ইরাকের উত্তরাঞ্চলীয় ছোট্ট গ্রাম কোচোতে পরিবারের সঙ্গেই থাকতেন নাদিয়া মুরাদ নামের এক তরুণী। দরিদ্র ওই গ্রামের মানুষের চাহিদা কম ছিল বলে সবাই সুখী ছিলেন। ওই দারিদ্র্যের মধ্যেই পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছিলেন নাদিয়া।
কিন্তু ২০১৪ সালে ইসলামিক জঙ্গিগোষ্ঠী (আইএস) ঢুকে পড়ে ওই গ্রামে। একদিন গ্রামের সবাইকে অস্ত্রের মুখে একটি স্কুলে ঢোকানো হয়। পুরুষদের আলাদা করে স্কুলের বাইরে দাঁড় করানো হয়। এর পরেই মুহুর্মুহু গুলিতে নাদিয়ার ছয় ভাইসহ পুরুষদের হত্যা করা হয়।
পুরুষদের হত্যা করার পর আইএস জঙ্গিরা নাদিয়া ও অন্য নারীদের একটি বাসে করে মসুল শহরে নিয়ে যায়।
সেখানে অল্প বয়সী মেয়েদের যৌনদাসী হিসেবে বিক্রি করা হয়।
বিক্রি হন ইয়াজিদি তরুণী নাদিয়াও। আইএসের যৌনদাসী হিসেবে বেশ কিছুদিন থাকার পর পালিয়ে আসেন তিনি।
ব্রিটিশ অনলাইন দ্য ইনডিপেনডেন্টের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গেল বছর লন্ডনে এক সাক্ষাৎকারে নিজেই এই লোমহর্ষক কাহিনি জানিয়েছেন নাদিয়া মুরাদ। তাঁর বয়স এখন ২৫ বছর। ‘দ্য লাস্ট গার্ল’ শিরোনামে নাদিয়ার একটি বইও প্রকাশিত হয়েছে। ওই বইয়ে এ ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে।আইএসের কাছ থেকে পালিয়ে আসার পর নাদিয়া মুরাদ জাতিসংঘের শুভেচ্ছাদূত হয়েছেন।
সাক্ষাৎকারে নাদিয়া মুরাদ বলেন, ‘এ ঘটনা আমি ইচ্ছাকৃতভাবে বলেছি, তা নয়। বরং কাউকে না কাউকে লোমহর্ষক এই ঘটনা বলতেই হতো।’
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৪ সালে আইএস জঙ্গিরা ইরাকের উত্তরাঞ্চলীয় এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। এই এলাকায় ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের মানুষের বাস। আইএসের জঙ্গিরা ওই এলাকায় নারীসহ হাজার হাজার মানুষকে অপহরণ ও হত্যা করে। যেসব তরুণী ও নারীদের তাঁরা অপহরণ করে, তাঁদের যৌনদাসী হিসেবে বিক্রি ও ব্যবহার করে জঙ্গিরা।
নাদিয়া বলেন, ‘আমার এই বই প্রকাশের মূল লক্ষ্য হলো গোটা বিশ্ব জানুক, ইয়াজিদি নারীদের সঙ্গে আইএস কী করে। নারীরা কীভাবে নির্যাতন সহ্য করেন।’
নাদিয়া মুরাদ বলেন, ‘আমাদের গ্রামের সবাই গরিব। কিন্তু এতেই সবাই সন্তুষ্ট ছিলেন, সুখী ছিলেন। ২০১৪ সালে আমাদের গ্রামে ঢোকে আইএস। তাঁরা অন্য পুরুষদের সঙ্গে আমার ছয় ভাইকে গুলি করে হত্যা করে। পরে আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশী নারীদের সঙ্গে আমাকেও বাসে মসুল শহরে নিয়ে যাওয়া হয়। বাসে যাওয়ার সময় আইএসের জঙ্গিরা নারীদের শ্লীলতাহানি ও যৌন হয়রানি করে।’
আইএসের হাত থেকে পালিয়ে আসা এই তরুণী বলেন, বাস থেকে নামিয়ে যৌনদাসী হিসেবে তাঁদের বিক্রির ব্যবস্থা করা হয়। এক ব্যক্তি দেখেশুনে তিনজন নারীকে পছন্দ করে। পরে মার্কিন ডলার দিয়ে তাঁদের কিনে নিয়ে যায়। আরেক ব্যক্তি নাদিয়ার পেটে সিগারেটের ছ্যাঁকা দেয়। এর অর্থ নাদিয়াকে কেনার জন্য পছন্দ করেছে ওই ব্যক্তি। পরে ওই ব্যক্তি তাঁকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যায়।
