এই পৃথিবীতে প্রতিটি মানুষই কিছু না কিছু কুসংস্কারে ভোগে। আমি ভুগি ভাঙা আয়না বা মইয়ের তলা দিয়ে হাঁটতে যখন হয়। এসব পরিহার করার চেষ্টা করি। আমার এক আত্মীয়ের খুব সুন্দর একটি ড্রেসিং টেবিল ছিল। একদিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে দেখে, আয়নার মাঝখানে মস্ত এক ফাটল বা চিড়। ও প্রথমে পাত্তা দেয়নি। কিন্তু যখন কিছুদিনের মধ্যে ওর আপাত সুখী বিয়েটা ভেঙে যায়, ওর মনে পড়ে ড্রেসিং টেবিলের আয়না ওকে কী বলতে চেয়েছিল। এসবে কতটা সত্য আছে, জানি না। নানা সব কুসংস্কারে ভোগে। বিখ্যাতরাও বাদ পড়েন না। এবার আসছি বিখ্যাতদের কুসংস্কারে।
চার্লস ডিকেন্স (১৮১২-১৮৭০) বেশ কতগুলো কুসংস্কারে ভুগতেন। তিনি কখনও কাউকে চাকু উপহার হিসেবে দিতেন না, নিজেও পেতে পছন্দ করতেন না। তবে চাকু পাওয়ার পর যদি তাকে কিছু টাকা-পয়সা দেওয়া হয়, তাহলে দোষ কেটে যায়। তিনি উত্তর দিক হয়ে লিখতে ভালোবাসতেন। সে জন্য একটা কম্পাস সবসময় সঙ্গে রাখতেন। তার আরও কুসংস্কার ছিল। ‘ডেভিড কপারফিল্ড’ পড়লেই সেগুলো জানা যাবে। রুমাল কারও কাছ থেকে পেতে পছন্দ করতেন না, দিতেনও না।
ডক্টর সিউস (১৯০৪-১৯৯১) নামের লেখকের সংগ্রহে ছিল তিনশ’টির মতো হ্যাট। যেদিন যেটা মনে হতো, মাথায় দিয়ে লিখতেন। তারপর বদলাতেন। যেটি মাথায় দিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন, সেটাই মাথায় শেষ পর্যন্ত রাখতেন এবং লেখা চালিয়ে যেতেন। পাগল আর কাকে বলে।
ইসাবেলা আয়েন্দে (১৯৪২-) : তিনি সবসময় বই লেখার প্রথম লাইন শুরু করতেন ৮ জানুয়ারি। মনে করতেন, এটি তার লাকি নম্বর। অন্য সময় বই শুরু করার ইচ্ছা থাকলেও করতেন না। প্রথম লাইন ওই তারিখেই লিখতে হবে কিনা।
জেমস জয়েস (১৮২২-১৯৪১) :সবসময় দুই সংখ্যাটিকে পছন্দ করতেন। ১৮২২ সালে জন্ম। কাজেই বই প্রকাশ করতে গিয়ে খেয়াল করতেন সেই সময় দুই দিয়ে শেষ হয়েছে কিনা। ১৯২২ সালে একটি বিখ্যাত বই প্রকাশ করেন। এভাবে খুঁজতেন, কোন দিন দুই দিয়ে শেষ হয়েছে। তিনি বিছানায় পেটের নিচে বালিশ দিয়ে লিখতেন। এটা নাকি ছিল তার লাকি পজিশন। একটি নীল বড় পেন্সিল দিয়ে লিখতেন। সাদা পোশাক পরে।
জন স্টেইনবেক (১৯০২-১৯৬৪) :সবসময় পেন্সিলে লিখতেন। বলতেন, এটা আমার জন্য লাকি। ১২টি ধারালো পেন্সিল নিয়ে বসতেন। একটার পর একটা ধার কমে গেলে বদলাতেন। সে জন্য তার টেবিলে সবসময় ১২টি ধারালো পেন্সিল থাকত। সার্পনারে সার্প। তারই মেধার মতো। ট্রুমান ক্যাপোটি (১৯২৪-১৯৮৪) :কখনও কোনো লেখা শুক্রবারে শুরু বা শেষ করতেন না। বলতেন, ওটা আমার জন্য শুভ নয়। অপেক্ষা করতেন তার পরের দিনের জন্য।
