ওয়াহিদ ইবনে রেজা >>
মানুষ হিসেবে আমি পাগলদের খুব পছন্দ করি। নিজে পাগল বা সার্টিফায়েড উন্মাদ বলেই বোধহয় তাদের প্রতি আমার এক ধরণের মমতা কাজ করে। বিশেষ করে, যারা নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে নিজের প্যাশনের বিষয়ে কচ্ছপের মত কামড় দিয়ে ধরে বসে থাকে, তাদের প্রতি আমার ভালবাসার শেষ নেই। এমন একজন মানুষ হচ্ছেন (Mohammad Shihab Uddin) আরিফ ভাই। উনার সাথে ফেইসবুকে পরিচয়। যতদূর মনে পরে উনি নিজেই পরিচিত হয়েছিলেন। বাংলাদেশে এনিমেশন নিয়ে কাজ করেন তিনি। সেই “মিনা” থেকে শুরু করে দেশের সব বড় বড় এনিমেশন প্রোডাকশনের ছিলেন। আমাকে ওনাদের অর্গানাইজেশন AITA-তে মেম্বার করিয়ে দেন। এই অর্গানাইজেশন ব্যাসিক্যালি বাংলাদেশের ডিজিটাল আর্টিস্টদের একটি মিলন মেলা।
আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখা, আমাদের যে কোন অর্গানাইজেশন সব সময় খুব দ্রুত দুইভাগ হয়ে যায়। আওয়ামীলীগ-বিএনপি, আবাহনী-মহামেডান, আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল! লাগে ধুম ধারাক্কা মারামারি। আমাকে আরিফ ভাই বললেন তারা চাচ্ছেন এই অর্গানাইজেশনের মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষকে এনিমেশন এবং সিজি কাজের সম্পর্কে উৎসাহী করতে, এনিমেশন নিয়ে নতুন নতুন কাজ করতে। আমি মনে মনে বললাম, আমাদের কপাল এত ভাল হইলে তো হইসিলোই। মুখে কিছু বললাম না। হাসি মুখে মাথা নেড়ে সায় দিলাম।
কিছুদিনের মধ্যেই আরিফ ভাই এবং সংশ্লিষ্টরা আমার ভুল ভাঙালেন। আয়োজন করলেন এনিমেশন মেলা। এনিমেশনে নেক্সট জেনারেশন কে উৎসাহ দিতে কি চমৎকার উদ্যোগ! আরিফ ভাই “শাহানা” নামে চমৎকার একটি সিরিজ করেছেন সচেতনতা মূলক। সেটা দেখালেন। আমি মুগ্ধ হলাম। কারন আমি জানি কি পরিমান সীমাবদ্ধতায় আমাদের কাজ করতে হয়। রিসোর্স নেই, বাজেট নেই, সময় নেই! এত নেই এর মাঝে আছে শুধু ইচ্ছা আর লেগে থাকা! আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম আরিফ ভাইয়ের লেগে থাকার ক্ষমতা সুপার গ্লুর কাছাকাছি। উনি খান এনিমেশন, ঘুমান এনিমেশন, বাথরুমও করেন এনিমেশন! তখন থেকে ওনার প্রতি আমার শ্রদ্ধা এবং ভালবাসা বাড়তে থাকলো। দুজনে মিলে প্রায়ই গল্প করি। এনিমেশন ভিএফএক্স নিয়ে ভাল আড্ডা হয়। আড্ডার পাশাপাশি ওনার কাজ দেখি। কি সুন্দর সুন্দর কাজ! একেবারে আন্তর্জাতিক মানের। আমি নিশ্চিত চাইলেই উনি দেশের বাইরে যে কোন স্টুডিও তে কাজ করতে পারবেন। কিন্তু আরিফ ভাই তো সেটা চাননা। উনি চান বাংলাদেশে কাজ করে বাংলাদেশের এনিমেশন ইন্ডাস্ট্রি ডেভেলপ করতে। পাগল কি আর সাধে বলি!
গত বছর উনি আমাকে দেখালেন ওনার নেক্সট প্রজেক্ট। দীপ্ত টিভির জন্য ২০ মিনিটের একটি শর্ট ফিল্ম, নাম Tomorrow । ফুল সিজি! খুব এম্বিশাস একটা প্রজেক্ট। উনি তখন আমাকে কিছু টেস্ট ফ্রেম দেখালেন। আমি একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। খুব খুব খুব ভাল কাজ! জানালেন সাইকোর স্টুডিওর সঙ্গে কাজ করছেন। ওই সময় অনলাইনে একটা ছোট্ট রোবটের ভিডিও ঘুরে বেড়াচ্ছিল। বাংলাদেশের এনিমেশনে আমার দেখা অন্যতম ভাল একটি কাজ। জানলাম সেটা ছিল সেই সাইকোর স্টুডিওর কাজ! সাইকোরের কর্নধার (Murad Talkin) মুরাদ এর সঙ্গে পরিচয় হলো। যে নিজেও বাইরে থেকে এনিমেশন এর উপর পড়াশোনা করে বিদেশের চাকরিকে মানা করে দিয়ে বাংলাদেশে এসে ষ্টুডিও দিয়েছে। মুরাদ আবার আমার স্কুল গভ ল্যাব এর। বললাম বাহ্ পাগলে পাগল তো ভাল মিলসে।
আরো পড়তে পারেন….
