এই লেখাটি একবার ভেবেছিলাম লিখবোনা। পরে ভাবলাম বিভ্রান্তি দূর করার জন্য লেখাটি দরকার। প্রায় বছর দুয়েক আগের কথা। বাংলাদেশে গিয়েছি। চিশতি ইকবাল নামে এক ভদ্রলোকের সাথে পরিচয় হল। তিনি একজন এন্টারটেইনমেন্ট ল-ইয়ার। বাংলাদেশের মিডিয়া বা স্পোর্টস এর সব বিগশট দেখলাম ওনার ক্লায়েন্ট। খুব মাই ডিয়ার টাইপের লোক। কোন কারন ছাড়াই তিনি আমার সঙ্গে কাজ করার খুব আগ্রহ প্রকাশ করলেন। আমি খুবই ইতস্তত করে বললাম, আমি তো তেমন রাঘব বোয়াল না, আপনার তো সব তাদের সাথেই কাজ! তারপরও তিনি নাছোড়বান্দা। একের পর এক প্রজেক্টের কথা বলে যাচ্ছেন। সবই খুব লুক্রেটিভ প্রজেক্টস। মিটিং হচ্ছে, ডিনার হচ্ছে, লাঞ্চ হচ্ছে, কফি হচ্ছে, একাকার অবস্থা। কিন্তু এতকিছু হবার পরও কেন জানি কোন প্রজেক্টে ব্যাটে বলে হচ্ছিল না। অবশেষে একটা হলো, মানে এটলিস্ট তখন মনে হচ্ছিল যে হয়েছে। প্রজেক্টের নাম মাসুদ রানা!
চিশতি ভাই বললেন, সিনেমার রাইটস নিয়ে নিচ্ছেন মাসুদ রানার। প্রথম তিনটি গল্প নিয়ে কাজ শুরু হবে। আমি কাজ করবো স্ক্রিন রাইটার হিসেবে এবং ভিজুয়্যাল এফেক্টস এ। আমার জন্য যা নিঃসন্দেহে একটা অনারের কাজ। মাসুদ রানা প্রচন্ড ভালবাসার একটা চরিত্র। তাকে ঠিক মত ফুটিয়ে তোলার চ্যালেঞ্জ তো খুব এক্সাইটিং। শুনলাম বিশাল বড় প্রজেক্ট হবে। জ্যাজ মাল্টিমিডিয়া প্রডিউস করবে। ইউনিলিভার স্পনসর করবে রিয়েলিটি শো, যেখান থেকে উঠে আসবে মাসুদ রানা।
দুই দফায় দুইজন বাংলাদেশী ডিরেক্টরের সঙ্গেও কথা হলো। রাইটার হিসেবে জানতে চাচ্ছিলাম নির্দেশকের ভিশনটা কি, যাতে ওই আদলে লেখা যায়। মাসুদ রানা তো চাইলেই জেমস বন্ডের আদলে হয়। কিন্তু আমার কাছে মনে হল অন্তত আমাদের দেশের পার্স্পেক্টিভে সে আরো গভীর কিছু অর্থ বহন করে। গল্প আধুনিকায়ন করতে হবে এবং করতে হবে বেশ কিছু সংযোজন। কথা হলো যে কপিরাইট কিনে নেয়ার পর, ইউনিলিভারের সাথে চুক্তি ফাইনাল হলে মূল স্ক্রিপ্টের গল্পে হাত দিব। এর মধ্যে ইউনিলিভারের জন্য বিজ্ঞাপনের স্ক্রিপ্টিংও করলাম। সেখানে নোটস আসলো। রি-রাইট করে আবার জমা দিলাম। টাকা পয়সা কোন কিছু চাইলাম না, কারন আমার মাথায় তখন মাসুদ রানা কে ওয়ার্ল্ডক্লাস ভাবে প্রেজেন্টেশনের স্বপ্ন।
যাই হোক, রাইটসের ঝামেলা মিটলো। ইউনিলিভারের সাথেও চুক্তি পাকা। এর মধ্যে এক বছরের বেশি সময় চলে গেছে। আমার এবার গল্প লেখার পালা। এই সময়ের মধ্যে ব্যাপারটা আবার এমন দাঁড়িয়েছে যে, স্ক্রিপ্টিং এর আগে গল্পটা লিখে আমি জমা দিব। যদি গল্প পছন্দ হয় তাহলে স্ক্রিন রাইটার হিসেবে কাজ করবো। আমি সেটাতেও রাজি। আমি যেহেতু বেশ অনেক বছর ধরে প্রফেশনালি এ ধরণের কাজ করে আসছি, আমি জানি অনেক কারণেই একটা প্রজেক্টে একজন মানুষ কাজ না করতে পারে। জাস্ট ব্যাটে বলে হয় না। এটা পার্সোনালি নেয়ার কিছু নেই।