জ্যাক লন্ডন (১৮৭৬-১৯১৬) :প্রতিদিন এক হাজার শব্দের বেশি লিখতেন না। বলতেন, এরপর যেটা লিখব, সেটা মনের মতো হবে না। অ্যান্থনি ট্রলপ (১৮১৫-১৮৮২) :২৫০ শব্দ লেখার পর অবসর নিতেন। হাতে ঘড়ি নিয়ে হাঁটাহাঁটি করতেন। তারপর রেস্ট হয়ে গেলে আবার লেখা শুরু করতেন। সকাল ৫টা ৩০ মিনিটে রোজদিন কাজ শুরু করতেন এবং এভাবে সারাদিন লিখতেন। উইলিয়াম গোল্ডিং (১৯১১-১৯৯৩) :একদিনে সবসময় তিন হাজার শব্দ লিখতেন, তার বেশি লিখতেন না। বলতেন, এর পরে জোর করে লিখলে সেটা লাকি হবে না। এডগার অ্যালান পো (১৮৯০-১৯৭৬) :তার বিড়াল যদি কাছে বসে পারিং করে, তাহলে বুঝতে হবে লেখা ভালো হচ্ছে। আর যদি চুপচাপ থাকে, তাহলে তার লেখা বিড়ালের পছন্দ নয়। বিড়াল কাছে নিয়ে লিখতেন। আলেকজান্ডার ডুমা (১৮০২-১৮৭০) : উপন্যাস লিখতেন একটা বিশেষ নীল কাগজে। অন্য কোনো রঙের কাগজে নয়। কবিতা লিখতেন হলুদ কাগজে। আর রচনা গোলাপি কাগজে। একবার ভ্রমণে নীল কাগজ পাননি বলে ক্রিম কাগজে লিখতে বাধ্য হন। বলেন- লেখাটা ভালো হয়নি তার পছন্দের কাগজের অভাবে। ভার্জিনিয়া উল্ফ (১৮৮২-১৯৪১) :লেখার সময় বিভিন্ন রঙের কালি ব্যবহার করতেন। লুইস ক্যারোল (১৮৩১-১৮৯৮) :সবসময় বেগুনি কালি ব্যবহার করতেন।
এবার আসছি কিছু অভিনেতা-অভিনেত্রীর কুসংস্কারে। অড্রে হেপবার্ন (১৯২৯-১৯৯৩) :পছন্দ করতেন ৫৫ নম্বরটি।
রণবীর সিং নামের ভারতের একজন অভিনেতা গলায় একটা কালো সুতার মালা পরেন। অনেকদিন আগে মা দিয়েছিলেন আপদবালাই থেকে দূরে থাকতে। এখনও সেটা গলায় রাখেন। বলেন- এ না হলে আমার কিছু ভালো হয় না। আমির খান (১৯৬৫) :’তারে জমিন পরের’ সাফল্যের পর সব ছবি ডিসেম্বরে রিলিজ করতে চান। এমনকি তার ছেলে আজাদের জন্ম যেন ডিসেম্বর মাসে হয়, সেদিকে বিশেষ খেয়াল রাখেন এবং ছেলে বাবার ইচ্ছামতো এই পৃথিবীতে আসে। রণবীর কাপুর (১৯৮২) :মাকে মনে করেন তার ঈশ্বর। মা তার ‘লাকি চার্ম’। সবসময় গাড়ির নম্বর ৮। কারণ তার মায়ের জন্মদিন ৮ তারিখে। সবচেয়ে বেশি টাকা পান ছবি করে। অমিতাভ বচ্চন (১৯৪২) :একটা অদ্ভুত বিশ্বাস আছে। সেটা হলো, তিনি ভারতীয় ক্রিকেটারদের খেলা দেখতে চান না। বলেন, আমি দেখতে বসলে ওরা হেরে যাবে। এসব বিশ্বাসে কোনো যুক্তি কাজ করে না। কেবল অন্ধবিশ্বাস এই আর কি। আমেরিকার অভিনেত্রী মেগান ফক্স (১৯৮৬) বিশ্বাস করেন, তিনি যদি প্লেনে ওঠার সময় ব্রিটনি স্পিয়ার্সের সঙ্গে কথা বলেন, তাহলে সে যাত্রায় কিছু হবে না। মানে প্লেন ক্রাশ করবে না এবং তিনি মারা যাবেন না। এটাও অন্ধবিশ্বাস। কামেরন ডিয়াজ (১৯৭২) নামের সুন্দরী অভিনেত্রী বিশ্বাস করেন, তার গলায় একটা বিশেষ মালা থাকতে হবে। মালাটি তাকে একজন উপহার দিয়েছিল। মালাটাকে বলা হয় ‘আন্টি এজিং নেকলেস’। এটা গলায় পরা থাকলে কোনো বিপদ, এমনকি মৃত্যুকেও ঠেকানো যাবে।
নরসুন্দা ডট কমে আরো পড়ুন…..
