ফিচার

প্রসব পরবর্তীকালীন বিষণ্ণতা এবং বেবি ব্লু ।। আলিফ আলম 

নরসুন্দা ডটকম   আগস্ট ২৮, ২০২০
প্রসব
প্রতি দুপুরের আলো ঠিক যেনো শেষ বিকেলে এসে বিষণ্ণ হয়ে স্মান হয়ে যায়। তবে কি বিকেল ও বিষণ্ণতায় ভুগে? হবে হয়ত। বিষণ্ণতা কোনো বিরল কিংবা আজব রোগ নয়। এটা যে কারো, যে  কোন সময় এবং যে কোন বয়সের মানুষেরই হতে পারে। এমনকি  নারী-পুরুষ উভয়ে এটার শিকার হতে দেখা যায়, তবে প্রসবের পর মায়ের বিষণ্ণতা বিষয়টা হয়ত আমার মত অনেকের  কাছে খানিকটা নতুন
সালটা ২০১৩। সবে সদ্য নতুন মা হলাম। জীবনের সুখ -দুঃখ, আনন্দ বেদনা ছাপিয়ে জীবন যেন মাতৃত্বের স্বাদ পেয়ে হঠাৎ খুব বেশি উজ্জ্বল হয়ে উঠল! হাসপাতালের একঘেয়ে ক’টা দিন পার করে যখন তিনদিনের ছেলেকে নিয়ে বাড়ি ফিরে আসলাম, এর ঠিক দুদিন পর ক্লিনিক থেকে একটা ফোন এল। একজন নার্স বাসায় এসে আমার সাথে দেখা করতে চায়। আর আমার এই দেখা করাটাও ছিল বাধ্যতামূলক তাই আমিও তাকে আমার সাথে দেখা করতে  আসার তারিখ আর দিন ক্ষণ বলে দিয়ে ফোন রাখলাম।
এর ঠিক একদিন পর তাকে দেয়া তারিখ আর সময় ধরে, সে এসে আমার বাসায় হাজির। নিজেকে আয়নায় একটু গুছিয়ে বসার ঘরে এসে দেখি, ছিপছিপে ফর্সা শরীর আর চোখা  নাকের এক তরুণী সেবিকা ঠোঁটে মিষ্টি হাসি মেখে, আমার বসার ঘরে সোফার উপর বসে আছে। হাতে নীল রঙের ফাইল আর একটা কলম। আমাকে দেখেই একটু নড়েচড়ে বসল। কিছুক্ষণ আমাকে খুব যত্ন করে লক্ষ্য করল। আমি তখনও জানি না সে কেন আমার সাথে দেখা করতে এসেছে। হঠাৎ সে হাসিমুখে বলে উঠল-
কেমন আছেন আপনি? কেমন লাগছে আপনার
আমি নিশ্চিত আপনি অনেক খুশি যে আপনি মা হয়েছেন! এদিকে আমার প্রসব যন্ত্রণা আর ছেলেকে পৃথিবীর আলো দেখানোর যুদ্ধের পর শরীর ভীষণ নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। তার উপর রাতজাগা শরীর যেন আমাকে ক্লান্তির শেষ সীমানায় পৌঁছে দিয়েছে। তাই বসে থাকতে কষ্ট  হচ্ছিল খুব। তবুও হাসিমুখে মাথা নেড়ে উত্তর দিলাম, আমি খুব আনন্দিত আমার ছেলের জন্য!
সে খুব স্বস্তির শ্বাস ফেলে মৃদু হেসে বলল, ডেলিভারির পর অনেক মায়ের প্রথম কয়েকদিন অথবা দুই সপ্তাহ খুব বিষণ্ণ লাগে। হরমোনের পরিবর্তন আর প্রসবের ক্লান্তির কারণে ঘন ঘন  মেজাজের তারতম্য হয়। এ সময় অনেক মায়েদের অযথা কাঁদতে দেখা যায়, যে সময়কে  আমরা ‘বেবি ব্লু ‘ বলি। এটা খুব স্বাভাবিক যা অনেক মায়েরদেরই হয়ে থাকে। আপনি কি এমন কোন সমস্যায় ভুগছেন? আমি জলদি উত্তর দিলাম, না, আমার তেমন কোন সমস্যা হচ্ছে না। কিন্তু আমি খুব আগ্রহ নিয়ে নার্সের কাছে জানতে চাইলাম, আমার এমন কিছু হলে  তখন আমি কি করব? ওনি ঝটপট উত্তর দিলেন, এ সময় আপনার পরিবার আর বন্ধুদের ভূমিকা খুব কাজে দেয়। তাই সম্ভব হলে তাদের সঙ্গে সময় কাটান। আপনি কেমন বোধ করছেন তা তাদের বলুন যেন তারা আপনার ভালমন্দ অবস্থা জানতে পারে। নিজের যত্ন নিতে পারেন কিংবা সময় পেলেই বাচ্চার সঙ্গে আপনিও একটু ঘুমিয়ে নিন। এতে আপনার ক্লান্তিভাব অনেকটাই কাটবে। তাছাড়া যারা ইতিমধ্যে নতুন বাবা মা হয়েছেন তাদের সঙ্গে কথা  বলতে পারেন। যতটা সম্ভব আপনার শিশুর সঙ্গ উপভোগ করুন। যদি কখনও আপনার কাঁদতে ইচ্ছে হয় তবে কাঁদুন। এটা খুব স্বাভাবিক। সব ঠিক হয়ে যাবে।