নাদিয়া বলেন, ‘সব সময় এই বেদনাদায়ক গল্প বলতে আমার ভালো লাগে না। এ কারণেই এসব ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ আমি বইয়ে লিখেছি।’ তিনি বলেন, আইএস জঙ্গিরা ইয়াজিদি নারী, তরুণী এমনকি নয় বছর বয়সী কন্যাশিশুকেও যৌন নির্যাতন করতে ছাড়ে না। তাঁদের অপহরণের শিকার অনেক ইয়াজিদি নারী আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, যৌনদাসী হিসেবে থাকার পর একদিন পালানোর চেষ্টা করেছিলেন নাদিয়া। কিন্তু ধরা পড়েন। আর পালানোর চেষ্টা করার শাস্তি হিসেবে তিনি গণধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন।
নাদিয়া বলেন, ‘পালানোর চেষ্টা করে ধরা পড়ে গণধর্ষণের শিকার হয়েও আমি ভেঙে পড়িনি। কারণ হাজারো নারী আইএসের হাতের বন্দী আছেন। এ ভাবনাই আমাকে সাহস দিয়েছিল।’
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, যৌন নির্যাতনের শিকার নাদিয়া আইএসের হাত থেকে পালানোর জন্য তক্কেতক্কে ছিলেন। একদিন দরজা বন্ধ না করেই নাদিয়াকে একা ঘরে রেখে বেরিয়ে গিয়েছিল এক আইএস সদস্য। ব্যস, এই সুযোগেই ঘর থেকে বেরিয়ে দেয়াল টপকে আইএসের ডেরা থেকে বেরিয়ে যান তিনি। কাপড়ে মুখ ঢেকে মসুলের অন্ধকার রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে একটি বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় চান। পরে ওই বাড়ির সদস্যরা সাহায্য করেন। তাঁরাই একজনের স্ত্রী সাজিয়ে নাদিয়াকে আইএসের এলাকা থেকে বের করে দেন। পরে ২০১৫ সালে জার্মানির শরণার্থীশিবিরে আশ্রয় মেলে। সেখানে তাঁর এক বোনও আছেন। ওই বোনের স্বামীকে জঙ্গিরা হত্যা করেছে। জার্মানির স্টুটগার্টের একটি অ্যাপার্টমেন্টে এখন তিনি বোনসহ থাকেন।
এ বিষয়ে নাদিয়া বলেন, ‘এটা ঠিক সাহসের বিষয় নয়। আপনি যখন প্রতিনিয়ত নির্যাতিত হবেন, নিশ্চিত মৃত্যুর সামনে দাঁড়াবেন, তখন এসব ভাবনাই আপনাকে টিকে থাকার উপায় বের করে দেবে।’
নাদিয়া আরও বলেন, ‘মসুলে প্রায় ২০ লাখ মানুষ বাস করেন। তাঁদের মধ্যে দুই হাজার মেয়েকে অপহরণ করে আটকে রেখেছে জঙ্গিরা। মসুলে হাজারো পরিবার বাস করেন কিন্তু কেউই সাহায্য করতে এগিয়ে আসেননি। যাঁরা সাহায্যের জন্য এগিয়ে এসেছিলেন, তাঁরা হাজার হাজার ডলার দাবি করেছিলেন।’ নাদিয়ার ভাবিকে উদ্ধারে ওই ভাবির পরিবার ২০ হাজার ডলার দিয়েছিল বলেও জানিয়েছেন তিনি।
আইএসের হাত থেকে পালিয়ে আসার পর একবার নিজের গ্রামে ফিরে গিয়েছিলেন নাদিয়া। কিন্তু সেখানে গিয়ে আর বাড়ি খুঁজে পাননি তিনি। পুরো বাড়ি, পুরো গ্রাম যেন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়ে আছে।
‘দ্য লাস্ট গার্ল’ বইয়ের লেখক নাদিয়া মুরাদ বলেন, ‘আমাদের ধারণা ছিল, অন্য পুরুষ সদস্যদের মতোই আমাদের হত্যা করা হতে পারে। কিন্তু আমাদের হত্যা করা হয়নি। এর বদলে ইউরোপ, সৌদি আরব ও তিউনিসিয়া থেকে আসা জঙ্গিরা রোজ একের পর এক এসে আমাদের ধর্ষণ করে যেত।’
তিনি আরও বলেন, তিনি একজন মেকআপ আর্টিস্ট হতে চান। নিজের একটা স্যালন খুলতে চান। নতুন করে জীবন শুরু করতে চান। তিনি আইএসের হাত থেকে বেঁচে পালিয়ে আসা তরুণী হিসেবে পরিচিতি পেতে চান না।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) শীর্ষ মানবাধিকারবিষয়ক পুরস্কার শাখারভ পুরস্কার-২০১৬ পেয়েছেন ইয়াজিদি নারী নাদিয়া মুরাদ । সূত্র: প্রথম আলো।