুনরায় যোগাযোগ স্থাপিত হলো। তখন যোগাযোগটা ছিল চিঠির মাধ্যমে। ফোন এতটা সহজ লভ্য ছিলো না। রাব্বী সবকিছু শুনে স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছিলো। সম্পর্কটা এগিয়ে চলল চিঠির মাধ্যম এবং মাঝে মাঝে ফোনে। এভাবে পত্র আদান প্রদান এবং ফোনের সম্পর্কের প্রায় চার বছর পর তাদের দেখা হয়। ছোটবেলা থেকেই সত্য বলতে অভ্যস্ত মনিরা রাব্বীর নিকট কোন লুকোচুরি না করে পরিবারের সব সমস্যার কথা তাকে খুলে বলে। মনিরার গায়ের রং ছিলো কালো এবং অতটা সুশ্রী ছিলো না (মনিরার ভাষ্যমতে) সেটাও তাকে খুলে বলেছিলো। এসব জানার পরই প্রেমিক পুরুষ রাব্বী মেনে নেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে জানায় সে বাহ্যিক চেহারা নয় তার মনটাকে ভালোবেসেছে। চেহারা এবং পরিবারের সমস্যা তার কাছে কোন বাঁধা নয় বলেও জানায়।প্রথম দেখার দিন রাব্বী একটা স্বর্ণের আংটি পড়িয়ে দিয়েছিল মনিরাকে। এটাও জানিয়েছিলো তার চাকরী হওয়ার সাথে সাথে মনিরাকে বাড়ি ফিরে যেতে হবে।পারিবারিকভাবে বিয়ে হওয়ার পর তারা ঢাকায় ফিরে এসে সংসার শুরু করবে । এতকিছুর পর মনিরার ভয় হচ্ছিল রাব্বীর পরিবার তাকে যদি না মানে।বাবা- মার সমস্যা।লেখা – পড়ার এই শ্রী।চেহারাও নেই।কি দেখে তার পরিবার তাকে মানবে। রাব্বী তাকে সাহস দিয়ে বলতে থাকে আমি স্বাবলম্বী পরিবার মানতে বাধ্য।না মানলে ভিন্ন পথ তো আছে। রাব্বী ছয় মাস সময় চেয়ে নেয় এবং তার কথায় মনিরা বাড়ি চলে যায়। বাড়িতে যাওয়ার পর মায়ের চাচাতো বোন রানু খালার ফোনে কথা বলতো তারা।সবকিছু ঠিক চলছিলো কিছুদিন। হঠাৎ ঈষাণ কোনে কালো মেঘের ঘনঘটা। রাব্বী কথা যোগাযোগ কমিয়ে দিতে থাকে। বিয়ের কথা বললে বলতো একটু দেরী হবে। তারপর একদিন রাব্বী বিয়ের প্রস্তাব পাঠায়। তবে মনিরাকে নয়, সেই রানু খালাকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠায় সে। আকাশ ভেঙ্গে পড়ে মাথায়। আত্মহত্যার চিন্তা করেও সহজ ভাবে নেয় সে।কেন মরবে? কার জন্য মরবে? আবার চলে আসে ঢাকার সেই পুরোনো ঠিকানায় কিছু একটা করতে।
শুরু হলো নতুন যুদ্ধ। ২০১৮ সালে কালো প্রকাশনী থেকে “অসমাপ্ত প্রেমের গল্প” নামে তার প্রথম বের হয়েছিল। অসমাপ্ত প্রেমের গল্প ছিলো মনিরার জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়েই লেখা। বিশ্বাস একবার হারালে আর ফিরে আসে না।তবুও মায়ের কষ্ট দূর করতে এবং একমাত্র ছোট বোনের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের পথটাকে বাঁধামুক্ত করতে অনিচ্ছা সত্ত্বেও এক বৎসর আগে বিয়ে করে মনিরা ।
এখনো মনিরা একটা গার্মেন্টসে কাজ করে। সকাল আটটায় যায়।রাতে ফেরে।রান্না ঘর দোর গোছানো, খাওয়া দাওয়া সেরে একটু লেখালেখি।সকাল হলে আবার দৌড় চার দেয়ালের মাঝে। সেলাই মেশিনের খটখট শব্দের মাঝে হারিয়ে ফেলে নিজেকে।
বর্তমান স্বামীর তাকে কতটুকু সহযোগিতা করছে লেখার ব্যাপারে জানতে চাইল মনিরা জানান যে, স্বামী পছন্দ করেন না।আগে বাঁধাও দিতেন। মনিরার অনঢ় সিদ্ধান্তের কারণে এখন আর কিছু বলেন না তিনি।এখন আবার চাকরী ছাড়তে বললেও মনিরা এবিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। মায়ের জীবনের ছবিগুলো তার সামনে ভেসে ওঠে বারবার বলা তো যায়না মায়ের জীবনটা যদি আবার তার হয়ে যায়।নিজের একটা জায়গা তৈরি করাই তার এখন ইচ্ছা আর চিন্তা শুধু লেখাটাকে নিয়ে। অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৯ এর মনিরা জাহানের আরো তিন টি উপন্যাস গোধূলীর ক্যানভাসে, স্বপ্নের অনেক রঙ, কানামাছি প্রকাশ করেছে দাঁড়িকমা প্রকাশনী।
মনিরারা এভাবেই সৃষ্টির জন্য নিজের জীবনকে উৎসর্গ করে চলেছে প্রতিনিয়ত। গর্ব হয় এই মনিরাই হয়তো একদিন মানবজাতির পথ প্রদর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে। জয় হোক আমাদের মনিরার….।
নোটঃ (অনেক ঘটনাই মনিরার অনিচ্ছায় লেখা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। মনিরার প্রেমিক হিসেবে যে রাব্বী নামটি উল্লেখ করা হয়েছে সেই নামটিও কাল্পনিক কারণ তার নামটিও মনিরা প্রকাশ করতে চায়নি)।
লেখকঃ সোহেল খান একজন সমাজ কর্মী ও টিভি অভিনেতা।