ফিচার

খাদ্যাভ্যাস ও শরীরচর্চায় যেভাবে সাজাতে পারেন আপনার দিনলিপি

নরসুন্দা ডটকম   আগস্ট ২৯, ২০২০
খাদ্যাভ্যাস

তাহ্ নিয়া কাদের ।। স্বাস্থ্য সুরক্ষায় খাদ্যাভ্যাস ও শরীরচর্চা উতপ্রতভাবে জড়িত। প্রথমত আমাদের দেশে খাবারের মোড়কে ক্যালোরির পরিমান থাকে না, তাই কী পরিমান ক্যালোরি রোজ শরীরে প্রবেশ করছে তার হিসেব রাখা কিছুটা কঠিন যদি না আপনি নিজ থেকে নিজের খাবারে কী কী গ্রহণ করছেন তার হিসেব রাখেন। অন্যদিকে, নগর যদি সাজানো থাকে এমনভাবে যে আপনি সিঁড়ির ধাপ কতোটুকু পেরুলে কত ক্যালোরি ফুরাচ্ছে বা কত কিলোমিটার হেঁটে আসার পর আপনার স্মার্ট ওয়াচটি বলে দিচ্ছে আপনার রোজকার টার্গেট ক্যালোরি বার্ন হয়েছে কিনা তাহলে তো কথাই নেই। যদি তাও না পারা যায় তারপরেও আছে হাজার পথ বলে দিতে আপনার প্রতিদিনের খাবারে আপনি কী খাচ্ছেন তা কতোটুকু উপকারী আর কতখানি ক্ষতিকারক।

ইন্টারনেট এর গতি এখন সবার হাত ছুঁয়ে সর্বক্ষণ আমাদের সেবা দিয়ে যাচ্ছে। আপনি চাইলেই তার যথাযথ ব্যাবহার খাদ্যাভ্যাস বা শরীরচর্চায় করতে পারেন। যেমন- আপনার খাবারটা সম্পর্কে সচেতন হতে তা সম্পর্কে জেনে খেতে পারেন। যা কী না জাপান-কোরিয়ার মতো দেশগুলি তাদের স্কুলে বাচ্চাদের খাবার আগে তার পুষ্টিগুণ বা উপকারিতা সম্পর্কে শিখিয়ে থাকে।

সকালের নাস্তা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। দিনের শুরুটায় পরিপূর্ণভাবে খেয়ে উদ্দাম শরীর- মন নিয়ে কাজ শুরু করতে পারেন। সেক্ষেত্রে যদি আপনার ভোরে জাগার অভ্যাস থাকে তাহলে সকালের খাবারটাকে দুইভাগে ভাগ করে নিতে পারেন। সকালটা শুরু করতে পারেন কুসুম গরম পানি দিয়ে। ইচ্ছা হলে তাতে মেশাতে পারেন লেবু, মধু কিংবা গ্রিন টি। ফ্যাটের বিপরীতে এর জুরি নেই। পাশাপাশি কুসুম গরম পানি আপনার পুরো সিস্টেমটাকে পরিস্কার রাখে। তারপর অন্তত ৩০ মিনিটের বিরতিতে খেয়ে নিতে পারেন মূল নাস্তা। হাই ফাইবার খাবার এলাও করতে পারেন সকাল বেলাতেই। যোগ করতে পারেন দুধ, সাথে যদি মেশান কাঠ বাদাম তাহলে পেতে পারেন সুস্থ সুন্দর ত্বকও অথবা দুধে কনফ্লেক্সও সকালের খাবার জলদি সারতে খেতে পারেন। এছাড়া মেইন খাবারে রাখতে পারেন পাউরুটি টোস্ট সাথে ২/৩ টা ডিমের সাদা অংশ, সবুজ সব্জির সাথে আটার ১/২ টা রুটি (সাদা পাউরুটি/আটা পরিহার করে ব্রাউন আটা খাবারে যোগ করা উত্তম), কিছু ফল মেশানো ওটস মিল এই যা। কারো কারো আমার মতন আবার সুগার কমে যাওয়ার সমস্যা থাকতে পারে, সেক্ষেত্রে সারাদিন সুগার এড়াতে চাইলেও সকাল বেলাটায় সুগার অল্প মাত্রায় অথবা বাজারে জিরো ক্যালোরি অল্টারনেটিভ যেটা পাওয়া যায় সেটাও খেয়ে নিতে পারেন। এছাড়া চিনি কিন্তু যমের চেয়ে কম ভয়ঙ্কর নয়। যতটা সম্ভব তাই চিনি বা চিনি জাতিও খাবার এড়িয়ে চলুন।