বঙ্গবন্ধুই আমাকে শিখিয়েছেন জনগণের কাছে যাওয়ার মাহাত্ম্য- মো. আবদুল হামিদ
আমেরিকার র্যাপার গায়ক মিসি এলিয়ট (১৯৭৪) সারা জীবন কালো বিড়ালকে পরিহার করেছেন। আশপাশে কালো বিড়াল থাকলে তিনি সেদিক মারাবেন না। আমেরিকার বড় গল্ফ খেলোয়াড় টাইগার উড (১৯৭৫) যখন গল্ফ ফাইনাল খেলতে যান, লাল ও কালোর একটা বিশেষ পোশাক পরেন। বলেন, এটা পরলে হার হবে না। আমেরিকার আর একজন বড় অভিনেত্রী জেনিফার আনিসটন (১৯৬৯) প্লেনে ওঠার সময় সবসময় ডান পা আগে ফেলেন। তারপর প্লেনের দরজায় তিনবার আঘাত করেন। এতে নাকি কোনো বিপদ হয় না।
এবার বলছি বিখ্যাত আঁকিয়ে পাবলো পিকাসোর কথায় (১৮৮১-১৯৭৩)। তিনি নাকি কোনোদিন কোনো পুরনো জিনিস ফেলে দিতেন না। তিনি মনে করতেন, এতে তার অস্তিত্বের কিছু অংশ চলে যাবে। পুরনো জিনিসের পাহাড় জমেছিল তার বাড়িতে। যেগুলো পরে নিলামে বিক্রি হয়। আর একজন আঁকিয়ে সালভাডোর ডালি (১৯০৪-১৯৪৯) :সঙ্গে রাখতেন বিশেষ ধাতুতে তৈরি একটা ম্যাজিক ওয়ান্ড। মাঝেমধ্যেই সেটা চারপাশে ঘোরাতেন। মনে করতেন, এতে চারপাশে কোনো অশুভ কিছু ছায়া ফেলবে না। তিনি তো এমনিতেই বদ্ধপাগল ছিলেন মনে হয়। এবার দুই-একজন গায়কের কথা বলি। আমেরিকান জাজ সিঙ্গার এলা ফিজজারোল্ড (১৯১৭-১৯৯৬) স্টেজের বিশেষ জায়গায় দাঁড়াতেন। সেখানেই দাঁড়িয়ে গান করতেন। কখনও জায়গা বদল করতেন না। মনে করতেন, জায়গা বদল করলে তার গান ভালো হবে না। গুসতাভ মালহার (১৮৬০-১৯১১) নামের ক্লাসিক সিঙ্গার নয় নম্বর সিল্ফম্ফনি লিখতে গিয়ে একে নয় নম্বর সিল্ফম্ফনি বলতেন না। এর একটা নাম দিয়েছিলেন। কারণ বেটোফেন ও সুরাট নয় নম্বর সিল্ফম্ফনি লেখার পর মারা যান। যেমন অনেকে ১৩ নম্বর ঘরে থাকতে ভয় পায়। আনলাকি থার্টিন বলে যার প্রবাদ আছে। লুদভিগ বেটোফেন (১৭৭০-১৮২৮) :খুব ভোরে উঠেই সঙ্গীত রচনা করতে শুরু করেন। কিছুক্ষণ পর উঠে একটি কফির কাপে গুনে গুনে ৬০টি কফির দানা ফেলতেন। তারপর কফি পান করতেন। তারপরেও নয় নম্বর সিল্ফম্ফনি লেখার পর তিনি মারা যান। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এক বাড়িতে বেশিদিন থাকতে পারতেন না বলে শুনেছি। আফিম না পেলে শরৎচন্দ্র লিখতে পারতেন না। হাজার হাজার কাপ চা আর পান-জর্দা না পেলে এত গান লিখতে পারতেন না কাজী নজরুল ইসলাম।
এবার আসছি একটি ব্যক্তিগত প্রসঙ্গে। গত লেখায় বলেছি, গোলাম সারওয়ার আমাকে প্রায়ই ঢাকা ক্লাবে খাওয়াতে নিয়ে যেতেন। কিন্তু তিনি নিজে খুব কম খেতেন। স্বল্পাহারী বলতে যা বোঝায়, তিনি ছিলেন তা। আমি জোর করলে তিনি বলতেন, কম খেয়ে ভালো আছি। দেখেছ আমার স্বাস্থ্য কত ভালো! এ কথা শুনে বলেছিলাম, নিজের স্বাস্থ্য নিয়ে এত অহঙ্কার ভালো নয়। লন্ডনে এমন কথা শুনলে বলতে হতো ‘টাচউড’। এই ‘টাচউড’ যে কোথায় থেকে এসেছে জানি না। ভালো কিছু হওয়ার জন্য বলা হয়- ‘আই কিপ মাই ফিঙ্গার ক্রশ ফর ইউ।’ আর খারাপ কিছু না হওয়ার জন্য বলে ‘টাচউড’। এখন মনে হয়, সেদিন যখন তিনি নিজের শরীরের কথা গর্ব করে বলছিলেন, আমার কি বলা উচিত ছিল ‘টাচউড’? জানি না। তাকে কি কোনোমতেই ধরে রাখা যেত না? ভেতরে ভেতরে কলকব্জাগুলো যে এমন করে ক্ষয় হয়েছিল, কোনোদিন তো সেটা মনে হয়নি। আসলে তিনি বুঝতে দেননি।
ব্রিটেন প্রবাসী কথাসাহিত্যিক। প্রকাশ: ০৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮, সমকাল।