সাদমান ইসলাম অনিক : কে এই নতুন টেস্ট ক্রিকেটার ?
রাজনীতি ছাড়া দেশের উন্নয়ন জোরালোভাবে সম্ভব নয় : মাশরাফি মুর্তজা
অরুন্ধতী রায় : ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার এক মানুষ
সময় যায়, আরিফ ভাই আমার সাথে শেয়ার করেন বিভিন্ন টেস্ট ফুটেজ। আমি ওনাদের ফিল্মটায় পানির কাজ দেখে হতভম্ব হয়ে যাই! আমাদের ছোট্ট দেশটির ইতিহাসে এত নিখুঁত সিজি পানির কাজ হয়নি। এনভায়রনমেন্ট গাছের কাজ, লাইট এন্ড শেডিং এর কাজ আমাকে মুগ্ধ করে। আমি সবচেয়ে বেশি বিস্মিত হই চুল আর কাপড়ের এনিমেশন দেখে। এনিমেশনের এই স্পেশালাইজেশন কে কোন কোন ষ্টুডিও বলে টেকএনিম। কোন কোন ষ্টুডিও ভাগ করে নেয় হেয়ার/ফার (চুল/পশম), ক্লথ (কাপড়), মাসল (পেশী) এই ক্যাটাগরিতে। মূল এনিমেশনের পাশাপাশি এই বিশেষ এনিমেশন চরিত্রকে এমন ডিটেইল দেয় যা তাকে বাস্তব সম্মত করতে সাহায্য করে। আমাদের দেশে কোনো এনিমেশনে কখনো এই ডিটেল থাকে না। Tomorrow ফিল্মটায় এই ডিটেইল আছে! খুব সুন্দর করেই আছে.
আমার ধারণা গল্পের টপিক এবং এনিমেশনের কোয়ালিটির জন্য ফিল্মটি পৃথিবীর অনেক বড় বড় ফেস্টিভ্যাল এ যাবে। বাংলাদেশের এনিমেশন জগতের এক নতুন অধ্যায় লেখা হবে এর পর থেকে। দেশের বাইরের মানুষজন জানবে। দেশে আসবে এনিমেশনের আউটসোর্সিং এর কাজ। এর পাশাপাশি দেশের ইনভেস্টররাও বুঝবেন কত ভাল কাজ দেশে করা সম্ভব। একটু সময় এবং বাজেট ব্যয় করলে। আমার ধারণা Tomorrow নামের এই ফিল্মটার জন্য বাংলাদেশের এনিমেশনের টুমোরো মানে ভবিষ্যৎ পাল্টে যাবে। এবং সেই সাথে পূরণ করবে আরিফ ভাই এর বাংলাদেশে এনিমেশন ইন্ডাস্ট্রি গড়ার স্বপ্ন! আমার পাগল ভাইটার স্বপ্ন পূরণ হোক! এই হচ্ছে দূর দেশে বসে আরেক পাগলের চাওয়া।
পুনশ্চ: মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমাদের এনিমেটেড শর্ট ফিল্ম #Surviving71 তেও আরিফ ভাই থাকছেন এনিমেশন সুপারভাইজার হিসেবে। সত্য কথা কি, ওনার সাথে এনিমেশন নিয়ে এক বিশাল আড্ডা দেয়ার পরই আমি খুব উত্তেজিত হয়ে সিনেমাটির কাজ শুরু করি! এই জীবনে হয়তো ওনার এই ঋণ শোধ করা যাবে না। ওহ আরেকটা কথা, মুরাদ এবং তার সাইকোরের চমৎকার সিজি টিমও থাকছে আমাদের #Surviving71 এ! ইতিমধ্যে তারা একটি সিজি ট্রেইন মডেল করে ফেলেছেন আমাদের জন্য। যেই ট্রেইন আমাদের শর্টফিল্মটায় একটা বিশাল এনভায়রনমেন্ট! এই যোগসূত্রও আরিফ ভাইয়ের করা। আর তাইতো আমি গুনগুন করে গান গাই আরিফ ভাই কে দেখলে, “এই ঋণ কোন দিন, শোধ হবে না, না না না, শোধ হবে না!” নোট: লেখা লেখকের ফেসবুক ওয়াল থেকে সংগ্রহ।