নার্সের কথা গুলো শুনতে কেন যেন তখন খুব ভাল লাগছিল। কথাগুলো শেষ করে একটু পরেই গম্ভীর হয়ে বলে উঠল, তবে এই বেবি ব্লু যদি দুই সপ্তাহের বেশি স্থায়ী হয় তবে তাকে আমরা প্রসব পরবর্তীকালীন ডিপ্রেশন বলি যা দশজনের মাঝে একজন মায়ের হয়ে থাকে। আমরা আরও জেনেছি যে বাচ্চা হবার আগে কিংবা পরে বাবাদের ও মায়েরদের মত এই ধরণের মানসিক সমস্যা হতে পারে যাকে ‘সাইকোলজিকাল ডিসট্রেস’ বলে। এ সময় মায়েরদের মাঝে ক্ষুধা আর ওজন খুব করে কমে কিংবা বেড়ে যেতে পারে। আপনার কি এমন কিছু হচ্ছে? আমি খুব সরলভাবেই উত্তর দিলাম, প্রথম ৩-৪ দিন আমার খুব ক্ষুধা পেত তবে এখন আমি ঠিক আছি। সে খসখস শব্দে আমার কথাগুলো তার ফাইলে লিখে  ফেলল তারপর আমার দিকে মুখ তুলে বলল, আপনার গর্ভকালীন সময়ে আপনি হাসপাতাল থেকে যে বইটা পেয়েছেন সেখানেও এ ব্যাপারে বিস্তারিত উল্লেখ রয়েছে। আপনি চাইলে  আবারও তা পড়ে দেখতে পারেন।
এ সময় অনেকে অকারণে কাঁদে, বুঝতে পারে না কি করবে? অনেকে আবার স্বাভাবিক কাজ করতে ও অক্ষম হয়ে যায়। আমি আপনাকে এ ব্যাপারে একটা সাধারণ ধারণা দিলাম, আপনি  যদি কখনও বাড়াবাড়ি রকমের এমন কিছু বোধ করেন তবে অবশ্যই আপনার ডাক্তার এর সাথে যোগাযোগ করবেন। আমার হাজবেন্ড পাশ থেকে দাঁড়িয়ে কথাগুলো চুপচাপ শুনছিল। নার্স চলে যাবার পর বর কে খেয়াল করছিলাম, হাসপাতালে থাকা অবস্থা থেকেই তার মেজাজ বিগড়ে আছে। অল্পতেই রেগে যাচ্ছে। তবে কি সে বাচ্চা হবার জন্য খুশি নয়! আমার বাঁধ ভাঙ্গা আনন্দের মাঝেও ব্যাপারটা আমাকে কষ্ট দিচ্ছিল। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে বিষয়টা স্বাভাবিক। এটা একজন বাবার বেলায় ও হতে পারে। এ কদিনে মনে হল একটা বাচ্চা বাবা-মায়ের জীবনকে এলোমেলো করে দেয় না তবে নিশ্চিত পাল্টে দেয়। জীবনের এই নতুন পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে বাবা-মা উভয়েরই  কিছুটা সমস্যা হতে পারে। নার্স চলে যাবার পর তাকে  আড়চোখে লক্ষ করছিলাম। তার আচরণের হঠাৎপরিবর্তনগুলো এখন আর অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। কারণ নতুন বাবারাও তো পরোক্ষভাবে এই ডিপ্রেশনের শিকার হয়।
হাসপাতাল থেকে পাওয়া বইটা বহুবার উল্টে পাল্টে দেখছি তবে এই বিষয়টা হয়ত চোখে পড়েনি কিংবা তেমন জরুরী নয় বলে এড়িয়ে গেছি। সূচিপত্র ধরে এগুতেই তথ্য গুলো চোখে পড়ল: যখন কেউ ডেলিভারির পর এই ডিপ্রেশনের শিকার হয় তখন তার  ঘুমের সমস্যা,  ক্লান্তি, মন যোগের অভাব আবার কখনও কেউ কেউ বাচ্চার সঙ্গে তার আবেগি যোগাযোগ ঘটাতে না পারার সমস্যায় ও ভুগতে পারে। তবে কারো কারো বেলায় আত্মহত্যার চিন্তা ও মাথায় আসতে পারে। এই ডিপ্রেশনের জন্য কোন এক মা তার বাচ্চাকে মেরে ফেলেছে, এমন ঘটনা ও ঘটতে দেখা গেছে। আর এ সমস্যা যে কেবল মায়েরা ভুগে থাকেন তা নয়, বাবারাও ভুগতে পারেন। তবে তাদের প্রকাশ থাকে অন্যরকম।