এইতো  গেলো ফুল প্যাকেজে দিনের শুরুর খাবার। কিন্তু দুপুরের খাবারের জন্য বসে থেকে খাবারে দীর্ঘ বিরতি না নিয়ে দুই ঘণ্টা পর একটা ফল, টক দই (০-২০ক্যালরির, ২/৪ চা চামচ) কিংবা মিষ্টি একটা আলু গ্রিল করে উপরে একটু চাট মসলা ছিতিয়ে খেয়ে নিতে পারেন। আসলে ইচ্ছা করলেই খাবারটা আপনার নিজস্ব রুচিতে সাথে স্বাস্থ্যসম্মত ভাবে খেতে পারেন। আর দুই ঘণ্টা বিরতিতে খাবারে আপনার এনার্জি লেভেল যেমন ঠিক থাকবে আর ক্ষুধা ও লাগতে দিবে না। দীর্ঘ বিরতিতে খাবারে ক্লান্তি, ক্ষুধা দুইই বেশি থাকে বলে পরিমানে বেশি খাবার সম্ভবনা থাকে। এতে করে ওজন আর ক্লান্তি দুটোই বেড়ে যায়। তাই কিছুটা বিরতিতে অল্প খেয়ে নেয়ায় স্বাস্থ্য ঝুঁকি থাকে না।

দুপুরে রেগুলার খাবার পরিমিত পরিমানে খেতে পারেন। রাখতে পারেন তাতে অল্প পরিমানে ভাত, ডাল, মাছ, মাংস যেন যারা কাজে থাকেন তাদের ভোজ পরবর্তী ঝিমানো চলে না আসে। যাদের উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা রয়েছে তাদের জন্যও দুপুরে বেশি পরিমান খাওয়াটা বিপদজনক। এছাড়া যাদের সঙ্গি ডায়বেটি কস হয়েছে তারা দুপুরের খাবারটাকেও দুই ভাগে ভাগ করতে পারেন। সেক্ষেত্রে দুপুর ১টায় একটা ব্রাউন আটার রুটি সবুজ এক বাটি শাঁক অথবা সবজি, সালাদের সাথে খেয়ে ২ ঘণ্টা পর এক বাটি ভাত মাছ কিংবা মাংসের সাথে খেতে পারেন। অতিরিক্ত ওজন বা স্থুলতায়ও এ কিভাবে দুপুরের খাবারটা পারফেক্ট করতে পারেন।

বাকি রইলো রাতের খাবার। ওজন ঠিক রাখতে এবং বিভিন্ন প্রকার শারীরিক সমস্যা এড়াতে রাতের খাবার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভাত সেক্ষেত্রে একদমই না খেতে পারলে ভালো। আর যদি ভাত না খেয়ে একদমই না থাকতে পারেন সেক্ষেত্রে এক কাপ পরিমানে ভাত রাত ৮ টার আশপাশে খেয়ে নেবেন। রাতের খাবারে এছাড়াও আটা বা ময়দার রুটি ১/২ টা  এবং (ব্রাউনটা আটা বরাবরই উত্তম, সাদা টা বর্জন করবেন একেবারে) সাথে মাছ বা সবজি, ওটস মিলও এইবেলা সব্জিতে মিক্স করে খেলে হয়, এছাড়া যেকোনো সুপ সেটা হতে পারে সবজি/ টমেটো/ চিকেন স্টক/কর্ণ এর প্রাধান্যে। যদি কার্বো-হাইড্রেট একেবারেই না নিতে চান বা বাড়তি ওজন, স্থুলতা আপনাকে কমাতে হয় তাহলে শুধু সুপ খাওয়াই ভালো। বাজারে বিভিন্ন রকম ইজি প্রসেজ সুপের প্যাক পাওয়া যায়, তবে বিভিন্ন সব্জির মিশ্রণে বা চিকেন স্টক সুপ ঘরে ফ্রেশ করে তৈরি করে খেতে পারলেই উত্তম। রাতের খাবারে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে খাবার সময়। রাতের খাবারের সবচেয়ে আদর্শ সময় হল সন্ধ্যা ৭ টা থেকে ৮ টার মধ্যে। এতে করে ঘুমের সাথে ২-৩ ঘণ্টা বিরতি থাকে আর যাতে ঘুমের সময় খাবার শরীরে আকদম অপরিপক্ক অবস্থায় থাকে না।