আমি লেখা শুরু করলাম। ফার্স্ট এক্ট লিখে শেয়ার করলাম চিশতি ভাইয়ের সাথে। সেই প্রথম জ্যাজ মাল্টিমিডিয়ার আজিজ ভাইয়ের সাথেও পরিচয় হলো। ওনারা দুজনেই নানা রকম সাজেশন দিলেন। কি কি মোডিফিকেশন করা যায়, চেঞ্জ করা যায়, সংযুক্ত করা যায় বা বাদ দেয়া যায় এ নিয়ে বিশদ কথা হয় আজিজ ভাইয়ের সাথে ফোনে। চিশতি ভাই লিখিত নোট দিলেন। আমি দুজনের নোট বিবেচনা করে, সময় নিয়ে গল্পটি শেষ করলাম। ফার্স্ট, সেকেন্ড এবং থার্ড এক্টে ভাগ করে জমা দিলাম ওনাদের কাছে। তখন বাংলাদেশে নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন মাত্র শুরু হচ্ছে। চিশতি ভাই আমাকে জানালেন পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হলে উনি বসবেন আমার সাথে গল্পটি নিয়ে।
আমি খুব ঘনিষ্ঠ একজন দুইজন ছাড়া এদিকে কাউকে বলিনি যে এরকম কাজ করতে পারি। কারন, যদি শেষ পর্যন্ত না হয়, কিছু তো কনফার্ম না। আগে থেকে কেন বলবো। কি করে কি করে যেন কয়েকটা পত্রপত্রিকায় এবং অনলাইন গ্ৰুপে আমার নাম আসলো প্রজেক্টের সঙ্গে। আমি খুবই লজ্জ্বিত হলাম। কোন কিছু ফাইনাল না। এর মধ্যে কি এইসব নিউজ। তারপর একদিন হঠাৎ করে আমাকে ইনবক্সে খুব ঘনিষ্ঠ একজন বড় ভাই একটা নিউজ শেয়ার করলেন। মাসুদ রানা নিয়ে জ্যাজ মাল্টিমিডিয়ার অফিশিয়াল স্টেটমেন্ট। বিশাল আয়োজন করেই নামছে তারা। কিন্তু সেই আয়োজনের কোথাও আমি নেই. রাইটার এবং ভিজুয়াল এফেক্টস দুই জায়গাতেই অন্য মানুষের নাম।
আমি বেশ অপ্রস্তুত হলাম। প্রায় ২ বছর প্রজেক্টার জন্য অন এন্ড অফ কাজ করলাম। কখনো কোন টাকা পয়সা চাইনি, বা চাচ্ছিও না! আপাত দৃষ্টিতে খুব কম কাজ মনে করলেও নিজের হাজার ব্যস্ততার মধ্যে মাথা তো ঘামিয়েছিলাম? আমার কাজ পছন্দ নাইই হতে পারে, বা প্রজেক্টের সাথে ইন লাইনে নাইই হতে পারে। সেটা নিয়ে আমার কোন সমস্যা নেই। আমার অপ্রস্তুতের কারনটা হচ্ছে, প্রফেশনাল ভদ্রতাটা মনে হয় আমার প্রাপ্য ছিল। সেটা পেলাম না দেখে একটু অবাক হলাম, আহত হলাম! শুকনো মুখের একটা ধন্যবাদও পাব না, এইটা আশা করিনি। ব্যাপারটা দুঃখজনক।
তারপরও আমি মাসুদ রানার এই প্রজেক্টের জন্য অনেক অনেক শুভকামনা জানাই। আমি কাজ করতে পারছিনা, ইটস ওকে। প্রজেক্টটা নামবে এটাই বড় কথা, বিশেষ করে বাংলাদেশের সিনেমার জন্য। যে পরিকল্পনা নিয়ে জ্যাজ মাল্টিমিডিয়া নেমেছে, বাংলাদেশের ইতিহাসে তা এক অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। Abdul Aziz ভাইয়ের জন্য, Chisti Iqbal ভাইয়ের জন্য, এবং প্রজেক্টের সংশ্লিষ্ট সবার জন্য থাকলো অনেক অনেক শুভ কামনা। অল্প যারা মানুষ হতাশ হলেন আমি নেই শুনে, তাদের কে বলছি, আপনাদের ভালবাসার জন্য ধন্যবাদ। নিশ্চয়ই একদিন কোন না কোন বাংলাদেশের সিনেমায় তো কাজ করবোই! এবং সেটা আপনাদের জন্যই করা হবে। আশা করি এই লেখায় মাসুদ রানা সিনেমাটির সঙ্গে আমার সংশ্লিষ্টতা সংক্রান্ত সকল বিভ্রান্তির অবসান হবে। সবাই ভাল থাকবেন। বেশি করে বাংলাদেশী সিনেমা দেখবেন!
১৪ অক্টোবর ২০১৮। লেখকের ফেসবুক পেজ থেকে নেয়া।