আমার বড় হয়ে ওঠার সময়টা কেটেছিল নন্দনকাননে। নামের মত এক নয়নাভিরাম গলিতে। আমাদের গলির নাম গোলাপ সিংহ লেইন। সূর্য সেনের সহযাত্রী বিতর্কিত বিপ্লবী অনন্ত সিংহের পিতার নামে এই গলি। বিতর্কিত কেন? এককালের এই বিপ্লবী পরে নাকি পথ হারিয়ে ফেলেছিলেন। তাঁকে জানবার জন্য যে গ্রন্থ তার নাম-ই ‘কেউ বলে বিপ্লবী, কেউ বলে ডাকাত”।
এই ডাকাতিয়া মনলোভা গলির মোড়ে পানাভরা পুকুরের ওপাশে বড় জায়গায় মাটির ঘর। টিনের চালা। আমাদের বন্ধু পূজনদের বাড়ি। পূজন এখন নীরেন্দ্রনাথের অমল কান্তি কবিতার মত “কেউ উকিল হতে চাওয়া” এক নামি অ্যাডভোকেট। তাদের বাড়ির পেছনে তাদের ভাড়ার ঘরে বাস করতো ভাবীকালের এক নামকরা চিত্রনায়িকা। তখন তাদের দুঃসময়। বাবা যাত্রা গানের পালা লেখেন, মা দু’বোনকে নিয়ে যাত্রা থিয়েটারের পার্টে অংশ নেয়ার সহযাত্রী।
সে বছর ঠিক হলো নন্দনকানন থেকে একটি নাটক মঞ্চস্থ করা হবে। তখন নাসির নামে আমাদের এক বন্ধু বাণিজ্যিক থিয়েটারের নায়ক হবার জন্য পাগল হয়ে আছে। মূলত তার উদ্যোগে ডেকে আনা হলো চট্রগ্রামের বাণিজ্যিক থিয়েটারের নামকরা পরিচালক বাবুল চৌধুরীকে। এক বিকেলে ক্রিকেট খেলতে যাবার ঠিক আগ মুহূর্তে আমাদের বাসায় হানা দিলো বড় ভাই আর অভিভাবকের দল। মা ভাবলেন আমি বোধহয় কিছু একটা করে এসেছি। সুশীল বা শান্ত বলতে যা বোঝায় তার লেশমাত্র ছিল না আমাতে।
কিন্তু না এবার তাদের আগমনের কারণ ছিল ভিন্ন। কেমন করে জানি তাদের মনে হয়েছিল আমিও অভিনয় পারি। এদের আবেদন বা আগ্রহ ফিরিয়ে দেবার কারণ ছিল না। ফলে তাদের সাথেই যেতে হলো। আমার চেহারা সুরত নিয়ে আমি বরাবর সচেতন। আমি জানতাম আমাকে বাসার চাকর আবদুল বা ড্রাইভারের পার্ট ছাড়া আর কিছুই দেয়া হবে না। মানবেও না। কিন্তু না। আমাকে আঠার বছর বয়সে দেয়া হল বুড়ো বাড়িওয়ালার পার্ট। সদ্য গোফ গজানো বয়সেই আমার ইচড়ে পাকামো ধরা পড়ে যায়। সেই শুরু।
এরপর চলে নাটকের রিহার্সেল। আমাদের স্কুল মিউনিসিপ্যাল মডেল হাই স্কুলের খোলা ঘরে রিহার্সেলে পরিচিত হলাম পরবর্তীকালে পর্দা কাঁপানো এই নায়িকার সাথে। না খুব সুখের নয় সেই স্মৃতি। ইংরেজি ডায়লগগুলো নিয়ে সে কি বিপদ। নাটকের এক জায়গায় নায়িকা নায়কের পাশের খবর শুনে বলবে: কনগ্র্যাচুলেশন হাসান। “কিন্তু নায়িকা বারবার বলে : কনসোলেশন হাসিন। কতবার যে মহড়া হলো সেটা ঠিক করতে। নাটক প্রদর্শনের দিন সন্ধ্যায় স্থানীয় মুসলিম হাই স্কুলে উপচে পড়া ভিড়। নাটকের এক দৃশ্যে নায়িকা আমার দিকে তাকিয়ে বলবে : ভেটকি মাছের মত হাঁ করে তাকান কেন?
প্রখ্যাত সেই নায়িকা সেদিন বলে কিনা : কেচকি মাছের মতো। শুনেতো আমার আক্কেল গুড়ুম। সামাল দেয়ার জন্য বানিয়ে বললাম আমাদের তোমার কেচকি মাছ মনে হয়? ভেটকিও চিনো না? সে ভুল থেকে পার হবার জায়গাটা ঠিকই ধরে নিয়েছিল নায়িকা। আরেক দৃশ্যে বাড়ি ভাড়া দিতে না পারার কারণে আমার পা ধরে মাফ চাইবে।
তাড়াহুড়োয় আমার হাতের লাঠি ধরে টানটানি করতে করতে ডায়লগ দিচ্ছিল: হেম কাকা আপনার পায়ে পড়ি, পা ধরি- মানুষের মধ্যে তখন মৃদু গুঞ্জন। উপস্থিত বুদ্ধি শানিয়ে বলেছিলাম : আরে তোমারে কি মাফ করবো তুমিতো পা আর লাঠির তফাৎ ই বোঝ না? সেখান থেকে চমৎকার উতরে গিয়েছিল নায়িকা। ম্যানজে করে নিয়েছিল দারুণভাবে।
পরবর্তীকালে বাংলাদেশের পর্দা কাঁপানো মানুষের মন হরণকারিনী বিশেষত আম জনতার বিপুল প্রিয় এই নায়িকা বেদের মেয়ে জোসনার ভেতর দিয়ে এক নতুন মাত্রা তৈরি করেন। যখন তার খ্যাতি তুঙ্গে তখন নাকি কোন এক পরিচালকের অন্যায় আবদার আর অত্যাচারে ঢাকা ছেড়ে কলকাতা পাড়ি জমান তিনি।
হতে পারে অতি আশা বা কলকাতার মোহেই চলে যান। মূলত তখন থেকেই আস্তে আস্তে আমাদের চোখের বাইরে চলে যাওয়া অঞ্জু ঘোষ অপরিচিত। কলকাতায়ও তার অবস্থান একসময় নড়বড়ে হয়ে ওঠে। সেখানকার ছায়াছবির জগৎ বড় গোলমেলে আর রাজনীতিতে ভরা। তাই ঠাঁই পাননি আর।
আজ বহুকাল পরে দেশের ইত্তেফাকে দেখলাম ভালো নেই তিনি। নাম যশ অর্থ কোন ভাবেই নাকি ভালো নেই। দেশে থাকলে অন্তত মানুষের ভালোবাসায় থাকতেন অঞ্জু ঘোষ। পরদেশে উদ্বাস্তু হবার কী যে প্রয়োজন কখনো বুঝি না আমি।
ভালো থাকুন অঞ্জু ঘোষ। তাকে খুব মনে পড়লো আজ। ক্রমাগত ওপরে ওঠা কাছ থেকে দেখা কারো পতনে দুঃখবোধ থাকাটাই তো মানবিক। তার নাম আমাদের মনে, স্মৃতিতে জাগরুক থাকবে।
লেখক: অজয় দাশগুপ্ত
(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)