খাবার নির্ধারিত সময়ে গ্রহণ কতটা জরুরী সেটা অনেকের অজানা আবার কেউ জেনেও তা অবহেলা করেন। এখাণে নির্ধারিত সময় বলতে যে বেলায় আপনি রোজ সকাল, দুপুর, রাতের কিংবা বিরতির খাবারগুলো খাচ্ছেন তার সময় প্রতিদিন একি রাখা। এতে করে আমাদের শরীরের তারতম্য সঠিক থাকে এবং এনার্জি লেভেল ঠিক থাকে। ক্ষুধার সাথে কিন্তু আমাদের মাথার কিংবা মানসিক সম্পর্ক। সময় অনুযায়ী ক্ষুধা লাগেও আমাদের মানসিক বা মনে, পেট কিংবা শরীরে নয়। শরীর ক্লান্ত হয় এই যা। আরেকটু সহজ করার চেষ্টা করছি, অনার্সে পড়াকালীন এক কোর্সে একটা বিশেষ থিউরি পড়েছিলাম। যেখানে ওই তত্ত্বের জনক এক কুকুর দিয়ে তার এক্সপেরিমেন্ট করেছিলেন। একটি ঘরে কুকুরটাকে ঢুকিয়ে সাথে রেখেছিলেন একটা পেন্ডুলাম ঘড়ি। ঘড়িটায় যখনি ঢং ঢং শব্দ বাজত ঠিক তখনি কুকুরটার সামনে খাবার দেয়া হতো। ঠিক এভাবে কয়েক দিন ঘড়ির ঢং ঢং আওয়াজের সাথে খাবার দেয়ার পর একদিন তিনি খাবার দিলেন না। জনাব বিজ্ঞানী দেখতে চেয়েছিলেন খাবার না দেয়ার পরেও ঢং ঢং শব্দের সাথে কুকুরের মুখে লালা সৃষ্টি হয় কি না। ঠিকই দেখলেন সামনে খাবার না থাকা সর্তেও কুকুরটির লালা সৃষ্টি হচ্ছে। তিনি প্রমান করতে চেয়েছিলেন মস্তিষ্কের সাথে ক্ষুদার সম্পর্ক আর তাতে সময়ের যোগসূত্রতা। খাওয়ার সময় পার হলে আমরা ক্লান্ত না হলেও আমাদের অবচেতন মন আমাদের নক করতে থাকে আর যাতে করে তা আমাদের শরীরে, কাজে প্রভাব ফেলতে থাকে।

নিত্য কাজে শরীরকে চর্চায় রাখতে পারেন যেভাবে

সারাদিন ঘরে বা বাইরে যেখানে থাকুন না কেন একটিভ থাকার চেষ্টা করুন। হয়তো আপনি গৃহিণী বাইরে কাজ খুব একটা থাকে না, তাহলে ঘরের কাজ করার সময় এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় খুব দ্রুত মুভ করুন অর্থাৎ দৌড়ে যান কিংবা ঘরের ভেতরই জোরে হাঁটার অভ্যাস করুন।

এছাড়া প্রতিদিন হাঁটার জন্য সময় আলাদা করে রাখুন ৩০-৬০ মিনিট । হোকনা তা পথে, ছাদে বা ঘরের বারান্দায় তাও সময়টা তুলে রাখুন হাঁটতে আর এক গবেষণায় বলে হাঁটার সময় হাসিমুখ করে হালকা গান শুনতে শুনতে ১০ মিনিট পার করলে শরীরের সাথে সাথে আপনার মন চর্চাও হয়ে যায়। সারাদিনের ক্লান্তি মুছে নতুন উদ্দাম এনে দেয় প্রশান্তির সাথে।

বেশীর ভাগ মানুষ এক্সারসাইজ বা ভারী ব্যায়াম করতে পছন্দ করেন না। এতে সমাধান একটাই, যে যা করতে পছন্দ করেন তাতেই নিত্যদিনের এক্সারসাইজ সেরে নিতে পারেন। কেউ স্পোর্টস পছন্দ করেন তো ব্যাডমিন্টন বা স্কিপিং করতে পারেন রোজ সময় বরাদ্দ রেখে। এছাড়া যারা নাচ ভালোবাসেন তারা নিয়ম বেধে করতে পারেন অ্যারোবিক। সেজন্য অ্যারোবিক ক্লাসে যাওয়া সম্ভব না হলে ইউটিউব থেকে ঘরেই করে নিতে পারেন নিজের ক্লাসগুলো। সেক্ষেত্রে হাজারো ভিডিও পাবেন অ্যারোবিকসের বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ভাষা্য় ইউটিউবে। পছন্দমত শারীরিক করসতে উপকারের পাশাপাশি আনন্দও মিলে আর সেসাথে মনটাকে অনেক তরুণ করে তোলে।

নিয়মিত নামাজ পরতে পারেন। নামাজে শরীরের কাজই শুধু হয় না, ব্যাপক আঁকারে মনকে প্রশান্ত করে। তাই নামাজকে আপনি অদ্বিতীয় মেডিটেশন বলতে পারেন। যেখানে আপনি জানেন একজনের কাছে নির্দ্বিধায় আপনার পুরো মনটাকে খুলে ধরতে পারেন। প্রার্থনা তাই শরীর-মন দুটোর জন্যই উপকারী। সেক্ষেত্রে আপনি যে ধর্মের অনুসারী হন না কেন। মনের স্বাস্থ্যের প্রতি অবহেলা ধীরে ধরে শরীরে পরতে শুরু করে তাই সময়মত যত্ন নিন যতটুকুই পারুন ভালো থাকার চেষ্টা করুন।

লেখক: তাহ্ নিয়া কাদের, সাউথ কোরিয়া


তাহ্ নিয়া কাদের এর আরও লেখা 

সুস্বাস্থ্য সম্পর্কে জানতে হবে ।। তাহ্ নিয়া কাদের

About the author

নরসুন্দা ডটকম