যেমন, আক্রমানাতক মনোভাব,  মেজাজের তারতম্য, পেট অথবা মাথা ব্যথা ইত্যাদি।  উৎস: ( National Institute of Public health in Quebec) যাকে ফরাসি ভাষায় সংক্ষেপে INSPQ বলে ।
তবে  এ ব্যাপারে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং পরিবার পরিকল্পনা বিভাগে কর্মরত ডা. ইয়াসমিন খুরশিদ যা বলেন-
বাচ্চা হবার পর হরমোনের পরিবর্তনের কারণে প্রায় ৮০ ভাগ মায়েই এই বেবিব্লুতে ভুগে থাকেন যা প্রসবের কয়েকদিন থেকে দুই সপ্তাহ পর্যন্ত স্থায়ী হয়  যাকে আমরা’ অস্থায়ী ডিপ্রেশন’ বলি। এটা খুব স্বাভাবিক বিষয়। এ সময় মায়েদের  মেজাজ  পরিবর্তনের হয় খুব বেশি। তবে এই অস্থায়ী ডিপ্রেশন যদি দুই সপ্তাহের বেশি থাকে তবে তাকে  আমরা ‘পোস্ট পারটম ডিপ্রেশন’ বলি। এই সময় পারিবারিক সাপোর্ট খুব জরুরী। তবে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। একজন মা যেন এ সময় পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘুমাতে পারেন সেদিকটায় খেয়াল রাখতে হবে। আবার ঘুমের মত পুষ্টিকর খাবার ও খুব দরকার। যে খাবার গুলো মেজাজ ভাল রাখতে সাহায্য করে, সে খাবারগুলো বেশি করে মাকে খাওয়াতে হবে। যেমন: ডিম, চকলেট,কলা, পপকর্ণ ইত্যাদি।
তিনি আর ও বলেন, এ সময় একজন মায়ের যে সারাক্ষণ তার  বাচ্চার সাথে থাকতে হবে তা নয়, বরং মা যেন বিশ্রামের পাশাপাশি তার আগের ভাল লাগার কাজগুলো করতে পারে। তা হতে পারে বই পড়া ,গান শুনা অথবা টিভি দেখা। এক্ষেত্রে স্বামী বা পরিবারেরের অন্য সদস্যদের অবশ্যই মাকে সার্বিক সাহায্য সহযোগিতা  করতে হবে।  প্রকৃতপক্ষে,  আমাদের মায়েদের স্বাস্থ্য খুব গুরুত্বপূর্ণ তবে দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, আমাদের দেশে এই মায়ের স্বাস্থ্যকেই অনেক অবহেলিত হতে দেখা যায় । এমনকি গর্ভকালীন অবস্থায় সঠিক পারিবারিক যত্ন আর পুষ্টির অভাবে একজন মা এই’ পোস্ট পারটম ডিপ্রেশন’ এ ভুগতে পারেন তাই গর্ভকালীন সময়ে মায়ের সঠিক শারীরিক এবং মানসিক যত্ন নেয়া খুব জরুরী। কারণ যে মা তার সন্তানকে লালন-পালন করবেন তাকে সার্বিকভাবে  সুস্থ থাকা কিংবা পারিবারিকভাবে সুস্থ রাখা প্রতিটি পরিবারের দায়িত্ব। মায়েদের স্বাস্থ্য রক্ষায় আমাদের সবার এ ব্যাপারে সজাগ আর সচেতন হওয়া প্রয়োজন।
আমাদের সন্তান আমাদের জীবনের অনেক বড় এবং মূল্যবান উপহার। সে  চিরকাল ছোট থাকবে না কিংবা সারারাত কান্নাকাটি করে আপনাকে রাত জাগাবে না। বাচ্চা হবার পর সব মায়েদের ই কষ্ট হয় তবে তা অল্প কিছু দিনের জন্য। তারপর সব ঠিক হয়ে যায়। যে সন্তান সারাজীবন আপনার সকল আনন্দের খোরাক হয়ে আপনাকে আনন্দের স্রোতে ভাসাবে বলে আপনার জীবনে এসেছে,তার জন্য তো একটু কষ্ট সহ্য করতেই হবে। আর সন্তান যখন আপনার সামনে হাসবে, খেলবে তখন এই শারীরিক ক্লান্তি আর জীবনের এই কিছুদিনের রঙ চটা  ফিকে সময় হয়ত একদিন আপনার মনে ও থাকবে না।

আলিফ আলম, লেখক, কানাডা।

About the author

নরসুন্দা ডটকম